ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

বিপন্ন মায়ের দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৬ জুন ২০১৭

বিপন্ন মায়ের দায়বদ্ধতা

মাতৃত্বের মহিমান্বিত রূপ চির অম্লান, অবিনশ্বর, প্রতিটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত এবং প্রত্যাশিত শব্দটিই মা, মায়ের স্নেহাতিশয্যের নির্মল ধারায় সন্তানের জীবন সিক্ত হয়, শঙ্কামুক্ত হয় সর্বোপরি নিবিড় সাহচর্যে অনুক্ষণ নিরাপদেও থাকে। সব মাই তার গভীর অনুভূতি থেকে সন্তানের প্রতি যে কর্তব্যনিষ্ঠা কিংবা দায়বদ্ধতায় নিমগ্ন থাকেন সেখান থেকেও একজন মা হয়ে ওঠেন সন্তানের মাঙ্গলিক শ্ঙ্খৃলদাত্রী, যে বন্ধন সন্তানের জীবনে কোন ধরনের অশুভ সঙ্কেত অথবা বিবেকবর্জিত কোন অসচেতন মননের নির্মম বলির ছাপ রাখতে দেয় না। আবহমান কাল থেকে নারীর এই সন্তান বাৎসল্যের অপরিমেয় শৌর্য নারীকে নিয়ে গেছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনটিতে। মহাভারতের কুন্তীর সেই হৃদয়বিদারক মর্মবেদনা আজও মাতৃস্নেহের এক অনির্বাণ শিখা, জন্মমুহূর্তে পরিত্যক্ত সন্তান বর্র্ণকে লক্ষ্য করে কুন্তী যখন বলেন- তোরে ত্যাগ করে ছিনু সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ধরে তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন। তবু তোর লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায়। আর এই মাই সর্বকালের, সর্বযুগের মাতৃমহিমার। নিরবচ্ছিন্ন দিপ্তী। মাতৃত্বের এই অপরিমেয় সম্ভার থেকে চ্যুত হয়ে কোন মা কি আদৌ পারেন তার প্রিয় সন্তানের ঘাতক হতে? এটা যেমন অবিশ্বাস্য, একইভাবে মায়ের চিরস্নাত স্নেহধারার চরম অসম্মান। তার পরেও ঘটে যায় এমন কিছু লোমহর্ষক দুর্ঘটনা যাকে মানতে বিবেক কুণ্ঠিত হয়, মানবিক মূল্যবোধ অপমানিত হয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমে উঠে আসা এমন কিছু সহিংস এবং অমানুষিক ঘটনার নির্মম ছবি সাধারণ মানুষকে বিস্ময় হতভম্ব করে দেয়। একজন মা নাকি সন্তানকে খুন করে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে। জানি না পুরো ঘটনাটির মধ্যে অন্য কোন রহস্য চাপা পড়ে আছে কিনা। এই ধরনের অপতৎপরতামূলক নৃশংস দুর্ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের দাবি রাখে। যাতে সত্যিকারের অপরাধী যেন কোনভাবেই ছাড় পেয়ে না যায়। মা কর্তৃক সন্তানহন্তার অভিযোগ এই প্রথম নয়। বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি কোন মানুষকে মুহূর্তের উন্মাদনায় যে কি নির্মম অপরাধে তাড়িত করে যার সঙ্গে সেই মানুষটির সারা জীবনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিন্দুমাত্র যোগসাজশ থাকে না। আর অপরাধ নাকি এমনই বিচিত্র আর জটিল। আর নারী মন তো আরও দুর্গম এবং রহস্যাবৃত্ত। বাক্যগুলো বিভিন্ন সময়ের বিশিষ্ট সৃজনশীল প্রতিভাদীপ্ত মনীষীদের সুচিন্তিত অভিমত। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জরাসান্ধ যার আসল নাম চারুচন্দ্র চক্রবর্তীকে বিভিন্ন কারাগারে জেলারের দায়িত্ব পালনের সুবাদে অপরাধী চক্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। তার বিভিন্ন লেখা থেকে উঠে এসেছে যে কোন অপরাধী মুহূর্তের উত্তেজনায় এমন সব সহিংস ঘটনার অবতারণা করে যেটা আগ মুহূর্তে তার কল্পনারও অতীত ছিল। সন্তানকে মেরে ফেলার অভিযোগে যাবজ্জীবন অন্তরীণ থাকার ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী জরাসান্ধ এসব অপরাধী নিয়ে ভেবেছেন, বের করার চেষ্টা করেছেন কিসের তাড়নায়, ক্ষণিকের উন্মত্ততায় মানুষ নিজেকে খুব অল্প সময়ের জন্য পশু বানিয়ে ফেলে? তার মনে হয়েছে মানুষের মধ্যে দ্বৈতসত্তা বিরাজমান। পশুবৃত্তি সুপ্ত অবস্থায় মনের গহীনে লুক্কায়িত থাকে। তাকে সমস্ত শুভবুদ্ধি দিয়ে মানুষ প্রতি মুহূর্তে পরাভূত করে। কিন্তু কোন কোন সময় অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ-পরিস্থিতি তার শুভবুদ্ধিকে অতিক্রম করে পশুবৃত্তিকে নির্মমভাবে জাগিয়ে তোলে অনেকটা নিজের অজান্তে। আর সে সময়ই ঘটে যায় নিষ্ঠুর পশুশক্তির পাশবিক বিভীষিকা। এমন জঘন্য অপরাধ প্রবৃত্তি ভেতর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অপরাধী নিঃশেষে সেখানে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ঘটে যায় এক অকল্পনীয় দুঃসহ দুর্ঘটনার নিষ্ঠুর বহির্প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘বিচারকের নায়িকা ক্ষীরোদাও সন্তান হত্যার অভিযোগে কারাগারে বন্দী। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ ক্ষীরোদা এক সময় নিজের শিশুপুত্রকে নিয়ে কুয়ায় ঝাঁপ দেয়। পুত্র সন্তানটি মারা গেলেও ক্ষীরোদা কপালগুণে বেঁচে যায়। এখানেও মায়ের ইচ্ছা ছিল সন্তানকে নিয়েই আত্মঘাতী হওয়া। সমাজের নানাবিধ অপসংস্কার অসুস্থ পরিবেশে কিছু মানুষের বেঁচে থাকাটাই নিরর্থক হয়ে যায়। সুস্থ, স্বাভাবিক পথে জীবনের গতি যদি অবারিত না হয় তাহলে অসুস্থ কিংবা অন্য পথে সে গতিকে থামিয়ে দেয়ার তাড়নায় মেতে ওঠে পোড় খাওয়া মানুষ। জীবনের পদে পদে যদি সংহার কিংবা বিপদের আশঙ্কায় নিরন্তর দগ্ধ হতে হয় তখন ‘জীবন’ নামক মহামূল্যবান সম্পদটিকেও বাজি রাখতে পিছপা হয় না অনেকেই। তার মধ্যে দুর্বল অংশ হিসেবে মা এবং শিশু সন্তানরাও এই বিষাদময় পরিস্থিতির শিকার হতে সময় লাগে না। এখানে মা কি শুধু সন্তান হন্তা নাকি বিরূপ, নেতিবাচক পরিস্থিতির নির্মম বলী? তার পরেও মাই সর্বংসহাজননী, স্বর্গাদপী গরীয়সী। মায়ের সচেতন দায়বদ্ধতা সন্তানকে সমস্ত শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য থেকে যেমন রক্ষা করবে পাশাপাশি তার স্নেহের নিরন্তর ধারায় সন্তানের স্বাভাবিক জীবনও নিশ্চিত হবে।
×