ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ বাজার

বোনাসের ১২ হাজার কোটি টাকা ঈদ বাজারে, ধুম কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৭ জুন ২০১৭

বোনাসের ১২ হাজার কোটি টাকা ঈদ বাজারে, ধুম কেনাকাটা

এম শাহজাহান ॥ কেনাকাটায় জমজমাট সারাদেশের ঈদ বাজার। সরকারী-বেসরকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বেতন-বোনাস হয়ে যাওয়ায় চারদিকে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ নাড়ির টানে সবাই ছুটবেন গ্রামের বাড়িতে। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার কেনাকাটায় সরগরম ছিল ঢাকার মার্কেটগুলো। ঈদ সামনে রেখে বাকি দিনগুলোতেও বিক্রেতারা দম ফেলার সময় পাবেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে চাকুরেদের বোনাসের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা চলে আসতে শুরু করেছে ঈদের বাজারে। এছাড়া সঞ্চয়ের টাকা ও বেতনভাতা ক্রেতারা খরচ করছেন ঈদ উৎসব সামনে রেখে। বড় উৎসব তাই সবার বিরাট আয়োজন। বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসছে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বেড়েছে ব্যাপক। ঈদ উপলক্ষে রেকর্ড গতিতে অর্থনীতিতে জমা হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। ঈদের কেনাকাটায় এটিএম বুথে প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের টাকা উত্তোলন করছেন গ্রাহকরা। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকার বেশি। তবে এ উৎসব ঘিরে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিতে ঈদ বাজারে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় ভোক্তাদের পকেট কাটছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। মার্কেটগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের অনলাইন বাজার। নিত্যনতুন পণ্যের সমাহার, বিভিন্ন ছাড় ও উপহারের কমতি নেই ভার্চুয়াল এ বাজারে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদ সামনে রেখে জমজমাট অনলাইনের ঈদ বাজার। এদিকে, ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর শপিংমল, মার্কেট, ফুটপাথসহ সবখানে জমে উঠেছে কেনাকাটা। নিউমার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, এলিফ্যান্ট রোড, যমুনা ফিউচার পার্ক, গাউছিয়া, ফার্মগেট, ধানম-ি হকার্স, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট ও গুলিস্তানসহ বেশকিছু এলাকায় ঘুরে ক্রেতাদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকালেই সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে কেনাকাটার জন্য এক মার্কেট থেকে আরেক মার্কেটে ঘুরতে থাকেন। সাধ্যমতো কেনাকাটা করেন সবাই। দুপুরে গাউছিয়া মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসেন ব্যাংক কর্মকতা সালমা আক্তার। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবার জন্য জামাকাপড় কেনা প্রয়োজন। তাই মার্কেটে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহ নাগাদ দেশের বাড়িতে যেতে হবে। তাই আগে-ভাগে কেনাকাটা শেষ করতে হচ্ছে। ওই মার্কেটের জ্যোতি শাড়ি হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ে। শুক্রবার হওয়ায় ক্রেতার চাপ অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। তাই দোকানে অতিরিক্ত লোকও রাখা হয়েছে, যাতে ক্রেতাদের হয়রানি না হয়। জানা গেছে, সরকারী কর্মকর্তাদের বেতনভাতা বেড়ে যাওয়ায় গত বছর থেকেই ঈদের কেনাকাটা বেড়েছে। বোনাসের পুরো টাকাই খরচ হবে ঈদ বাজারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেনাকাটায় যে ধরনের গতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, নববর্ষের উৎসব ভাতার জমানো টাকা এ ঈদে খরচ হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএ কাদের চোধুরী কিরণ জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের ঈদে ক্রেতাদের কেনাকাটা বেড়েছে। সরকারী কর্মকর্তাদের বেতনভাতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কেটে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শুধু তাই নয়, নববর্ষের উৎসব ভাতার টাকাও মনে হয় এ উৎসবে ব্যয় করছেন ভোক্তারা। কারণ ওই সময় ভাতা পাওয়ার পরও মার্কেট তেমন জমেনি। এবার রমজানের শুরু থেকে বেচাবিক্রি ভাল হচ্ছে। তিনি বলেন, দোকানগুলোতে সারা বছর গড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ বেচাবিক্রি হয়ে থাকে, রমজানে সাধারণত তার দ্বিগুণ বিক্রি হয়। কিন্তু এবার আড়াইগুণ পর্যন্ত বেচাবিক্রি হবে বলে আশা করছি। এসএমই খাতের ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে প্রস্তাবিত বাজেট থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি করেন এ ব্যবসায়ী নেতা। জমে উঠেছে অনলাইনে কেনাকাটা ব্যস্তময় নাগরিক জীবনে অনলাইনের কেনাকাটা বেশ জমে উঠেছে। ঘরে বসেই কেনাকাটার চলটা শুরু কয়েক বছর ধরে। দেশের অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেতাদের বড় অংশ তরুণ-তরুণী। ঈদের আগে অনেকে কাজের চাপে বাজারে যেতে পারছেন না। তাদের জন্য একমাত্র ভরসা অনলাইন বাজার। এবারের ঈদে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের পণ্যতালিকা সাজিয়েছে তরুণদের কথা ভেবেই। কেননা তাদের গ্রাহকদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে নানা রকম ঘড়ি, চশমা সবই আছে এখানে। আরও আছে বিভিন্ন রকম মজার মজার ইলেক্ট্রনিক পণ্য। এছাড়া চাল-ডাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও আছে অনলাইন কেনাকাটার তালিকায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসাস জানান, কাজের ব্যস্ততা থাকে বলেই অনেক দিন ধরে অনলাইনে কেনাকাটা করছি। বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট ছাড়াও দেশের অনেক নামী ব্র্যান্ডের ই-শপ রয়েছে। অনলাইনের নিয়মিত গ্রাহক আমি। ভিড় এড়িয়ে ঈদের কেনাকাটা অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে অনলাইন সুবিধা। বাড়ির লোকজনের জন্যও কেনাকাটা করেছি আপনজোন ডটকম, এসো ডটকম, আজকেরডিলসহ বিভিন্ন অনলাইন বাজার থেকে। অনলাইনের সুবিধা হলোÑ ক্যাশ-অন ডেলিভারি। অর্থাৎ পণ্য হাতে পেয়ে তারপর এর দাম পরিশোধ করা যায়। পোশাক থেকে গয়না, প্রসাধনী থেকে নিত্যপণ্য, কী নেই অনলাইনে। এক ক্লিকেই তা হাজির হবে দোরগোড়ায়। এছাড়া স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এখন ঘরে বসেই ঈদের কেনাকাটা করছেন অনেকেই। ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন-বোনাস ঈদ বাজারে চলতি সপ্তাহের মধ্যে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত ৪০ লাখ শ্রমিকের বেতন ও উৎসবভাতা ঈদ বাজারে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ইতোমধ্যে গার্মেন্টস মালিকরা বেতনভাতা দেয়া শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কিছু ভাল প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিয়ে দিয়েছে। বেতন-বোনাস পেয়েই কেনাকাটার জন্য ক্রেতারা হুমরি খেয়ে পড়েছে রাজধানীর মার্কেটগুলোয়। গোটা রাজধানী রূপ নিয়েছে ঈদ মার্কেটে। কেনাকাটা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। গ্রামাঞ্চলের উপজেলাগুলোতেও জমজমাট ঈদের বাজার। পোশাকের সঙ্গে গৃহস্থালি জিনিসপত্রের বাজারে বেচাবিক্রি ভাল হচ্ছে। দোকানগুলোয় বেচাকেনা অন্য সব সময়ের চেয়ে ভাল। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঈদ অর্থনীতির প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রামে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক। ঈদ সামনে রেখে ক্রেতাদের খরচ বাড়ছে। আর ক্রেতাদের খরচ বাড়লে তার প্রভাব অর্থনীতির ওপর এসে পড়বে, যা ঈদ মার্কেট ঘিরে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্ট হয়। সিপিডির এ গবেষক আরও বলেন, ঈদের অর্থনীতির আকার যা-ই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন কতটুকু, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক পণ্যই এ উপলক্ষে আমদানি হয়ে আসে। তিনি বলেন, মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। এদিকে, দোকান মালিক, ব্যবসায়ীরা প্রতিবছরই ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে তাদের ব্যবসায় বাড়তি পুঁজি বিনিয়োগ করেন। কারণ এ সময় যে পরিমাণ বিক্রিবাট্টা হয়, কিছু ক্ষেত্রে তা পুরো বছরজুড়েও হয় না। মূলত ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বছরের মতো গোটা অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে পরিবহন ব্যবসায় চলছে জমজমাট আয়োজন। ঈদযাত্রায় বাসের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে অনেক রুটে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এছাড়া ঈদ সামনে রেখে চাঙ্গা হয়ে উঠছে দেশের পর্যটন শিল্প খাত। ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পের উদ্যোক্তারা ঈদের বাণিজ্য ধরতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
×