ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমি কবিতায় পাঠকদের স্বস্তি না দিয়ে বরং এর বিপরীতটা দিতে চাই-হেনরী কোল

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৬ জুন ২০১৭

আমি কবিতায় পাঠকদের স্বস্তি না দিয়ে বরং এর বিপরীতটা দিতে চাই-হেনরী কোল

প্রখ্যাত কবি হেনরী কোলের জন্ম ১৯৫৬ সালে, জাপানে। জন্ম জাপানে হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে। হেনরী কোলের মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে চরবৎপব ঃযব ঝশরহ : ঝবষবপঃবফ চড়বসং বিশ^জুড়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। তাঁর লেখা বেশির ভাগ কবিতাগু জার্মান, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনূদৃত হয়েছে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কোল ‘লেনর মার্শাল পোয়েট্রি পুরস্কার’, ‘দ্য কিংসলে টুফট্স পোয়েট্রি এ্যাওয়ার্ড’, ‘দ্য রোম প্রাইজ’, ‘জ্যাকসন পোয়েট্রি পুরস্কার’ ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। হেনরী কোল দ্য নিউ রিপাবলিক পত্রিকায় ২০১০ থেকে ১০১৪ সাল পর্যন্ত কবিতা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। ২০১৪ সালে দ্য প্যারিস রিভিউতে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন এই বরেণ্য কবি। তাঁর সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন শাসা উইস। সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছেন আদিত্য শংকর। আপনি বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন যে আপনি নিজেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবি হিসেবে দেখেন না, কিন্তু একজন আত্মজৈবনিক কবি হিসেবে দেখেন। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? আপনি তো জীবনের অনেক ঘটনা আপনার অনেক কাব্যে ব্যবহার করেছেন। হেনরী কোল : নান্দনিক মর্যাদা ছাড়া একটি স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা অনেকটা ডায়েরির মতো হয়ে যায়। কিন্তু আমি যখন লেখালিখি করি তখন আমি কেবল আমার জীবনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করে আনন্দ পাই না। বরং আমার আনন্দ আসে ভাষাকে যথার্থ শিল্পে পরিণত করার মাধ্যমে এবং শিল্প সৃষ্টির অবিরাম অনুপ্রেরণার থেকে। আমার মনে হয় আপনার কবিতাগুলো আমাদের নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রণা এবং বেদনার কাছে নিয়ে যায়। এবং আমাদের সেই যন্ত্রণা ও বেদনাভূমিতেই ফেলে আসে। হেনরী কোল : সীমিত অর্থে ও নীতিগতভাবে আমি মনে করি কবিতা আমাদের অবশ্যই স্বস্তি দেবে এবং কোনটা ভাল তা দেখিয়ে দেবে। এটি যে সবসময়ই শিল্পের কার্যকলাপ হবে সেটা অবশ্য আমি মনে করি না। যে কোন ক্ষেত্রে আবেগধর্মী, নৈতিক কবিতা আমি লিখতে চাই না। আমি আমার কবিতায় পাঠকদের স্বস্তি না দিয়ে বরং এর বিপরীতটা দিতে চাই। একটি গীতি কবিতা কিছুক্ষণের জন্য ব্যক্তিকে নিজস্বতার প্রতিলিপি হিসেবে উপস্থাপন করে। আমার কাছে এটি সবসময় বেসুরো বোঝায়। এ সত্ত্বেও কবি হিসেবে কোন নৈতিক দায়িত্ব কি আপনি অনুভব করেন? হেনরী কোল : লেখার সময় আমি কোন নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করি না। তবে যে সকল কবিগণ নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করেন তাদের আমি প্রশংসা করি। যেমন, সিমাস হিনি। তিনি মনে করেন, লেখালিখিই অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারে। কলেজে থাকতেই কি আপনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন? হেনরী কোল : কলেজ অফ উইলিয়াম এ্যান্ড মেরিতে আমার জুনিয়র এবং সিনিয়র বছরগুলোতে কবিতা-লেখার ক্লাস করেছিলাম। আমার কোন মেধা ছিল না, কিন্তু আমার মধ্যে প্রবলতা ছিল এবং আমার শিক্ষকরা আমাকে তৈরি করেছিলেন। আপনার প্রথম শিক্ষক কারা ছিলেন? হেনরী কোল : সুসান থমসন ছিলেন আমার প্রথম লেখার শিক্ষক। তিনি এবং তার পার্টনার বেটি, যে অন্ধ ছিল, তারা আমার প্রতি খুব ¯েœহপ্রবণ ছিলেন। প্রায়ই তারা তাদের বাসায় আসার আমন্ত্রণ করতেন। আমি ছেলেবেলায় তাদের মতো এমন কাউকে দেখিনি। এছাড়াও আমি প্রফেসর এলসা ন্যাটেলসের সঙ্গে কোনার্ড, জেমস এবং উল্ফের উপন্যাস পড়তাম। ভাষা যে আন্তঃজীবনের একটা সূক্ষ্ম যন্ত্র তা এ শিক্ষকই আমাকে প্রথম দেখিয়েছেন। আপনি তো কলাম্বিয়া গিয়েছিলেন। হেনরী কোল : হ্যঁঁ। সে জায়গাটার জীবনযাত্রা ছিল ব্যয়বহুল ও কঠিন প্রতিযোগিতাময়। কিন্তু আমি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। স্ট্যানলি কুনিজ ও ড্যানিয়েল হাল্পেন আমাকে থিসিস পড়িয়েছেন। আমরা ভয় পেতাম জোসেফ ব্রডস্কিকে নিয়ে, যিনি সেমিনার টেবিলে সিগারেটের ফিল্টার ছুড়ে মারতেন; ড্রেক ওয়ালকোটÑ যিনি আমাদের হুইটম্যান ও রিচার্ড হাওয়ার্ডের কবিতা মুখস্থ করার জন্য তাড়া দিতেন। আবার তিনি এলিজাবেথ বিশপের চমৎকার একটা কবিতা দিয়ে পুরো ক্লাস কাটিয়ে দিতেন। আমার শিক্ষক হাওয়ার্ডই আমাকে ঘনিষ্ঠ পাঠক হতে শিখিয়েছেন। আমি লিটারেরি ক্রিটিক ডেভিড কালস্টোনের ক্লাস করেছিলাম যা আমার লেখালেখির জন্য সহায়ক ছিল। সেখানে আমি প্রথমবারের মতো জ্যারেল, মেরিল এবং রিচ্ পড়েছিলাম। এটা আমার নিজস্ব সমন্বয়ের জন্য নান্দনিকবিদ্যার শ্রেণীবিন্যাস ছিল। আপনার বয়স যখন চল্লিশের মধ্যে ছিল তখন আপনি গরফফষব ঊধৎঃয– কাব্যগ্রন্থের জন্য কবিতা লিখলেন। যেখানে মনে হচ্ছিল আপনার লেখার ধরন পরিবর্তিত হয়েছিল। আপনার কি অভিমত? হেনরী কোল : জাপানের সর্বদক্ষিণে কায়ুসু দ্বীপে আমার জন্ম। আর সেখানে আমি আমার জীবনের প্রথম বছরটা কাটিয়েছিলাম। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে আমি আবার সেখানে গেলাম। কিয়োটার পশ্চিমে পাদদেশে দুটো তাতামি-ম্যাট রুমে, একটি জাপানিজ বিছানা, একটি ওক (জাপানিজ বোল বাটি), একটি ল্যাপটপ, এবং আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে থাকতাম। আমার জন্য এটাই ছিল পশ্চিমাবিশ্ব থেকে সব থেকে দূর বসবাস করা। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে অন্য রকম লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ওই জায়গায় আমি একমাত্র শ্বেতাঙ্গ এবং আমি সম্পূর্ণ একলা বাস করতাম। সেখানকার পরিবেশটা অবিশ্বাস্য। যেখানে পাহাড়ী জীবন নাগরিক জীবনকে ছুঁইয়ে যায়। তার উপর সেখানে বড় বড় পোকামাকড় ছিল, যেমন প্রেয়িং ম্যান্টিস। আমি লিখেছিলামÑ আমার বালিশের নিচে একটা প্রেয়িং ম্যান্টিস দেখেছিলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ’তুমি কার জন্য প্রার্থনা করও?’ তুমি কি প্রার্থনা করতে পারবে আমার পিতার আত্মার জন্য, তারপর আমার মাতার জন্য? একাকিত্বের কারণে সব কিছুই যেন আমার কাছে তীব্র এবং অতিরঞ্জিত লাগত। রোমে থাকার সময়ের মতো আমি আবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কোন রকমের কবিতা আমি লিখতে পারব? আমেরিকান ভ্রমণপিপাসু কবিদের মতো আমি তান্কা ও হাইকু লিখতে পারতাম, কিন্তু আমি সেটা করতে চাইনি। তাই বই পড়ে আমি অনেকগুলো সপ্তাহ পার করলাম। তারপর আমি ঠিক করলাম, মুক্ত ছন্দে সনেট লেখা এবং তাদের মধ্যে জাপানিজ কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য আনার চেষ্টা করলাম। কবিতায় অসংখ্য উপমার ব্যবহার, ভেতরের অবস্থান সুন্দর করার জন্য প্রকৃতির উপস্থিতিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলাম। কবিতায় এসব পরিবর্তন করেছি। আমার প্রথম কবিতাগুলো মিনিমালিস্ট ধরনের লিখেছিলাম। কবিতাগুলো নিখাদ তৃপ্তিতে লিখতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক গভীরে চলে গিয়েছিলাম। যখন দেখতামÑধানক্ষেতগুলোতে চারা রোপণ করা হয়েছে এবং সেখানে সুখী ব্যাঙগুলো সারারাত কথা বলছে। আবার এসব পরিবেশই আমার ঘুমের সঙ্গী হতো। এটা অদ্ভুত লাগত। এবং ধীরে ধীরে, আমি এটা নিয়ে লিখলাম। শেষ পর্যন্ত সেই সব কবিতাগুলো একত্রে গরফফষব ঊধৎঃয হয়ে গেল। যত দূর জানি, আপনার বাবা বই পড়তেন। তাঁর বইপড়াই কি আপনাকে পাঠক হতে সাহায্য করেছিল? হেনরী কোল : আমার মনে হয়, আমার বাবা টের পেয়েছিলেন যে তিনি তার স্বপ্ন থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি চাননিÑ আমি যেন আমার স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলি। বাবা মনে করতেন, পথভ্রষ্ট না হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে বই পড়া। আমি দেখতাম তিনি সবসময় শান্তভাবে সোফাতে বসে পড়তেন। এভাবেই সময়ের সঙ্গে বাবাকে বন্দী করে আমি তাঁকে দেখি। আমিও বইপড়ায় আকৃষ্ট হই। অন্যদিকে আমার মা পার্থিব মানুষ ছিলেন এবং বাগান করতে ভালবাসতেন। হাঁটু গেড়ে তিনি আগাছা নিড়ানি দিতেন, ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করতেন এবং চারা রোপণ করতেন এভাবেই আমি তাকে দেখি। আপনি জীবনের শুরুর দিককার চাকরির ঘটনাগুলো কেমন ছিল? হেনরী কোল : আমার বাবার মতোই আমার ভাইয়েরা মিলিটারিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছিলেন। আবার আমি যাদের চিনতাম তাদের সবারই গ্র্যাজুয়েশনের পরে ওয়াশিংটনে সরকারী অথবা রিগস ন্যাশনাল ব্যাংক অথবা রিয়েল এস্টেটে চাকরি করার পরিকল্পনা ছিল। আমি এগুলো কিছুই করতে পারিনি। কলেজে থাকতে আমার অনেক পার্ট টাইম জব ছিল, ফুল ডেলিভারি ছিল এর একটা। আমার পার্টটাইম চাকরিগুলো আমাকে ভিন্নভাবে বেড়ে ওঠতে সাহায্য করেছিলো। আমি অনেক শেষকৃত্যের বাসায় এমন অনেক কিছু দেখেছি যা আগে দেখি নাই। প্রথমে সেখানে ফুলেল ব্যবস্থার অপরূপ সৌন্দর্য ছিল আর সেটার সুমিষ্ট সুবাস ভ্যানটাকে ভরে রাখত। আমি যেসব কবরস্থানে যেতাম সেখানে দুঃখভাক্রান্ত মৃতদেহ ছিল। আমার মনে পড়ে, আমি একবার এক কালো নারীর খোলা কফিনের পায়ের নিচে পুষ্পার্ঘ্য দেখেছিলাম। এটি আমাকে অনেক আলোড়িত করে। সেই সময়টার কথা চিন্তা করলে মনে হয় সেটা আমার জীবনের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি অকৃত্রিম ঘটনা ছিল। ‘ইমর্টাল’ কবিতাটি আপনার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে এবং আপনি তাকে দেখতে চাচ্ছিলেন নাÑ সেই বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে। কিভাবে আপনি একদম শেষে এ রকম সিদ্ধান্তে আসলেন? হেনরী কোল : আমি আমার মায়ের শেষকৃত্য নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। তবে এমন স্পষ্টভাবে চাইনি। ‘ডেড মাদার’ নামে আরও একটি কবিতা আছে আমার, যেখানে আমি এমন করেছিলাম। তুমি কি জান এ্যালেন গিনসবার্গ তার মায়ের জন্য ‘কধফফরংয’ নামে শোক কবিতা লিখেছিলেন? আমার কবিতাগুলো এত নিয়ন্ত্রিত, প্রভাবিত এবং চাপানো যে আমি তার মতো পরিসীমামুক্ত ও ডায়োনোসিয়ান হতে চাই। মাকে নিয়েই আমি বেশি লিখেছি। আমার কবিতায় কিছু বিষয়ের মিশ্রণ আছে। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে মায়ের আসল শেষ কৃত্যানুষ্ঠান।
×