ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গারো নারীদের ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৬ জুন ২০১৭

গারো নারীদের ক্ষমতায়ন

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড়ে অতি আদিম নৃ-গোষ্ঠী গারোদের অবস্থান। গারো উপজাতির একটি বিশেষ পরিচিতি আজও সবাইকে বিস্ময়ের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হয় সেটা হলো এখনও তারা মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে রেখেছেন। আদিম অর্থনীতিতে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারই ছিল সমাজের আদি এবং অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে, বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রায়, মানব জাতির চিন্তাশক্তির উৎকর্ষতায় সভ্যতা বিবর্জিত বন্যদশার ছিটেফোঁটা অবশেষও আজ পৃথিবীর কোথায়ও তেমন দেখা যায় না। এর বিশদ বিবরণ আছে ব্রিটিশ নৃ-বিজ্ঞান লুইস হেনরি মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ বইটিতে তেমনি আরও পরিচ্ছন্নভাবে আছে এঙ্গেলসের বিখ্যাত বই ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইটিতে। মর্গান এবং এঞ্জেলস দুজনই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করতে পেরেছেন সভ্য যুগের সূচনাপর্বের বহু আগেই মানুষের যে অতি প্রাচীন বন্যদশা তার স্থায়ীকাল ছিল সব থেকে বেশি। সভ্যসূর্যের আলোকরশ্মি দেখতে তাই আদিম গুহাবাসী মানুষকে লক্ষাধিক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই লক্ষ্যাধিক বছরের অতি আদিম বন্যদশায় নারীরা কেমন ছিল আজকের সভ্য নারীদের তুলনায়? মর্গানের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এঞ্জেলস পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশের পর্যায়গুলোতে। পরিবার বলতে তখন ছিল অবাধ স্বেচ্ছচার যার সুশৃঙ্খল কোন গতিই ছিল না। কিন্তু একটি বিশেষ জায়গায় নারীর ক্ষমতায়ন ছিল অসীম যেখানে পুরুষের কোন প্রবেশাধিকারই ছিল না। সামাজিক বিজ্ঞানীরা যাকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। অবাধ স্বেচ্ছাচারে পিতৃত্বের কোন স্বীকৃতিই ছিল না। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে মাকেই চেনা যেত সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে। ফলে সন্তান থেকে আরম্ভ করে সম্পত্তির মালিকানাসহ বংশপঞ্জি নির্ধারণ সব কিছুরই একচ্ছত্র অধিপতি ছিল ওই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা। নারীর অধিকার, স্বাধীনতা এবং ক্ষমতায়ন ছিল সর্বোচ্চ আসনে। কিন্তু দলগত বিবাহ এবং পরবর্তীতে একক পরিবার সভ্যতার বীজ বপন করলেও সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতির ক্ষমতার সিংহভাগই খর্ব করে দেয়। পিতৃত্বের স্বীকৃতি যখন অনিবার্য হলো একক পারিবারিক কাঠামোতে তখন নারীরাও নিজেদের সর্বময় কর্তৃত্ব হারাতে বসে। সে অধিকার ও স্বাধীনতা নারীরা এই সভ্য যুগেও আর কখনও ফিরে পায়নি। এঙ্গেলসের সেই বিখ্যাত বাণীÑ‘সম্পত্তির মালিকানা এবং একক পরিবারের ভিত্তিই নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়।’ সভ্যতার এই সুবর্ণ সময়ে নারীর ক্ষমতায়নের নানা টানাটানাপোড়েনে গারো উপজাতি আজও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে তাদের সর্বময় ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব টিকিয়ে রেখে এখনও সেই সাবেকি আদিম ব্যবস্থায় শক্ত অবস্থানে। কিন্তু আধুনিকতার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিজেদের আয়ত্তে এনে গারো নারীরা আজ সমাজ এবং পরিবারে গাঢ়ভাবে নিজের অধিকার এবং কর্তৃত্বকে পুরোদমে বজায় রেখেছে। গারো উপজাতিরা সিংহভাগই ক্যাথলিক খ্রীস্টানের অনুগামী। শিক্ষিতের সংখ্যা প্রায় ৮০%। অর্থনীতিতে সেই সাবেকি চাষাবাদ ব্যবস্থা বহাল থাকলেও আধুনিক শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও তারা কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। নিজের সন্তানকে আঁচলে পেঁচিয়ে গারো নারীরা যেভাবে কৃষিকাজে নিজেদের ব্যাপৃত রাখে একইভাবে শিক্ষকতা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পেশায়ও তাদের যুক্ত রাখে সন্তানকে সেই আঁচলে ঘিরে রেখেই। আর পরিবার তো সেই আদিম ব্যবস্থায় নারী কর্তৃত্বের আধার। এখনও সম্পত্তি এবং বংশপঞ্জি মায়ের দিক থেকেই বিবেচিত হয়। মেয়েরা কখনও শ্বশুরবাড়ি অবধি যায় না। বরং বিয়ের পর ছেলেরাই নিজের আবাস ছেড়ে চলে আসে। সম্পত্তির বিবেচনায় সর্বময়কর্ত্রী বয়স্কা নারী তার কনিষ্ঠ কন্যাকে এর উত্তরাধিকারী করে যান সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে। ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার বহন করলেও মালিকানা স্বত্ব কখনও তাদের অধিকারে থাকে না। এখনও গারো উপজাতির নারীরা ঘরের ক্ষুদ্রতর সীমা থেকে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে তাদের অধিকার, কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতাকে সুষ্ঠু এবং সুস্থভাবে ভোগ করছে কোন ধরনের বাকবিত-া ছাড়া। নারীদের এই একচ্ছত্র আধিপত্যে পুরুষরা কিছুটা বিব্রত, বিপন্ন কিংবা অনেকটা লক্ষ্যহীন। মেয়েরা শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। পুরুষরাও যে একেবারে পিছিয়ে আছে তা কিন্তু নয়। তবে মেয়েদের তুলনায় কিছুটা তো বটেই। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের সুবর্ণ সময়ে নারী এগিয়ে গেলেও নারী নির্যাতন, পুরুষের একাধিপত্য, নারী-পুরুষের বৈষম্য যেভাবে সমৃদ্ধিকে কলুষিত করছে সে বিচারে সভ্য নারীদের অবস্থান তো বিপন্ন। সেখানে সেই কোনকালের আদিম নৃ-গোষ্ঠী গারোরা আজও সভ্যতাসূর্যে আলোকিত হয়েও আপন বৈশিষ্ট্যে নিজের ক্ষমতায়নকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে। যা এখনও সভ্য মানুষকে বিস্ময়ের সঙ্গে হতবাক করে দেয়। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×