ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ চিত্তরঞ্জন দাশ

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৬ জুন ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) এ যাত্রায় হেলসিংকির সর্বশেষ দর্শনীয় বিষয় মার্কেট স্কয়ার পরিদর্শন শেষ করলাম চমৎকার একটা ভূরিভোজনের মাধ্যমে। মাত্র চার ঘণ্টা অবস্থানে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা উচিত নয় সম্ভবও ছিল না। তবে একটা বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, যারা এখানে আনন্দ ভ্রমণে আসবেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি যে, হেলসিংকি সিটি ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সারা বছরই মার্কেট স্কয়ার থেকে ব্যালটিক সাগরের মাঝে অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ ঝড়ঁসবহষরহহধ তে নিয়মিত ফেরি চলাচল রক্ষা করে চলেছেন। যদিও গ্রীষ্মকালে আরও অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ঝড়ঁসবহষরহহধ সহ এর প্রতিবেশী দ্বীপগুলোতে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকেন। আসলে জনবসতিপূর্ণ ৬টি সুরক্ষিত দ্বীপ (Kustaanmiekka, Susisaari, Iso-Mustasaari, Pikku-Mustasaari, Lansi-Mustasaari and Langoren) যেগুলো বর্তমানে হেলসিংকি শহরেরই অন্তর্ভুক্ত। আর এই দ্বীপগুলোকে ইউনেসকো ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। সময়ের অভাবে অতীব সুন্দর এই দ্বীপগুলো ভ্রমণের আকাক্সক্ষা পূরণ করা গেল না। শুধু সাক্ষী হয়ে রইলাম এই যাত্রায় তাদের, যে সকল সৌভাগ্যবান ভ্রমণবিলাসীরা সেখানে ফেরিতে করে যাচ্ছেন এবং যারা ভ্রমণ শেষে তীরে এসে তরী ভিড়াচ্ছে তাদের। আর কোনদিন হেলসিংকি আসার সুযোগ বা সৌভাগ্য হবে কিনা জানি না তবে এই মার্কেটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের কথা বলে আমাদের ফিরতি যাত্রার প্রস্তুতি নিতে হবে। হাতে আর খুব বেশি নেই যদিও আমরা টারমিনাল থেকে খুব বেশি দূরে নই। স্প্রিং থেকে অটাম নানন উৎসবে মেতে থাকে এই মার্কেট। ভে-াররা টাটকা খাদ্যদ্রব্য নিয়েই যে ব্যস্ত সময় কাটায় তা নয়, টাটকা ফল-মূল, চা কফির সরজ্ঞমেরও কোন অভাব নেই। মাংসের পেট্রিস হলো এই মার্কেটের বিশেষ সুস্বাদু খাবার। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে হেরিং উৎসব বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। যে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বহু বছর বন্ধ থাকার পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে পুনরায় চালু করা হয়। এই উৎসবে বিভিন্ন দ্বীপ থেকে মৎস্য শিকারিরা নৌকায় বসে নানা প্রজাতির সামদ্রিক মাছ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। যাই হোক এই স্বল্প পরিসরে যা কিছু দেখলাম যা কিছু স্মৃতির পটে আঁকা হলো তা সারা জীবন বয়ে বেড়ানো যাবে। তারই সামান্য কিছু সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলাম। তাতে যেমন নিজের অভিজ্ঞতার ভা-ারের অংশবিশেষ সংযোজিত হলো তেমনি সমৃদ্ধশালার ভা-ারও পূর্ণ করতে সহায়কের ভূমিকা রাখবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বাড়তে থাকে, আর কমতে থাকে আয়ু। জন্মের পর থেকেই আয়ুটা কমতে থাকে অন্য সবকিছুই বাড়তে থাকে। এ যেন এদেশের ক্রেডিট হিস্ট্রি বা ক্রিমিনাল রেকর্ড চেক করার মতো বিষয়। যিনি যত বেশিদিন এসব দেশে অবস্থান করবেন তার ততবেশি ঝামেলা বা সুবিধা। ঝামেলা হলো কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারা বা ডিফল্টার হওয়া এবং এটা যত দীর্ঘায়িত হবে ঝামেলা ততটাই বেশি হবে। অন্যদিকে ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারলে এই ইতিহাস যত দীর্ঘ ততটাই সুবিধা। ক্রিমিনাল রেকর্ডের ক্ষেত্রেও একই বিষয়, অর্থাৎ বেশিদিন অবস্থানের ফলে রেকর্ডটাও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তেমনিভাবে যত দীর্ঘদিন এই ধরাধামে অবস্থানের সুযোগ থাকবে, ভালমন্দ মিলে অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও তত বেশি পরিপূর্ণ হবে। তবে প্রচেষ্টা থাকবে যেন ভাল কাজে অভিজ্ঞতার ভা-ারটাকে সমৃদ্ধ করা যায়। সবকিছুর পর এইটাই প্রার্থনা যেন সুস্থ সবল দেহ ছাড়া অন্যের গলগ্রহে বেঁচে থাকতে না হয়। এবার বিদায়ের পালা। ইতোমধ্যে সকলেই একত্রিত হয়েছি। আস্তে ধীরে অপেক্ষমাণ জাহাজের দিকে এগিয়ে চলেছি আর ভাবছি ক্ষণিক অবস্থানে প্রাপ্তিটা নেহাৎ কম হল না। আরও বেশি সময় থাকতে পারলে নিশ্চয় আরও অনেক কিছু অর্জন করা যেত। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই সব সময় সব ধরনের সুযোগ পাওয়া যাবে না। যা পেলাম সেটাও বা কম কিসে। আমাদের এই একটা সমস্যা, অল্পতে খুশি থাকতে পারি না। এবারে এমন কিছু কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় স্থান বিশেষ করে পর্যটকদের দৃষ্টিকোণ থেকে মিস করলাম যে, মন খারাপ একটু হতেই পারে। যখন এতটাই কাছে এসে শেষ পর্যন্ত আর তাদের দর্শন লাভ কপালে জুটল না তখন মন খারাপ না করে আর যাই কোথায়। ফিনল্যান্ডে এমন অনেক কিছুই আছে যে সবের দর্শন লাভে তৃপ্ত না হওয়ার কোন কারণ নেই। তবে আমার আগ্রহ অধিক মাত্রায় প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর। যার মধ্যে অন্যতম নর্দান লাইট। মানুষের জীবনে এমন সুযোগ একবারই আসতে পারে যাকে স্মরণীয় করে রাখা যেতে পারে। সম্ভাবত ফিনল্যান্ড হলো বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখান থেকে এই উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি আকাশের বক্ষ ভেদ করে ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করে। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে উত্তরের শহর খধঢ়ষধহফ হলো সব থেকে উত্তম স্থান এই আলোর দ্যুতি দর্শনের। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঞযব অৎপযরঢ়বষধমড় ঘধঃরড়হধষ চধৎশ, ঞঁৎশঁ শহরের খুব কাছেই এই পার্ক। এই দ্বীপপুজ্ঞে মিশ্র সংস্কৃতির একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফিনিস, রাশিয়া এবং সুইডিস এই তিন দেশের মিশ্রণে একটা সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হয়েছে। আসলে ফিনল্যান্ডের প্রত্যেকটা দ্বীপই ভূস্বর্গ। এই সব দ্বীপে আসলে মনে হবে যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। এখানে আকাশ আর সাগর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শান্ত নির্মল বায়ুপ্রবাহ, সাগরের স্বাভাবিক নীরবতা, যথেষ্টসংখ্যক মানব সন্তানের অনুপিস্থিতি যেন প্রকৃতির মন্দিরে অর্চনা করার এক অপূর্ব পরিবেশ। প্রকৃতপক্ষে সাগর বক্ষের ছোট বড় প্রত্যেকটা দ্বীপের একটা অন্যরকম সৌন্দর্য সদা বিরাজমান। সুযোগ পাওয়া গেলে ফিনল্যান্ডের ঔঁৎসড়, ঘড়ঃড়, টঃড়, অংঢ়ড়, ধহফ ঐড়ঁঃংশধৎ দ্বীপ গুলো একবার হলেও দর্শন করা যেতে পারে। প্রিয় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একটি বিষয় প্রকাশ করা আবশ্যক যে, এই সকল পর্যটক আকর্ষণীয় পীঠস্থানে ভ্রমণের আনন্দটা উপভোগ করার সৌভাগ্য এ যাত্রায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি তবে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে সকল উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেল সেগুলো সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করলাম এই চিন্তা করে যে যারা ফিনল্যান্ডে আসবেন তারা যেন উৎসাহিত হন বর্ণিত স্থানগুলো ভ্রমণে এই লেখাটা পড়ে। এমনই একটি পুরনো দক্ষিণের শহর ঞঁৎশঁ যে শহর এক সময় ফিনল্যান্ডের রাজধানীও ছিল। এখানে প্রতিবেশী দেশ সুইডেন থেকে প্রচুর পর্যটকদের আগমন ঘটে এবং এখানকার জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ সুইডিস ভাষায় কথা বলে। তেমনি আরও একটি শহর হলো ঞধসঢ়বৎব, যে শহর সারা ফিনল্যান্ডবাসীর অত্যন্ত পছন্দের। শিল্প বণিকদের আবাস ভূমি নামে খ্যাত এই শহর ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয়। বর্তমান ফিনল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম শহর এটি। নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য, বিশেষ করে ওপেন ইয়ার থিয়েটার, বিভিন্ন প্রকারের উৎসব এবং জনপ্রিয় খেলাধুলার কারণে ঞধসঢ়বৎব ফিনল্যান্ডের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আসলে ফিনল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল যতটা না ভূমি তার থেকে অধিক পরিমাণ লেক, জলাশয়, সাগর মিলে এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যার কারণে অধিকসংখ্যক ভ্রমণবিলাসীদের আগমন ঘটে এই পূর্বাঞ্চলের জলাশয় গুলোতে। ফিরতি যাত্রা দেখতে দেখতে সময়টা পেরিয়ে গেল। এদিকে বিদায় নেয়ার সময় সমাগত। যাত্রীরা এক এক করে সবাই ফিরে আসছে ফেরিটারমিনালের দিকে। আমরা কিছুটা আগেই জাহাজে চড়ে বসেছি। এখন ডেকে পায়চারী করা আর চারদিকের উন্মুক্ত আকাশ, চ্যানেল পেরিয়ে দিগন্ত প্রসারিত জলরাশি দেখার অবকাশে ভেঁপুর গগনবিদারী শব্দের মাধ্যমে সকল যাত্রীদের অবগত করা হলো এখনই নোঙর তোলা হবে। নোঙর তোলা হলো। বিশাল আকৃতির জাহাজ খানি একটা ঝাকুনি দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। এখন স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা। চারদিকে সূর্যের প্রখর আলোকরস্মি গাছপালা, বাড়িঘর, সাগরের মোহনা, জলরাশি সবকিছুকে আলোকিত করে রেখেছে। ইউরোপে এখন গ্রীষ্মকাল, তাই সূর্য ডুবতে কম করে হলেও পাঁচ ঘণ্টা বাকি। সুতরাং আরও অনেকটা সময় দিনের আলোয় সমুদ্র দেখতে দেখতে পাড়ি দেয়া যাবে অনেকটা দূর। এমনকি প্রকৃতি সহায় থাকলে সাগর বক্ষের সূর্যাস্ত দেখাটাও কপালে জুটে যেতে পারে। স্কটহোম থেকে হেলসিংকি আসার সময় সাগরের মাঝ খানে বসে ভোরের সূর্য উদয় দেখার প্রবল আগ্রহটা অন্তরেই বিলীন হয়ে গেল, সকালে যথা সময়ে ঘুম না ভাঙার করণে। সে রাতে অবশ্য ধকলটা কম যায়নি। তাই আজকের সূর্যাস্তটা কোন প্রকারে মিস করা যাবে না। হেলসিংকি ফেরিটারমিনাল থেকে গভীর সমুদ্রের দুরুত্বটা খুব বেশি নয়। এই চ্যানেলটা খুব বেশি হলে মাইল খানেক হতে পারে। তবে সৌন্দর্যের বিচারে কোন অংশে কম নয়। ইতোমধ্যে আমরা দোহে মিলে বারো তলা এই প্রমোদ তরীর একেবারে উপরের ডেকের সামনে মাস্তুলের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চারদিকের ছোট ছোট দ্বীপগুলোর বক্ষ ভেদ করে নির্মাণ করা বিলাসী ভিলা, তাকে ঘিরে থাকা বৃক্ষকুল, হারবারে চলন্ত বোট, ভাইকিংয়ের বিশাল আকৃতির তরীখানিসহ দৃশ্যান্তর দেখতে দেখতে পাড়ি জমালাম গভীর সমুদ্রে। পেছনে ফেলে আসলাম ক্ষণিকের স্মৃতি বিজড়িত হেলসিংকির নান্দনিক সব দৃশ্যাবলী। হে বন্ধু বিদায়। চিনে রেখ মোরে, আবার যদি কখনও ফিরে আসি তোমার দুয়ারে, সেদিন সাদরে গ্রহণ করও আমারে। চলবে...
×