ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইকবাল খন্দকার

প্রিয় বাবা

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৭ জুন ২০১৭

প্রিয় বাবা

মা রান্না করছিলেন, কলিংবেলের শব্দে তার হাত থেমে যায়। এই সময়ে কে আসতে পারেÑ ভাবতে ভাবতে তিনি মিনিট খানেক কাটিয়ে দেন। কেউ ভুল করে চাপল না তো! আজকাল প্রায়ই এই কাজটা হয়। টুংটাং করে বেল বাজে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলার পর দেখা যায় কেউ নেই। কিছু মানুষ কাজটা করে ভুল করে, আর কিছু মানুষ করে দুষ্টুমি করে। মা ঠিক করেন, এখন দরজা খুলতে যাবেন না। সত্যি সত্যি কেউ যদি দুষ্টুমি করে থাকে আর তাকে যদি এখন বিনাকারণে ছিটকিনি খুলতে হয়, তাহলে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাবে। সবসময় ইয়ার্কি ফাজলামি ভাললাগে না। মা আবার কাজ শুরু করতে যাবেন, অমনি আবার বেজে ওঠে বেল। এবারের শব্দটা প্রথমবারের চেয়ে কড়া। মা হাত ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে ছিটকিনি খোলেন। দেখতে পান পাশের বাসার আলী আজম তরফদার দাঁড়িয়ে আছেন। শিমুল তাকে তরফদার আঙ্কেল বলে ডাকে। তরফদার আঙ্কেল মাকে সালাম দেন। মা সালামের জবাব দিয়ে তাকে ঘরে এসে বসতে অনুরোধ করেন। আঙ্কেল জানান তার এখন বসার মতো সময় নেই। মা তার মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বুঝতে পারেন কোন কারণে তার মন খুব খারাপ। মা তাকে জিজ্ঞেস করেন কোন সমস্যা কিনা। আঙ্কেল বলেনÑ সমস্যা তো বটেই। সমস্যা ছাড়া তো আর আসিনি। তা শিমুল কি এখন ঘরে আছে? থাকলে একটু ডাকুন। তার সামনেই বলি কথাটা। মা শিমুলের ঘরের দিকে তাকান। তার তাকানো দেখে তরফদার আঙ্কেল বুঝতে পারেন শিমুল ঘরেই আছে। তাই তিনি তাকে ডাকার জন্য আবার তাগাদা দেন। মা ডাক দিতে গিয়েও কী মনে করে যেন থেমে যান। বলেনÑ বুঝতে পারছি শিমুল কোন একটা ঝামেলা করেছে। কী করেছে, একটু জানতে পারি? আমাকে একটু বলেন, প্লিজ। আমি ওকে শাসন করব। বলেন আপনি। ভেতরে এসে বসে বলেন। তরফদার আঙ্কেল ঘরে আসার ব্যাপারে আবারও অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেনÑ শিমুল গত ক’দিন ধরে যেটা করছে, সেটাকে এমনিতে হয়ত অন্যায় বলে মনে হবে না। তবে এটা গুরুতর অন্যায়। তার কারণে ফ্ল্যাটের লোকজন একটু আরাম করে ঘুমুতে পারবে না, এটা কেমন কথা! আমি বাপু ধৈর্যশীল মানুষ। আমার কোন সমস্যা হলেও সেটা সহ্য করার চেষ্টা করি। খুব বিপদে না পড়লে মুখ খুলি না। কিন্তু সবার ধৈর্যশক্তি তো আর একরকম না। তারা কেন আপনার ছেলের যন্ত্রণা সহ্য করবে? মা বললেনÑ আমি ঠিক আপনার কথা বুঝতে পারছি না। শিমুল কীভাবে ফ্ল্যাটের লোকজনের ঘুমের ক্ষতি করছে? তরফদার আঙ্কেল মাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেনÑ আপনার ছেলে কীভাবে এই ফ্ল্যাট এবং পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের ঘুমের ক্ষতি করছে, এটা আপনার জানার বা বোঝার কথা না এই জন্য, যেহেতু আপনি সকালেই অফিসে চলে যান। ভাগ্য ভাল, আজকে কোন কারণে অফিসে যাননি। নইলে তো এখন এসে কথা না বলেই চলে যেতে হতো। মা এবার কিছু বিরক্ত হলেনÑ যেহেতু আমি একটা চাকরি করি, তাই রোজ সকালে আমাকে অফিসে চলে যেতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। শিমুল আপনাদের কী ক্ষতি করেছে বা করছে, দয়া করে সরাসরি বলেন। তরফদার আঙ্কেল বললেনÑ আপনার ছেলে এত জোরে জোরে পেপার পড়ে যে, মনে হয় আপনাদের বারান্দায় বাজার বসেছে। আমরা কানে বালিশ চেপেও স্বাভাবিক থাকতে পারি না। এইটুকু বাচ্চা, তার আবার কিসের এত পেপার পড়া! আর পড়লেই চিল্লিয়ে পড়তে হবে? আর কেউ পেপার পড়ে না? আঙ্কেল বলেন, বাচ্চাদের এত আদর দিতে হয় না। আদর দিলে তারা মাথায় চড়ে বসে। তাদের কড়া শাসনের মধ্যে রাখতে হয়। আমি আশা করব আপনিও আপনার বাচ্চাকে কড়া শাসন করবেন এবং পেপার পড়ার নামে চিল্লাপাল্লা করে যাতে আমাদের ঘুমের ক্ষতি না করে, সেই ব্যবস্থা করবেন। আঙ্কেল চলে গেলে মা দরজা বন্ধ করে এসে শিমুলের ঘরে ঢোকেন। মা রেগে জিজ্ঞেস করেন, কেন সকালবেলা জোরে জোরে পেপার পড়ে সবার ঘুমের ক্ষতি করো? শিমুল কোন কথা বলে না। মা একই প্রশ্ন আবার করেন। এবারও চুপ করে থাকে শিমুল। হঠাৎ মা বলে ওঠেনÑ আগামীকাল থেকে তোমার পেপার পড়া বন্ধ। আমি যেন তোমাকে পেপার হাতে নিতেও না দেখি। শিমুল এবার ছলোছলো চোখে তাকায় মায়ের দিকে। মা বলেনÑ কেঁদে লাভ নেই। মানুষের ক্ষতি করে আমি তোমাকে পেপার পড়তে দিতে পারি না। এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তÑ আগামীকাল থেকে তোমার পেপার পড়া হচ্ছে না। শিমুলের চোখ থেকে টপটপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সে বাম হাতে পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলেÑ আমি আমার জন্য জোরে জোরে পেপার পড়ি না আম্মু। আব্বুর জন্য পড়ি। আব্বুর চোখের সমস্যার পাশাপাশি কানের সমস্যাটাও কয়েক দিন ধরে খুব বেড়েছে। আস্তে পড়লে শুনতে পান না। আব্বুকে অনেক ভালবাসি তাই জোরে জোরে পেপার পড়ি। আব্বুকে কানের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×