ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ

চিকিৎসা সেবাকর্মীদের নিরাপত্তা আইন জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৭ জুন ২০১৭

চিকিৎসা সেবাকর্মীদের নিরাপত্তা আইন জরুরী

একদিন মেডিসিন বিভাগে জুনিয়র ডাক্তার এবং ছাত্রসহ রাউন্ড দিচ্ছি। একজন জীর্ণশীর্ণ প্রবীণ রোগী দেখলাম। কয়েকদিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ভদ্রলোক হাইস্কুলের শিক্ষক। বুকের এক্স রে এবং অন্যান্য রিপোর্ট দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, তার ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে, অবস্থা খুব একটা ভালো না। রোগীকে ক্যান্সার বিভাগে স্থানান্তর করা হবে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য। তাকে রোগ সম্পর্কে তখনও জানাইনি। তার ছেলেকে আমার অফিস কক্ষে দেখা করতে বললাম। রাউন্ড শেষে তার ছেলে এসে কাতর স্বরে জানতে চাইল, ‘স্যার, আমার আব্বার কি হয়েছে? উনি পুরোপুরি সুস্থ হবেন তো? টাকা পয়সা কোন বিষয়ই না। দরকার হলে চিকিৎসার জন্য জমি জমা সব বিক্রি করে আব্বার চিকিৎসা করাব। সারাটা জনম উনি আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন...’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর তাকে আমার পাশে বসিয়ে রোগ সম্পর্কে ধারণা দিলাম এবং বুঝিয়ে বললাম, তার বাবার ক্যান্সার হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই শরীরের বিভিন্ন অংশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসার জন্য একজন ক্যান্সারের ডাক্তারের কাছে পাঠাচ্ছি, তবে অবস্থা খুব ভাল বলা যাচ্ছে না। তার চিকিৎসার সম্ভাব্য ফলাফলও খুব আশাপ্রদ নয়। উপরের ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য হলো, চিকিৎসকরা শুধু রোগের উপশম করা এবং রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে মাত্র, জীবন মৃত্যুর ফয়সালা তাদের হাতে নেই। কোন রোগী মারা যাক, তা কোন চিকিৎসকেরই কাম্য নয়। তবু শোকার্ত হৃদয়ে তাকে অনেকের মৃত্যুই মেনে নিতে হয়। এটাই জগতের নিয়ম। চিকিৎসক হিসেবে এ আমাদের করুণ সীমাবদ্ধতা। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?’ চিকিৎসক মৃত্যুর চিকিৎসা করতে পারে না, রোগের চিকিৎসা করে মাত্র। অনেক রোগও নিরাময়যোগ্য নয়। মানুষ তো মারা যাবেই, চিকিৎসক নিজেও অমর নয়। এটাই নির্মম বাস্তবতা। রোগীর মৃত্যু হলে স্বাভাবিকভাবেই স্বজনেরা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। অনেক সময় ডাক্তারদের সীমাবদ্ধতা, রোগীকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সদিচ্ছা তাদের চোখে পড়ে না। অভিযোগ একটাই, ভুল চিকিৎসা, তা না হলে রোগী মরবে কেন? ফলশ্রুতিতে শুরু হয় হাসপাতাল, ক্লিনিক ভাংচুর, ডাক্তার, নার্স এবং কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ। এটা গল্পসাহিত্য বা সিনেমার কোন অনুষঙ্গ নয়, বরং হরহামেশাই ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ চিত্র। এসব ঘটনাগুলো আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা আমরা খোলা চোখে দেখি না। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবেগ বর্জিত দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে চোখ রাখি, তাহলে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং রোগের ধরন বিবেচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল না, রোগটির কারণেই মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্তু রোগী মারা গেলেই চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন। আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, কর্মরত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতালের উপর তাৎক্ষণিকভাবে চড়াও হচ্ছে রোগীর লোকজন। এমনকি যথাযথ কারণ অনুসন্ধান ছাড়াই কিছু কিছু গণমাধ্যম ভুল চিকিৎসা বা ভুল ওষুধ দেয়ার অভিযোগ এনে সংবাদ প্রকাশ করছে। একইভাবে ‘ভুল চিকিৎসার’ অভিযোগে বিনা তদন্তে চিকিৎসককে গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে। আস্থাহীন উত্তেজিত জনতা, কিছু গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতা ও ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতারের ভয়-এ ত্রিমুখী চাপে চিকিৎসকরা অনেকটাই বিপর্যস্ত। অধিকাংশ চিকিৎসকদের মাঝেই চাপা ক্ষোভ এবং নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। বড় বড় শহরসহ জেলা উপজেলা পর্যায়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের অবস্থাটা আরও ভয়াবহ। রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, ভয়াবহ পরিণতির মধ্যে পড়তে হবে, তা ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দায়িত্ব এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। ফলে রোগীদের ভোগান্তি যে কতটা বাড়তে পারে, তা ভেবে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। বাংলাদেশে প্রতি ২০৩৯ জনের জন্য মাত্র একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। তার উপর যদি চিকিৎসকদের জন্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা না যায়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ এবং জটিলতর হয়ে উঠবে। তাই জনস্বার্থেই চিকিৎসক এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে হামলা বন্ধে স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসক নির্যাতন এবং হাসপাতালে হামলা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং সারাবিশ্বেই একটি গুরুতর সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘৮% থেকে ৩৮ চিকিৎসা সেবাকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন’। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিভিন্ন দেশ প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, এমনকি কঠিন আইনও প্রণয়ন করেছে। এ অবস্থা প্রতিরোধকল্পে অন্যান্য দেশে নেয়া প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে, বাংলাদেশেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নিজস্ব আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা অতি জরুরী। ভারতে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা অনুযায়ী, ‘প্রতি ৪ জন চিকিৎসকের ৩ জন অন্তত একবার রোগীর স্বজন কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন’। ২০০৮ সাল থেকে ভারতের মোট ১৮ প্রদেশে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন পাস হয়েছে, যেখানে চিকিৎসক এবং হাসপাতালে হামলা একটি অজামিনযোগ্য অপরাধ। হামলাকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল এবং ৫০ হাজার রুপী জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিছু প্রদেশে আক্রান্ত হাসপাতালের ক্ষতির দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্প্রতি চিকিৎসককে চড় মারার অপরাধে একজন এমপিকে নিম্ন আদালত ৩ বছরের জেল ও জরিমানার শাস্তি দেয়। দেশটির হাইকোর্ট রায়টি বহাল রাখে। ‘ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনা হলেই চিকিৎসককে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার নয়’- ভারতের সুপ্রীমকোর্ট এ সম্পর্কিত একাধিক নির্দেশনা দিয়েছে ২০০৫ ও ২০০৯ সালে। চিকিৎসক এবং হাসপাতালে বারবার হামলার প্রেক্ষিতে উড়িষ্যার স্বাস্থ্য সচিব সকল টারশিয়ারি এবং জেলা হাসপাতালে পুলিশ পোস্ট স্থাপন এবং বিদ্যমান সুরক্ষা আইন অনুযায়ী পুলিশ যেন মামলা করে- এই নির্দেশনা দিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ভারতে তবুও চিকিৎসক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কেবল মহারাষ্ট্রেই গত ১২ থেকে ১৯ মার্চ ৬টি ঘটনায় ৮ চিকিৎসক গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রতিবাদে মুম্বাই, দিল্লীসহ সরকারী-বেসরকারী ৪০ হাজার চিকিৎসক একযোগে ৫ দিন কর্মবিরতি পালন করে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সংসদে বিদ্যমান আইনে হামলাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছরের স্থলে ৭ বছর করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান। মুম্বাইয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে ৪ হাসপাতালে প্রায় ৪০০ সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে চিকিৎসা সেবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং হাসপাতালে হামলা ‘ফেলোনি’ বা গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্টেট ভেদে সর্বোচ্চ শাস্তি বিভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। মিসিসিপিতে ৩০ বছরের জেল ও জরিমানা, মনটানাতে জেল ও ৫০ হাজার ডলার জরিমানার বিধান রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবায় সহিংসতা এড়াতে ক্যালিফোর্নিয়া ১৯৯৩ সালে ‘হসপিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স অন ভায়োলেন্স এগেইন্সট হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার’ স্থাপন করা হয়। ‘দ্য অকুপেশনাল সেফটি এ্যান্ড হেলথ এডমিন্সট্রেশন’ নিরাপদ কর্মপরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে একটি নতুন নীতি কার্যকর করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভিক্টোরিয়ার বক্সহিল হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জন কর্মস্থলে হামলার শিকার হন গত মে মাসে। ২০১৮ সালে কুইন্সল্যান্ডের ‘সেফ নাইট আউট স্ট্র্যাটেজি’র আওতায় চিকিৎসক এবং হাসপাতালে হামলার ঘটনায় দোষীদের ১৪ বছরের জেল দেয়া হয়। চীনে চিকিৎসক এবং হাসপাতালে হামলা এতটাই প্রচলিত যে, অভিধানে নতুন একটি চাইনিজ শব্দ ‘ইয়েনাও, যার অর্থ চিকিৎসায় অরাজকতা’ যুক্ত হয়েছে। প্রতিবছর হাসপাতালে গড়ে ২৭.৩টি হামলা হয়েছে। ২০০৭ সালে ‘নিরাপদ হাসপাতাল ক্যাম্পেন’ শুরু হয়। চিকিৎসাকর্মীদের জন্য হেলমেট, এন্টিস্ট্যাব ভেস্টের ব্যবস্থা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চীনের ১১টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ হাসপাতালের প্রতি ২০ বেডের বিপরীতে একজন নিরাপত্তারক্ষী, স্বাস্থ্যকর্মীর অন্তত ৩% এর বেশি সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ, সিকিউরিটি এ্যালার্ম এবং সিসিটিভি স্থাপনসহ বিভিন্ন সুপারিশ করে। ২০১২ সালে ৭ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী কর্মস্থলে নিহত হন, ২০১৩ সালে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ রোগী দেখা অবস্থায় খুন হন। ২০১৪ সালে সুপ্রীমকোর্ট, বিচার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কমিশন নতুন গাইডলাইন প্রণয়ন করে, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে দু’জন হামলাকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ১৯৯৯ সালে স্বাস্থ্য খাতে হামলা রোধে ‘জিরো টলারেন্স জোন ক্যাম্পেন’ চালু করে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে এনএইচএস ‘সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস’ নামে পৃথক বিভাগ খোলে। এর আওতায় যে কোন সহিংসতা কর্তৃপক্ষকে জানানো, তদন্ত, পুলিশ এবং বিচারিক কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, স্বাস্থ্যকর্মীদের সব ধরনের সহায়তা এবং সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার নিশ্চিত করা হয়। প্রয়োজনে রোগীকে লিখিত সতর্কতা বা ইয়েলো কার্ড, গুরুতর ব্যবস্থা হিসেবে রেড কার্ড এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস এ্যান্ড ইমিগ্রেশন এ্যাক্ট, ২০০৮’ এর আওতায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে বাধা প্রদানে ১০০০ পাউন্ড জরিমানার পাশাপাশি রোগীর আত্মীয়স্বজন যারা চিকিৎসা প্রদানে বিঘœ ঘটায়, তাদের হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য করার ক্ষমতা এনএইচএসকে দেয়া হয়। এছাড়াও বেশকিছু আইন ‘হেলথ এ্যান্ড সেফটি এট ওয়ার্ক ইটিসি এ্যাক্ট ১৯৭৪’, ‘হেলথ এ্যাক্ট ১৯৯৯’, ‘ম্যানেজমেন্ট অফ হেলথ এ্যান্ড সেফটি এট ওয়ার্ক রেগুলেশন, ১৯৯৯’ কার্যকর আছে। স্কটল্যান্ডে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ‘দ্য ইমার্জেন্সি ওয়ার্কার এ্যাক্ট ২০০৫‘ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ৯ মাসের জেল এবং ৫ হাজার পাউন্ড জরিমানার বিধান আছে। নেপাল স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য ২০১০ সালে আইন পাস করে এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা সমন্বয় কমিটি প্রবর্তন করে। এই কমিটি কোন প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার জন্য স্থায়ী নিরাপত্তাকর্মীর সুপারিশ করলে সরকার কর্তৃক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন ভঙ্গকারীর সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল এবং ৩ লাখ রুপী জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় রাষ্ট্র বাদী হয়ে আইনগত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল সীমাবদ্ধতার মাঝে চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার। চিকিৎসকের পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব হলো নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ অফ রেডক্রসের ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘ভায়োলেন্স এগেইন্সট হেলথ কেয়ার: পার্ট ওয়ান’-এ যে পদক্ষেপ আবশ্যক বলা হয়েছে তা হলো, যেকোন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা চালিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত একটি পরিপূর্ণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ আইনগত কাঠামো। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষায় নির্দিষ্ট আইনের এখনও ঘাটতি আছে। সরকারের উচিত চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সেবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মীদের নিরাপত্তায় যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। একথা মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না, আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হয়। আবার অপ্রিয় হলেও সত্য, শুধু আইন দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করা যায় না। চিকিৎসক ও নীতি নির্ধারকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ভাল চিকিৎসক তৈরি না হলে, ভাল সেবা আশা করা যায় না। প্রশাসনকে তাই ভাল চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়গুলো দূর করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মেডিক্যাল কলেজগুলোও অরাজকতার বাইরে নেই। ভাল চিকিৎসক তৈরির অনেক অন্তরায় রয়েছে যেমন, যত্রতত্র মেডিক্যাল কলেজের ছড়াছড়ি, মানসম্মত মেডিক্যাল কলেজের অভাব, মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের শর্ত পূরণ না করেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, কিছু কিছু প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে মেধার বিকাশের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেয়া। এসবের ফলে সুষ্ঠু পড়াশোনার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে আর চিকিৎসা শিক্ষার মান হচ্ছে নিম্নমুখী। শিক্ষক সঙ্কট, দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা, ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষকের পদ না থাকা বা শূন্য থাকা ও সহযোগী লোকবলের অভাব, দলীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাব বলয় সবকিছুই যোগ্য চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়। অনেক মেডিক্যাল কলেজে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্কিল ল্যাব, লাইব্রেরি, অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা না থাকা এবং হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগীর অভাবে হাতে কলমে বাস্তব ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। সেকেলে শিক্ষাক্রম, কারিকুলামের দুর্বলতাও বিরাজমান। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাসের হার বেশি হলেও শিক্ষার মান নিম্নমুখী। এর প্রভাব পড়ছে মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও। ভাল ডাক্তার তৈরির অন্তরায়গুলো দূর করার লক্ষ্যে প্রশাসনকে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, ভাল শিক্ষক ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। ডাক্তারদের শুধু মেডিক্যাল শিক্ষার বাইরেও রোগী এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে আচার আচরণ কিভাবে করতে হয়, সে শিক্ষার ব্যবস্থা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র মেডিক্যাল কলেজ খোলার বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চিকিৎসকদেরকেও মনে রাখতে হবে, রোগীর আস্থা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। দক্ষতা ও পেশাগত আচরণে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সম্পর্কিত চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে, অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি রোগীর আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। রোগীদের অসুবিধা ও অভিযোগগুলো ধৈর্য সহকারে শোনা, অসুখের ধরন এবং চিকিৎসার সম্ভাব্য বিকল্পগুলো ও চিকিৎসার প্রত্যাশিত ফলাফলগুলো তাদের জানানো, নিরাময়যোগ্য নয় এ রকম রোগ সম্পর্কে রোগী বা তার স্বজনকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সহমর্মী আচরণ করতে হবে। চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আরও দক্ষতা অর্জন করতে মেডিক্যাল শিক্ষা কারিকুলামে যথাযথভাবে কাউন্সেলিং এর কোর্স বাধ্যতামূলক করা উচিত। কনফুসিয়াসের কাছে তার এক শিষ্য জানতে চাইল, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক উপাদানগুলো কি কি?’ জবাবে কনফুসিয়াস বলেন, ‘খাদ্য, নিরাপত্তা এবং জনগণের আস্থা অর্জন’। শিষ্য পুনরায় জানতে চাইল, ‘দুর্যোগ মুহূর্তে জরুরী প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে যদি কোন কিছু উৎসর্গ করতে হয়, তবে সেটি কি?’ কনফুসিয়াস উত্তরে বলেন, ‘খাদ্য বা নিরাপত্তা যদি বিসর্জন দিতেও হয়, তবুও জনগণের আস্থা যেন কখনও না হারায়।’ রোগী, চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মী সবার মাঝে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই। সরকারের উচিত ডাক্তার এবং চিকিৎসা সেবা সংশ্লিষ্ট অন্যদের নিরাপত্তায় যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। চিকিৎসক, সন্ত্রাসী, ভাংচুরকারী, রোগীর আত্মীয় স্বজন, যিনিই দোষী সাব্যস্ত হবেন, তার যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা নাহলে চিকিৎসক স্বাধীনভাবে চিকিৎসা দিতে ভয় পাবে, জনগণের আস্থা আরও হারাবে, জনগণ আরও বিদেশমুখী হবে, স্বাস্থ্য খাতের অর্জিত সাফল্যগুলো ভূলুণ্ঠিত হবে। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×