ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

শেখ হাসিনা ॥ মানবতাবাদী রাষ্ট্রনেতা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৭ জুন ২০১৭

শেখ হাসিনা ॥ মানবতাবাদী রাষ্ট্রনেতা

একজন রাষ্ট্র নেতাকে অবশ্যই মানবতাবাদী হতে হয়। মানবতাবাদী রাষ্ট্র নেতাই সাহসী হন দূরদর্শী হন। মানুষের প্রতি মমত্ববোধকে তিনি তার দায়িত্ব মনে করেন বলেই রাষ্ট্রের গরিব-দুঃখী মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সকল মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হন। একটি রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা এগিয়ে নেয়ার জন্য একজন মানুষের আগমন জরুরী। বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পেয়েছিল বলেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বাধীনতা ঘরে এসেছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এসেছেন বলেই বাংলাদেশ আজ মানে-সম্মানে-সম্পদে এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব তার কাছে বড় নয়, রাষ্ট্র ও জনগণের নেতৃত্বই বড় কথা। আগেই বলেছি একজন রাষ্ট্র নেতা মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সাহসী হন। শেখ হাসিনার জীবননাশের জন্য ২০ বার হামলা, গ্রেনেড হামলাগুলো চালানো হয়েছে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে আছেন, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন অকুতোভয়ে। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে। তিনি বিচলিত হননি বরং সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে চলেছেন। ১৯৯৭ ও ৯৮ সালের বন্যা; বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়া বিএনপি-জামাতের সরকারের রেখে যাওয়া খাদ্য ঘাটতি; বিদ্যুত ঘাটতি; বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু নির্মাণে হাওয়ার ওপর দুর্নীতি আবিষ্কারের চক্রান্ত এবং অর্থায়ন বন্ধ করা; এবং সাম্প্রতিকালে হাওড়ে অতি বর্ষণজনিত বন্যায় ধান-মাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং তা কাটতে না কাটতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক নাগরিকদের জীবনহানি; এ সবকে অতীতে যেমন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন, এখনো করছেন এবং আমাদের বিশ্বাস এ সঙ্কট উত্তরণে সকল হবেন। কারণ তিনি মানবতাবাদী রাষ্ট্র নেতা। প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে প্রায় ২৫ লাখ টন ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সরকারও সঙ্গে সঙ্গে চাল আমদানি শুরু করে দিয়েছে । মানবতাবাদী শেখ হাসিনার কয়েকটি কার্যক্রমের উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করব। কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার একটি বহুতল ভবন আগুনে পুড়ে শতাধিক বাসিন্দার মর্মান্তিক মৃত্যু ও সহস্রাধিক কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর মধ্যেও তিনটি তরুণী বেঁচে যায়। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অসহায় চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। খাবার নেই, আশ্রয় নেই, সহায়-সম্বল বলতে কিছু নেই। বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাও অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকে মুহ্যমান না হয়ে, কি করে আবার আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় তার সবই করলেন। এখানেই থেমে থাকেননি। অসহায় তিনকন্যাকে দত্তক নিলেন, অর্থাৎ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিশ্চিত করলেন, তাদের বিয়ে দিলেন, জামাইদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন- একদম নিজের কন্যার মতো তাদের আজও দেখাশোনা করছেন। তিন কন্যাও ঈদে-চাঁদে স্বামী সন্তান নিয়ে তাদের মায়ের বাড়ি বেড়াতে আসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তারা সুখের সংসার করছেন। আমরা অনেকেই এই মানবিক মানুষটিকে জানি। বিশেষ করে তিন কন্যার দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি সংবেদনশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূলত যারা এই মহীয়সী নারীকে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম শেখ ফজিলতুন্নেসা মুজিব শেখ হাসিনাসহ পুরো পরিবারটিকে জানেন তারা আমার সঙ্গে একমত হবেন মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, অসহায়ের প্রতি সংবেদনশীলতা শেখ পরিবারের ঐতিহ্য। আমরা শেখ হাসিনার কাছে শুনেছি একবার দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয় (সম্ভবত পঞ্চাশের মনন্তর)। তরুণ শেখ মুজিব নিজেদের ধানের গোলা কেটে প্রতিবেশী দরিদ্র অসহায়ের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছিলেন। সেই বাবারই কন্যা শেখ হাসিনা। জেনারেল এরশাদের সরকারের সময় একবার শেখ হাসিনা উত্তরবঙ্গে সাংগঠনিক সফরে বেরিয়েছেন। এক হাইওয়ে দিয়ে তার গাড়ি চলছে। পথপার্শ্ব থেকে এক তরুণী হাত তুলল, শেখ হাসিনা গাড়ি থামালেন এবং কারণ জানতে চাইলেন। তরুণী জানাল সে বিএ পরীক্ষার্থী এবং ওই দিনের পরীক্ষার শুরু হতে আর বেশি সময় নেই। সে একটি বাসও ধরতে পারেনি। সে জানাল এই বাস করে যাতায়াত করে লেখাপড়া করছে। শেখ হাসিনা তাকে গাড়িতে তুলে নিলেন এবং পরীক্ষার হলে নামিয়ে নিজের গন্তব্যে রওনা হলেন। এখানেই শেষ নয়। খোঁজ রাখলেন কবে তরুণীর পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষা শেষে সেই তরুণীর বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। পাত্র ছাত্রলীগের এক নেতা। সর্বোপরি যে মানবিকতার খবর আমরা রাখি না। তা হল ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট যখন ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা- ঘটানো হয় ধানম-ির ঐতিহাসিক বাসভবনে, তখন শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামী প্রখ্যাত অনুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার কাছে জার্মানিতে বেড়াতে যান। ড. ওয়াজেদ তখন জার্মানিতে গবেষণারত ছিলেন। দুই বোন এ জন্যে প্রাণে বেঁচে যান। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, তারা দুই বোন বাড়িটি জনসাধারণের জন্য দান করে দেন। এমনকি টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও। এই বাড়ি এখন বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এই ট্রাস্ট প্রায় দুই দশক ধরে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত গরিব-মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই বৃত্তি নিয়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ডিগ্রী নিয়ে বিসিএস ক্যাডার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন বা এই পরিবারটিকে যারা জানেন তারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে মানবতাবাদী মানুষ আরও খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু একজন শেখ মুজিবুর রহমান একজন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব একজন শেখ হাসিনা একেবারেই আলাদা, অতুলনীয়। তাই তো দেখি মাতৃত্বের মমতায় তিনি এতিম শিশুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, পরম শ্রদ্ধায় অশিতিপর বৃদ্ধাকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছেন, অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মেইন স্ট্রিমে টেনে তোলার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছেন, আমাদের জাতীয় বাজেটে তাদের জন্যে আলাদা বরাদ্দ রাখছেন, যেমন বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, ঈদ পার্বণে তাদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন-আশ্রয়হীনের জন্য ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন, কাজ দিচ্ছেন। একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাজেটে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা উল্লিখিত সামাজিক খাতে বরাদ্দ দেন, যা মূল বরাদ্দের অতিরিক্ত। তিনি এতই দূরদর্শী যে সঙ্গে সঙ্গে দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করেন। ফলে শহরের বিত্তবান মানুষ গ্রামে যেতে শুরু করে, শহরের টাকা গ্রামে রেখে ফেরে। এভাবে শহরের টাকা গ্রামে যাবার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবনে প্রাণচাঞ্চল্য সঞ্চারিত হতে হতে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। গ্রামের মানুষও এখন খালি পায়ে হাটে না, পোশাকে আশাকে পরিপাটি, মেয়েরা ইউনিফরম পরে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, বলা যায় অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের পেছনে ফেলে মেয়েরা এগিয়ে চলেছে বিস্ময়করভাবে। এবার হাওড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন ধান উৎপাদন কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে থেকে চাল আমদানির জন্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং গত সোমবারের কেবিনেট সভায় ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যাতে করে রাষ্ট্রীয় গুদামে মজুদ কমে যায় এবং কোন রকম খাদ্যাভাব না হয়। এখানেই রাষ্ট্র নেতা শেখ হাসিনা অনন্য এবং অদ্বিতীয়। ১৯৭৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার চক্রান্তে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়। সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে দেশীয় কিছু গোষ্ঠীও চক্রান্তে লিপ্ত হয়। একজন ফটোগ্রাফারের সাজানো জালপরা বাসন্তির দুর্গতির ছবি একটি পত্রিকায় ছাপা হয়, যা নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধু সরকার এবং এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও নেতিবাচক প্রপাগ-া করতে থাকে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনা সেই বাসন্তীকে দেখতে যান রংপুরের চিলমারিতে। শেখ হাসিনা বাসন্তীর সব ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও বাসন্তী এবং চিলমারী এলাকাকে ভোলেননি। সেখানে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মীদের এমন কাজে লাগান যে, আজ ‘মঙ্গা’ ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দই জনজীবন থেকে উঠে গেছে। এখন কেবল ডিকশোনারিতেই শব্দ দুটি পাওয়া যাবে, অন্য কোথাও নয়। শেখ হাসিনার মানবিক মূলবোধের কারণেই তিনি যেমন দেশের গরিব অসহায় জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে সচেষ্ট একই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি দৃঢ়, দূরদর্শী এবং আপোসহীন। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, বড় বড় রাষ্ট্র যখন জঙ্গীবাদ উৎপাটনে গলদগর্ম, হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের শেকড় উৎপাটন করতে পুরোপুরি সফল না হলেও আশ্চর্যজনকভাবে অনেকটাই দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। তাদের একটার পর একটা আস্তানা ধ্বংস করে চলেছেন। এ কথা আজ বিশ্ববাসী সকলেই স্বীকার করছেন। বরং বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাংলাদেশের উদাহরণ নিচ্ছে। শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স কেবল দমন নয়, ওদের ভিতশুদ্ধ কাঁপিয়ে দিয়েছে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধই তাকে এতখানি সাহসী করে তুলেছে। ধমনীতে বইছে জাতির পিতার রক্ত, যে রক্ত অন্যায় জানে না আপোসকামীতা জানে না, জনগণের প্রশ্নে থাকেন অবিচল। লেখাটা শেষ করছি দেশের একজন বিশিষ্ট ছড়াকার ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের একটি ছড়া দিয়ে : পিতার মতোই দুঃখীর লাগি সকল ভালবাসা এতিম শিশু দুঃখ না পাক তোমার প্রত্যাশা। সবার লাগি দুঃখটা পাও তাই তো কাঁদে মন পিতার মতোই সকল শিশু তোমার আপনজন ঢাকা ॥ ১৫ জুন ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×