ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শমশের সৈয়দ

তোয়াব খান ॥ সাংবাদিকতায় কালের অভিযাত্রী

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৬ জুন ২০১৭

তোয়াব খান ॥ সাংবাদিকতায় কালের অভিযাত্রী

ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর সদ্য প্রকাশিত একটি গ্রন্থের নাম ‘তোয়াব খান সাংবাদিকতায় কালের অভিযাত্রী’। শিরোনামই বলে দেয় এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য কী এবং এর নায়ক কে?....আসলে এ দেশে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে হাতেগোনা যে ক’জন স্মরণীয়-বরণীয় সংবাদ-ব্যক্তিত্ব আমাদের, বিশেষ করে মিডিয়াকর্মীদের কাছে আইডল বা মহীরূহ হয়ে আছেন, প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তোয়াব খান এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি এ দেশের সংবাদপত্র জগতে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তির পাশাপাশি স্বাধীনতার পর কর্মক্ষেত্রের সুবাদে এই দেশটির মহান স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বক্ষণিক সাহচর্য পান। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন এ দেশের স্বাধীনতাউত্তরকালীন অনেক ইতিবাচক এবং নেতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সেই ১৯৭৫ সালের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও যাঁর সঙ্গে সর্বশেষ টেলিফোনে কথা বলেছেন...সম্ভবত সেই ব্যক্তিটি এই তোয়াব খান। একমাত্র তিনিই জানেন, সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর শেষ কথাটি কী ছিল...? এতেই বোঝা যায়, তোয়াব খান এ দেশের আর দশজন সম্মানিত, বিখ্যাত, প্রখ্যাত বা বিশিষ্ট সাংবাদিকের মতোই শুধু নন, এদের বাইরেও তিনি আরও আলাদা কিছু বা ভিন্ন কেউ একজন। কারণ তিনি স্বাধীনতাউত্তরকালে বঙ্গভবনে অচেনা ঘাতকদের আনাগোনা, বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা ছিলেন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কুশীলব তাদের আচার-আচরণ এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পূর্বাপর অনেক ঘটনার সাক্ষী। আর তাই অন্যদের চেয়ে এখানেই তোয়াব খান সম্পূর্ণ ভিন্নতর একজন মানুষ। এভাবেই এ দেশের সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির যুগপৎ মেলবন্ধন ঘটেছে তোয়াব খানের মধ্যে। যার ফলে তোয়াব খান দিনে দিনে এ জগতে হয়ে উঠেছেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি...। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক নিজেও একজন সাংবাদিক। এখানে তার বিষদ পরিচয় উল্লেখ না করে শুধু এটুকুই বলছি, যেটুকু একান্তই উল্লেখের দাবি রাখেÑমোয়াজ্জেমুল হক ১৯৯৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মসূত্রে তোয়াব খানের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই থেকে আজ অবধি তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত আছেন এবং দৈনন্দিন কাজের সুযোগে বিগত বছরগুলোতে তিনি তোয়াব খানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। পেশাগত কারণে প্রতিদিনই এমনকি দিনে একাধিকবারও রিপোর্ট নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে থাকেন মোয়াজ্জেমুল হক। তোয়াব খান তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে সংবাদপত্র জগতে নানামুখী সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, যা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করার নয়।....পাঠযোগ্য ফলোআপ সংবাদ, আকর্ষণীয় ফিচার তৈরি এবং সংবাদ উপস্থাপনা ও পত্রিকার অঙ্গসজ্জার ক্ষেত্রে তাঁর মুন্সিয়ানার জুড়ি নেই। এছাড়া, সংবাদের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিয়ে এ দেশে সাংবাদিকতা পেশাকে তিনি করেছেন ঋদ্ধ। যেমনÑ তোয়াব খান মনে করেন, ‘সত্য উদ্ঘাটন, সত্যের বিকাশ এবং সত্য প্রকাশÑ এটাই সাংবাদিকতার শেষ কথা। সিন্ডিকেটেড নিউজ পেশাদারিত্বের সর্বনাশ ঘটায়...।’ এমনি নানাবিধ বিষয়ের আদ্যপান্ত লেখক সুন্দরভাবে উপরোক্ত শিরোনামযুক্ত বইটিতে প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন। চলতি বছর ২৪ এপ্রিল ২০১৭ তোয়াব খান ৮৪ বছরে পদার্পণ করেছেন। এই বয়সেও তিনি একজন কাজপাগল কর্মব্যস্ত পেশাদার সম্পাদক হিসেবে সবার কাছে সুপরিচিত। এ প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। তিনি এখনও প্রতিদিন দু’বার নিয়মিত অফিস করেনÑযা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয় বিষয়। অন্যদিকে, তোয়াব খান আজীবন প্রচারবিমুখ একজন সাংবাদিক। তবু তাঁর জীবনের সমস্ত খ্যাতি ও যশ নিজের অনিচ্ছাতেই যেন খুশবুর মতো বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাই, সত্য যে কখনও চাপা থাকে না তারই জ্বলন্ত প্রমাণ আলোচ্য গ্রন্থ, যার মধ্যে তোয়াব খানের দীর্ঘ জীবনের অনেক না বলা কথা এবং এ দেশের ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন লেখক। বিলম্বে হলেও জীবনের দীর্ঘ পথচলার স্বীকৃতিস্বরূপ জনাব তোয়াব খান সাংবাদিকতায় একুশে পদকসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর সবকিছু দুর্লভ চিত্রসহ বিস্তারিত বিবৃত হয়েছে লেখকের এই বইটিতে। বইটি আমাকে বিস্মিত করেছে এ কারণে যে, এটি আমি পুরোটা পাঠ না করলে একজন পেশাদার সাংবাদিক হয়ে এবং দীর্ঘ ২২ বছর তাঁরই অধীনে কাজ করেও তোয়াব খান আমার কাছে অসম্পূর্ণ, অজানা থেকে যেত অনেকাংশেই! বইটির বিজ্ঞ লেখক আমারই সিনিয়র সহকর্মী মোয়াজ্জেমুল হকের তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং তাঁর প্রখর ধীশক্তি আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছে। এটি পাঠ করে আমি লেখক সম্পর্কেও যথাযথ বুঝতে সক্ষম হয়েছি। বইটি আমাকে তাকেও জানতে সহায়তা করেছে। কারণ, আলোচ্য বটবৃক্ষ তোয়াব খান আর তিনি একই অফিসে কাজ করলেও তাদের অবস্থানগত দূরত্ব ঢাকা-চট্টগ্রাম। আর আমার সঙ্গে দূরত্ব স্রেফ পায়ে হাঁটা দেড়-দু’মিনিটের পথ। আমাদের দেখা ও কথা দুটোই হয় প্রতিদিন। অথচ, তোয়াব ভাইয়ের বিশেষত্ব এবং গুণাবলীর অনেক কিছুই আমার ক্ষুদ্র মাথা ছাপিয়ে গেছে অবলীলায়...অথচ এসব মোয়াজ্জেম ভাইয়ের মগজে ঠিকই ধরা পড়েছে। এ জন্য তিনি আমার কাছে বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। আসলে তোয়াব ভাই সংবাদপত্র জগতের এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সম্মান ও শ্রদ্ধায় এমনিতেই অনেকের মাথা নত হয়ে আসে। তাঁর বকুনিটাও যেন অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় থাকে...তাই, শুনতেও ভাল লাগে। আর এ কারণেই বোধহয় সেই ১৯৯৫ সালে তাঁর মাধ্যমে জনকণ্ঠে এসে আজও তাঁরই সঙ্গে কাজ করে যেতে পারছি...এ আমার জীবনের পরম অহঙ্কার এবং অনন্য অভিজ্ঞতা। আশা করি, আমার সঙ্গে এ প্রশ্নে অনেকেই সহমত হবেন। সম্ভবত এমনতর হার্দিক অনুভূতিই মোয়াজ্জেমুল হককেও এই বই লিখতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। তোয়াব খান এ দেশের সাংবাদিকতার জগতে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরও বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটি তাঁর একান্ত নিজস্ব অর্জন। কেউ তাকে এমনি এমনি এই অভিধায় অভিহিত করেননি।...সময় আর নিষ্ঠা তাঁকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কারণ, ইবাদতের মতো একাগ্র চিত্তে অবিরাম কাজ, কাজ আর কাজই তাঁকে আজ এই মুকুটহীন সম্রাটের আসনে বসিয়েছে। তাই এই বটবৃক্ষ এ যাবতকাল এতটাই পত্রপল্লব আর অজস্র শাখা-প্রশাখায় ব্যাপকভাবে বিস্তারিত যে তাঁর ছায়াতলে থেকে তাঁরই শিষ্য-শাবুদগণ নিজেদের যে যার মতো করে সমৃদ্ধ করেছেন বটে কিন্তু রয়ে গেছেন বনসাই হয়ে। বহু গুণে গুণান্বিত তোয়াব খানের কর্মজীবন তাই বর্ণাঢ্য ও কাব্যময়। আর এ কারণে লেখক ছোট ছোট উপশিরোনামে সংক্ষিপ্ত আকারে তোয়াব খানকে বোদ্ধা পাঠক-গবেষক, বর্তমানে পেশায় কর্মরত নবীন এবং অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। সেই ছেলেবেলা থেকেই প্রগতিশীল চেতনার উন্মেষ ঘটে তোয়াব খানের মধ্যে। ক্রমবিকাশমান সেই ধারায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, ওয়েজবোর্ড গঠন ইত্যাদির পাশাপাশি সমকালীন প্রগতিশীল রাজনীতির চিন্তা-চেতনা তাঁর মধ্যে জেঁকে বসতে শুরু করে। তার ওপর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিকমনা প্রগতিশীল সমাজের পাঠকপ্রিয় পত্রিকা বলে বিবেচিত দৈনিক সংবাদে যোগাদান তাঁর মধ্যকার লালিত চেতনা আরও বেগবান হয়। এরপর আর তিনি থেমে থাকেননি। এসবের কিছুটা তোয়াব খানের জবানীতেই প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছর (২০১৭) দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়। সংবাদ থেকেই তিনি চলে আসেন দৈনিক পাকিস্তানে। সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় কাজ করেও একাত্তরের উত্তাল মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তিনি সুকৌশলে সাহসী সাংবাদিকতায় নিজেকে সংযুক্ত করেছেন অবলীলায়। শিহরণ জাগানো একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলোর চিত্র ফুটে উঠেছে বইটির কোন এক উপশিরোনামে। এরপরই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তাঁর রচিত এবং স্বকণ্ঠে প্রচারিত হতো ‘পিন্ডির প্রলাপ’... এমনি আরও নানা কত কী! এছাড়া এই বইতে আরও স্থান পেয়েছেÑ জাতির পিতার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা, আগস্ট ষড়যন্ত্রের আগমুহূর্তের সেই রহস্যময় গুলশান ডিনারবিষয়ক কথকতা, বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর ঘটনা, দেশ ও জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু যা বলে গেছেন..., প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে কাজ, ৩০ বছর আগে সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রদত্ত ভাষণ, দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদককে নিয়ে শেষ পারানির কড়ি ইত্যাদি। উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তোয়াব খান তাঁর পেশাগত জীবনের দীর্ঘতম সময় কাটাচ্ছেন বর্তমান কর্মস্থল দৈনিক জনকণ্ঠে। এর মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (এম এ খান মাসুদ)। তাঁর সম্পাদনায় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তোয়াব খানের গতিশীল দক্ষ নেতৃত্বে দেশের প্রথম চাররঙা পত্রিকা এটি। বিভিন্ন মত ও পথের নবীন-প্রবীণ একঝাঁক সংবাদকর্মী নিয়ে একযোগে দেশের পাঁচ জেলা থেকে প্রকাশ করে এই পত্রিকার মাধ্যমে তোয়াব খান দেশে আধুনিক সাংবাদিকতার প্রচার ও প্রসার ঘটান, যা আজ অনেকের কাছে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। এমনি নানাবিধ কারণে আমি মনে করি, মোয়াজ্জেমুল হক রচিত আলোচ্য বইটি শুধু একজন গণমাধ্যমকর্মী বা পেশাদার সাংবাদিকই নন, বিদ্যোৎসাহী এবং সংবাদপত্র তথা মিডিয়া জগত সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে আগ্রহী এমন যে কারও সংগ্রহ করে পাঠ করা উচিত। কারণ, তরুণ আঁকিয়ে সোহেল আশরাফ খানের সুন্দর প্রচ্ছদ সংবলিত এই বইটি যে কোন পাঠাগার/লাইব্রেরি এবং নিজ ঘরে সংগ্রহে রাখার মতো। শুধু তাই নয়, গ্লোসি পেপারে অসংখ্য দুর্লভ ঐতিহাসিক রঙিন ছবি সংবলিত, উন্নত অফসেট কাগজ ও শক্ত বাঁধাইয়ে দৃষ্টিনন্দন এবং মানসম্মত একটি গ্রন্থ এটি। বইটি প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের আবির প্রকাশন। প্রকাশক মুহম্মদ নূরুল আবসার। মূল্য ৫০০ টাকা। বিদেশে ১০ মার্কিন ডলার।
×