ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নয়নাভিরাম রামসাগর

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৬ জুন ২০১৭

নয়নাভিরাম রামসাগর

বেলা গড়ানোর আগেই কান্তজিউর মন্দির থেকে দিনাজপুর শহরে ফিরি। গাড়িতে ফেরার সময় শরীরে একটু ক্লান্তি অনুভব করি কিন্তু মনটার ভেতর ছিল তৃপ্তির পরশ। আহা! ওই রূপ যেন কিছুতেই ভোলার নয়। কেউ যখন নতুন জায়গায় যায় আর সেই জায়গা যদি হয়, বহুদিনের কল্পনার স্বপ্নেরপুরী, তবে নিশ্চই মনের কল্পরাজ্যে সেই স্বপ্নপুরীর একটা স্বপ্ননিল চিত্র অবশ্যই সবাই আঁকে। আমিও এঁকেছিলাম কল্পনার সব রং দিয়ে কান্তজিউর মন্দিরের ভীষণ শোভা। সত্যটা ছিল কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবার মতোই। ভাবতে ভাবতে ২টা ত্রিশ মিনিটের দিকে বাসস্ট্যান্ডে নামি। এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। চা খেতে খেতে ভাবতে থাকি, আবার কবে আসি। ছোটবেলায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা আর এক স্বপ্নপুরী রাম সাগর জাতীয় উদ্যান, কোনভাবেই মিস করা যাবে না। চা খেয়ে উঠে রিক্সা ঠিক করলাম, শহরের টেম্পোস্ট্যান্ডে। একটা গাদানো টেম্পোর যাত্রী হয়ে রওনা করলাম রাম সাগরের উদ্দেশ্যে। আমি অবশ্য ওঠার আগেই বলেছিলাম জায়গাটা আমি চিনি না দয়া করে ঠিক ঠাক নামিয়ে দেবেন। প্রায় পঁচিশ মিনিট যাত্রার পার খানপুরে উদ্যান গেটে আমাকে নামিয়ে দিল। সামনেই বড় গেট, তাতে বড় করে লেখা রাম সাগর জাতীয় উদ্যান। গেটের দু-পাশে মাঝারি ছোট বেশ কয়েকটা দোকান সবই অবশ্য খাবারের। পানির তৃষ্ণা ভীষণভাবে অনুভব করলাম। দেড় লিটার বোতলের একটি ঠা-া পানি কিনলাম তারপর পাঁচ টাকা দিয়ে উদ্যানে প্রবেশের টিকেট কাটলাম। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা ভীষণভাবে কাজ করছে, অবশেষে আমি রামসাগর পাড়ে! ঢুকতেই অনেক রিক্সা দাঁড়িয়ে, একজন বলল, অনেক বড় এলাকা হেঁটে দেখলে কষ্ট হবে। সবাই রিক্সায় চড়ে ঘুরে। বিষয়টা আমিও ক্ষাণিক ভাবালাম, মন্দ হয় না। এর মধ্যে দেখলাম এক দম্পতি রিক্সা ভাড়া করে উদ্যানে প্রবেশ করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম পুরোটা ঘুরে দেখতে কত টাকা দিতে হবে। ষাট টাকা। এত কেন? রিক্সাওয়ালা বলল ভাড়া রেট করা, দেখেন সবাই এই ভাড়াতেই উদ্যানে ঘুরে। আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম রিক্সায়। বেলা তখন ৩ টা ত্রিশ। রিক্সায় বসে ঠা- পানির বোতলের মুখে যখন চুমক দিলাম তখন গেট পেরিয়ে মাত্র মূল উদ্যানের অভিমুখে। ফাগুনের উদাস করা বাতাস সঙ্গে রোদের মিষ্টি পরশ, চোখের সামনে সমুদ্র তুল্য দীঘি! মন চাইছিল এই ইহ জাগতিক সব মিথ্যা মায়া কাটিয়ে এমন অপরূপ প্রকৃতির অংশ হয়ে যেতে। খুব আস্তে রিক্সা চালাতে বললাম। রিক্সা চলছে ধীরে ধীরে। আমার চোখ দুটি অসহায়ের মতো চারদিক কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। খাবেই বা না কেন, যে দিক তাকাই প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর রূপ আর রূপ। ছোটবেলায় বইতে পড়েছি, বাংলাদেশ পৃথিবীর সব থেকে বড় বদ্বীপ। বদ্বীপ কাকে বলে? প্রশ্ন করেছি ক্লাসের স্যারকে, উত্তরে স্যার, যার মাঝখানে পানি চারদিকে ভূমি। তাকেই বদ্বীপ বলে, ভাল বুঝলাম না, মনের কল্পনাতেও আসল না। বড় হয়ে ঠিক কল্পনাতে আঁকতে পেরেছিলাম। যখন রিক্সায় বসে বড় আকৃতির মাটির টিলা দিয়ে ঘেরা উদ্যানটি দেখছিলাম আর বিশাল বিশাল বৃক্ষের দিকে মাথা উঁচু করে তাকাছিলাম তখনই আমার মনে এবং চোখে বদ্বীপের বাস্তব রূপ ধরা পড়ল। হ্যাঁ। একেই বলে বদ্বীপ। কিছু দূর যাবার পর একটা ছোট বাংলো তার পাশেই একটা ছোট চিড়িয়াখানা বলা ঠিক হবে না তারপরও চিড়িয়াখানা। রিক্সা থেকে নেমে কাছে গিয়ে দেখলাম দুই জাতের হরিণ, বানর আর কি কি জাতের কয়েকটা স্থানীয় প্রাণী। ফিরে এসে আবার যাত্রা শুরু। একটু সামনে একটা প্রাচীন পাথরের ঘাট। আমি রিক্সা চালকে বললাম, আমি এখানে একটু বসব। স্যার, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছ্,ে আর একটা খেপ মারবার চাইছিলাম। রাম সাগরের রূপে ডুবে গিয়ে বললাম, সময় দেও টাকা বাড়িয়ে দেব। ও শান্ত হয়ে ঘাটের কাছে থামল আমি রিক্সা থেকে নেমে ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসে পুরো দীঘিটা একবারে অবলোকন করলাম। চোখ দুটো এই প্রথম শান্ত হয়ে কেবল দীঘিতেই মুদে গেল। আহা এত রূপ কেন প্রকৃতিতে। চাইলেও তো মনের মধ্যে এর কানাকড়ি ধারণ করতে পারি না। ফাগুনের বাতাসে দীঘির জল তির তির করে ঢেঊ খেলছে, পাড়ে নিশ্চিন্তে গরু , ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে, চারপাশে উঁচু টিলা তার ওপর গাছের সারি। মনে হচ্ছিল আমি কোন রূপ কথার গল্পের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। এ সব দেখে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যাই সবুজ আর নীলের মধ্যে, এই বুঝি মানব জীবনের পরম স্বাদ। ঘড়িতে তখন পৌনে পাঁচটা এবার উঠতে হয়। রিক্সা চালক ঘাটের ওপরের সিঁড়িতে বসে বিড়ি ফুকছিল। দাঁড়িয়ে বললাম চলো যাওয়া যাক। যখন শেষ বিকেলে দীঘির পাড় দিয়ে চলছিলাম তখন মানুষের ভিড় খুব একটা চোখে পড়ার মতো ছিল না তবে, দীঘির দক্ষিণ কোণে যেখানে অনেকটা খোলা জায়গা সেখানে বেশ সংখ্যক দর্শনাথী দেখতে পেলাম। দেখে মনে হলো এরা স্থানীয় । অবশেষে রিক্সায় ঘুরতে ঘরতে পৌঁছে গেলাম গেটের কাছে। গেট থেকে বেরিয়ে, ভাড়া চুকিয়ে রওনা হলাম শহরের উদ্দেশে। রামসাগরের ঐতিহাসিক পটভূমি দিনাজপুরের আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে রামসাগর জাতীয় উদ্যান। উদ্যানের ভেতর দীঘিটির খননকাল ১৭৫০-১৭৫৫ সাল অর্থাৎ দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় লেগেছিল এই দীঘি খননে। এ অঞ্চলে তখন প্রচ- খরা আর দুর্ভিক্ষ চলছিল। প্রজাদের সেচ সুবিধা, জলের অভাব দূরীকরণ আর খাদ্যাভাব পূরণের জন্য রাজা রামনাথ এ দীঘি খনন করেন এবং নিজের নামে নামকরণ করেন। জনশ্রুতি আছে, দীঘি খননে রাজার ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। প্রায় ২৭ হেক্টর জায়গায় অবস্থিত রামসাগর জাতীয় উদ্যান। এর জলভাগের দৈর্ঘ্য ১০৩১ মিটার আর প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। দীঘির উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে ছোট ছোট ঘাট আছে। শীতের শুরুতে প্রচুর অতিথি পাখি আসে এছাড়া সারাবছর বিভিন্ন দেশী প্রজাতির পাখি থাকে। যাওয়ার বন্দোবস্ত ঢাকার মহাখালী ও শ্যামলী থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে প্রতিদিন নাবিল, হানিফ, শ্যামলী ইত্যাদি পরিবহন যায়। ভাড়া ৫০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত। দিনাজপুর শহরের মালদাহ পট্টিতে সাধারণ মানের হোটেল পাওয়া যাবে, এ সব হোটেলের ভাড়া ২০০-৬০০ টাকার মধ্যে। হোটেল ডায়মন্ড, হোটেল আল রশিদ, হোটেল নবীন, হোটেল রেহানা বিশেষ করে মালদাহ পট্টি, নিমতলা এই হোটেলগুলোর অবস্থান।
×