ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘বেফাঁস কথায় ওস্তাদ বিএনপি পাহাড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে যায়নি’

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৭ জুন ২০১৭

‘বেফাঁস কথায় ওস্তাদ বিএনপি পাহাড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে যায়নি’

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে বেফাঁস কথায় ওস্তাদবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি পাহাড়ে বিশেষ করে রাঙ্গামাটিতে মহাদুর্যোগের ঘটনার পর তাদের পাশে যেমন দাঁড়ায়নি, তেমনি এক পয়সার ত্রাণসামগ্রীও দেয়নি। মানুষের সেবার নামে রাজনীতি করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সৃষ্ট এ দলটির এহেন তৎপরতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। গত মঙ্গলবার পার্বত্যাঞ্চলের তিনজেলা অর্থাৎ রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ঝড়ো হাওয়ায় ও ভারী বর্ষণে একদিকে যেমন ঢল নেমেছে তেমনি অসংখ্য স্থানে ভূমিধস হয়েছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে বিপুল। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার পক্ষ থেকে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর ৫ তরতাজা প্রাণ ভূমিধসের মাটিচাপায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় সর্বমোট প্রাণহানির সংখ্যা শুক্রবার শেষ তথ্য অনুযায়ী ১৫৭ জনে উন্নীত হয়েছে। স্বজনহারাদের দাবি রয়েছে, আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। ঘটনার পরপরই শুক্রবার পর্যন্ত সরকারের তিনমন্ত্রী অর্থাৎ সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়কমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর পৃথক পৃথকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেছেন। ত্রাণ বিতরণ করেছেন, প্রশাসনকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর তড়িত তৎপরতা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। এ ধরনের একটি মহাদুর্যোগপূর্ণ এলাকায় অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকায় বসে বক্তৃতা বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই মিলেনি। এসব বক্তৃতা বিবৃতিতে শুধু সরকারের বিরুদ্ধে বেফাঁস কথাবার্তাই উঠে এসেছে। দলটি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে একজনও দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। ত্রাণসামগ্রী তো দূরের কথা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও স্বজন হারানো মানুষগুলোকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যও যায়নি। এর পাশাপাশি সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যারা রাজধানী ঢাকায় নানা ধরনের সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে পরিবেশ ঘোলাপে করার চেষ্টা চালানো হয় তাদের কাউকেও দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। সেনা শাসক মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে পাহাড়ে সমতল ভূমি থেকে স্যাটেলার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ স্যাটেলাররা নির্বিাচরে পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে পাহাড়ী জনপদের মানুষগুলোর ওপর নানা ধরনের অপকর্ম চালানোর জের হিসাবে সৃষ্টি হয়েছিল শান্তি বাহিনী নামের গেরিলা সংগঠন। এ শান্তি বাহিনী ছিল বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিজেএসএস) সামরিক শাখা। দীর্ঘ দুই দশেেকরও বেশি সময় রক্তের হোলিখেলা শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকারের নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। ফলে অবসান ঘটে পাহাড়ী জনপদের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা। শান্তিচুক্তির পর এখনও সব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। এ দাবি জনসংহতি সমিতির। তবে সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। যে কটি অবশিষ্ট রয়েছে তাও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সরকার পক্ষে। যে চুক্তি নিয়ে বাঙালীদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে। এরপরও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার ওই চুক্তি সম্পাদনের পর বড় ধরনের অশান্ত পরিবেশের অবসান ঘটেছে। জিয়া সরকারের পক্ষ থেকে অপরিকল্পিতভাবে বাঙালী স্যাটেলারদের পুনর্বাসনের জের হিসাবে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে পাহাড় কাটাসহ বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। বছরের পর বছর এ অপরিকল্পিত ঘটনাবলীর জের হিসাবে পাহাড়ের ভিত নড়বড়ে হয়ে গত মঙ্গলবার পাহাড়ের তিন জেলায় একযোগে ভূমিধসের ঘটনায় বিপুল প্রাণহানি ও সহায় সম্পদের ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। অথচ, জিয়ার সৃষ্ট সেই দলটি এক মুহূর্তের জন্যও পাহাড়ী জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্বনির্ধারিত সুইডেন সফর নিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে থাকলেও সার্বক্ষণিক পাহাড়ের এ দুর্যোগ নিয়ে খবরাখবর রেখেছেন। সিভিল প্রশাসনসহ সেনা ও নৌবাহিনীকে দুর্গতদের পাশে নিয়োগ করেছেন। সেনা শাসক জিয়ার সৃষ্ট এ দলটি মূলত কাজের চেয়ে কথায় যে চালু তা নতুন করে আরেকবার প্রমাণ করল পাহাড়ের এ দুর্যোগ পরবর্তী ঘটনা নিয়ে। পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাসে গত মঙ্গলবারের ভূমিধস, প্রাণহানি, সহায় সম্পদের ক্ষতির ঘটনা একটি রেকর্ড। এখনও রাঙ্গামাটির সঙ্গে পুরো দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দুর্যোগে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের অধিকাংশ উদ্ধার হয়েছে। সরকার পক্ষে গৃহীত তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা ও তৎপরতায়। কিন্তু এতেও বিএনপি সন্তুষ্ট নয়। কেন নয় তা তারাই জানেন। দুর্যোগ ও দুর্গতদের নিয়ে যে অপরাজনীতি নয় তা বিএনপি প্রমাণ করেছে। অপরদিকে, পার্বত্যাঞ্চলের রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ তিনদিনের শোক ঘোষণা করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। জনসংহতি সমিতি মুখে কুলুপ এটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের পক্ষে ৫ লাখ টাকার অর্থ সাহায্যের বরাদ্দ দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। অথচ, এত বড় দুর্যোগে জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ এবং দেশের অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল না। এ দুর্যোগে রাঙ্গামাটি ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল। শুক্রবার থেকে বিদ্যুত সরবরাহ পুনস্থাপিত হলেও তা আংশিক। সর্বত্র চলছে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট। যাতায়াত ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। সহায় সম্পদ ও জানমাল হারিয়ে মানুষের মাঝে চলছে হাহাকার। ভারী বর্ষণে শত শত ঘরবাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে গেছে এবং ভূমিধসের সৃষ্ট মাটির নিচে চাপা পড়েছে। নিহতদের অধিকাংশ উদ্ধার হয়েছে সরকারেরই তাৎক্ষণিক উদ্যোগে। অথচ, বিএনপি বিষয়টি ইতিবাচকভাবে না দেখে নেতিবাচক বক্তব্যই দিয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও গর্হিত বলে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে আলোচিত হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালানোর মূল নায়ক জিয়া সরকার। অথচ, সেই জিয়ার দলটি কিনা পাহাড় নিয়ে সরব থাকলেও দুর্যোগে একেবারেই নীরব। এ দলটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি করার পথেও বাধা সৃষ্টি করেছিল। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত লংমার্চ হয়েছিল। বেগম জিয়া ঘোষণা করেছিলেন ক্ষমতায় গেলে এ চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। তিনি চুক্তিটিকে কালো চুক্তি বলেও অবহিত করে কিছু মহলের সমর্থন পাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি ওই চুক্তি বাতিল করেননি। সঙ্গত কারণে আলোচনায় এসেছে বিএনপির কাজের সঙ্গে কথার মিল নেই। সর্বশেষ পাহাড়ের এ দুর্যোগের ব্যাপারে বিএনপির অযাচিত ও বেফাঁস কথাবার্তা তাই প্রমাণ করেছে। বর্তমান সরকার পাহাড়ের এ দুর্যোগ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যে তৎপরতা চালিয়েছে এবং এখনও অবাহত রেখেছে তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। পাহাড়ে এ ঘটনায় পাহাড়ীরাও প্রাণ হারিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ও সহায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অথচ, ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি ও অন্যান্য পাহাড়ী সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কি সাহায্য সহায়তা দিয়েছে তা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ হচ্ছেÑ পাহাড়ের ঘটনা নিয়ে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও পাহাড়ের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনসমূহের জনগণের পাশে থাকার কথিত বক্তব্যের নমুনা। বিভিন্ন সূত্রে মতে ব্যক্ত করা হয়েছে, পাহাড়ে এ দুঃখজনক পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে মূলত সেই জিয়া সরকারের আমল থেকেই। দলে দলে বাঙালী স্যাটেলাররা যে যেখানে পারে বসতি স্থাপনের জন্য পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে হেন কোন অপকর্ম নেই যা করেনি। সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে শুরু করে চুরি ডাকাতি, জমি দখল সবই সৃষ্ট সেই জিয়ার আমল থেকে। যার কারণে শুরু হয়েছিল শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধ। যে যুদ্ধ অবসানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বীকৃত। সেই ইতিহাসও বিএনপি মেনে নিতে নারাজ। এ দলটি যা বলে তা করে না। আর যা করে তা বলে না। এটাই তাদের অপরাজনীতির একটি অংশ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
×