ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কমিশনভোগী চিকিৎসকদের রমরমা বাণিজ্য ;###;স্বাস্থ্য বিভাগের রহস্যজনক নীরবতায় জনমনে নানা প্রশ্ন

ময়মনসিংহে মানহীন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৭ জুন ২০১৭

ময়মনসিংহে মানহীন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবের ছড়াছড়ি

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারপাশে গড়ে উঠেছে অনুমোদনবিহীন ও মানহীন অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব। স্বাস্থ্য বিভাগের নাকের ডগার ওপর গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ল্যাবে ভুল চিকিৎসাসহ রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হলেও কোন প্রতিকার মিলছে না। ভুল চিকিৎসার ফলে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। এসব নিয়ে প্রায়ই ভাংচুরের শিকার হচ্ছে মানহীন ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল। স্বাস্থ্য বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের রহস্যজনক নীবরবতায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কারণ অনুমোদনহীন এসব ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবে কী হচ্ছে তা না দেখার ভান করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একশ্রেণীর কমিশনভোগী চিকিৎসক এসব নাম সর্বস্ব ক্লিনিক ল্যাবের সঙ্গের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। শহরের নামীদামী ল্যাবগুলো একশ্রেণীর চিকিৎসকদের অগ্রিম কমিশন দেয়ার রেওয়াজ চালু করেছে। তবে মধ্যম সারির ল্যাব এই কমিশন নগদ পৌঁছে দিচ্ছে। এতে করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য ল্যাবে বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলেও কর্তব্যরত চিকিৎসকরা কেবলমাত্র কমিশনের লোভে রোগীদের বাইরের এসব ল্যাবে পাঠাচ্ছে। ফলে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে রোগীদের। স্থানীয় একাধিক ল্যাব মালিকের দাবি, ডিগ্রীধারী চিকিৎসক দিয়ে নির্ভুল রিপোর্ট দেয়া হলেও ময়মনসিংহ মেডিক্যালের একশ্রেণীর চিকিৎসক নির্ধারিত ল্যাবের বাইরের কোন রিপোর্ট গ্রহণ করছে না। কোন ক্লিনিক ল্যাবের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার না থাকায় নিয়মনীতি না মেনেই সবকিছু চলছে বলে অকপটে স্বীকার করেন ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডাঃ খলিলুর রহমান। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালত মানহীন হাসপাতাল বন্ধসহ সিলগালা করে দেয়ার পরও সিলগালা খুলে সেটি পরিচালনার করার নজির রয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শহরের চরপাড়া, নয়াপাড়া, কপিক্ষেত, মাসকান্দা, ব্রাহ্মপল্লী, বাঘমারা, ভাটিকাশর, কৃষ্টপুর, পাটগুদাম, রামকৃষ্ণমিশন রোড, সাহেবআলী রোড, চামড়াগুদাম ও কালিবাড়ি রোডসহ বিভিন্ন অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি ল্যাব। বিশেষ করে চরপাড়া এলাকায় অবস্থিত ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারপাশে এসব হাসপাতাল ল্যাবের ছড়াছড়ি অবস্থা। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাতেও রয়েছে অসংখ্য হাসপাতাল ও ল্যাব। মূলত এই সরকারী হাসপাতালের ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে এসব নাম সর্বস্ব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ল্যাব। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একশ্রেণীর কমিশন ভোগী ও অর্থলোভী চিকিৎকরাই এসব হাসপাতাল ল্যাবের ভরসা। চিকিৎসকদের ম্যানেজ করে এবং সরকারী হাসপাতালে আসা রোগীদের রাস্তা থেকে কিংবা ভর্তির পর বিছানা থেকে ভাগিয়ে দালাল চক্র নিয়ে যাচ্ছে এসব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ল্যাবে। বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে রোগ নির্ণয়ের প্রায় সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও কমিশনভোগী চিকিৎসকরা বাড়তি আয়ের জন্য অসহায় রোগীদের স্লিপে ল্যাবের নাম লিখে বাইরে পাঠাচ্ছে। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক আবার এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, সরকারী হাসপাতালের কমিশনভোগী এসব চিকিৎসকদের প্রায় সবাই একাধিক গাড়ি ও বাড়ির মালিক। ময়মনসিংহ শহরে যেসব প্রাইভেটকার চলাচল করছে তার ৮০ শতাংশের মালিক এসব চিকিৎসক দাবি স্থানীয়দের। ময়মনসিংহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, খোদ ময়মনসিংহ শহরে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব রয়েছে প্রায় ২০০টি। কিন্তু বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ। সরকারী তালিকায় যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব রয়েছে তাদের বেশিরভাগ বছরের পর বছর ধরে নবায়ন করছে না। হাসপাতাল পরিচালনার অনুমোদন নিয়ে অনেকে ল্যাব খুলে বসেছে। এছাড়া এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবে নেই কোন ডিপ্লোমাধারী নার্স ও প্রশিক্ষিত আয়া। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক দেখানো হয় কেবল খাতায়! আয়াদের নার্সের পোশাক পরিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবে নকল নার্সদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকা-েরও অভিযোগ রয়েছে এন্তার। র‌্যাবের অভিযানে শহরের নামীদামী ল্যাবে মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট ব্যবহারের অভিযোগে মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায়ের ঘটনাও রয়েছে। তারপরও বন্ধ হয়নি কোন ল্যাব। অনেক ল্যাবে ভুয়া টেস্টের রিপোর্ট দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। প্রচার রয়েছে, একই রিপোর্টারের প্যাড ও সিল ব্যবহার করে রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে অসংখ্য ল্যাব থেকে। বাস্তবে একজন রিপোর্টারের পক্ষে এতসব ল্যাবে গিয়ে এসব রিপোর্ট দেখা সম্ভব নয় বলে দাবি স্থানীয়দের। শহরের ব্রাহ্মপল্লী আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাতে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক মার্কেটের নিচতলায় খাবারের রেস্তরাঁর পাশে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব। দুইতলায় হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক। তার ওপরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান। আবাসিক বাসাবাড়ি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেও রয়েছে এমন হাসপাতাল ও ল্যাব। অনুমোদন রয়েছে এমনসব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ল্যাবেও রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। হাতেগোনা ১০-১৫টি ছাড়া অনুমোদিত সবকটি হাসপাতাল ও ল্যাব চলছে সব নিয়ম ও শর্ত অমান্য করে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহ শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ডাঃ তারা গোলন্দাজ স্বাস্থ্য খাতে এসব অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে জানান, আমরা অনুমোদনহীন হাসপাতাল ক্লিনিক ল্যাব বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। তিনি আরও জানান, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ চাইলে অনুমোদনহীন ও মানহীন হাসপাতাল ক্লিনিক ল্যাব সিলগালা করে বন্ধ করে দিতে পারে। তাহলে বন্ধ হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসকদের এই নেতা জানান, সেটি স্বাস্থ্য বিভাগই ভাল বলতে পারবে।
×