ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পরিস্থিতি ভয়াবহ ;###;কোন পণ্যের যোগান নেই ;###;খাদ্য বিদ্যুত জ্বালানি ও পানীয়ের তীব্র সঙ্কট ;###;সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে আরও কিছুদিন ;###;মানিকছড়িতে সেনাসহ ৪ লাশ উদ্ধার ;###;মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫৫

ভুতুড়ে রাঙ্গামাটি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৬ জুন ২০১৭

ভুতুড়ে রাঙ্গামাটি

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী/জীতেন বড়ুয়া/বাসু দাশ ॥ গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় অবিরাম বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ায় পাহাড় ধস ও ঢলে যে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে তাতে দিন যতই গড়াচ্ছে ততই এর ভয়াবহ রূপ বেরিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৫৫ জনে উন্নীত হয়েছে। নিখোঁজ সেনা সদস্যসহ ৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে বৃহস্পতিবার। অপরদিকে, পাহাড়ের রাঙ্গামাটি জেলা শহরটি রীতিমতো ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুত, পানি, সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। কবে নাগাদ এসব জরুরী কার্যক্রম চালু করা যাবে তা সঠিকভাবে বলতে পারছে না প্রশাসন। এছাড়া বৃহস্পতিবার নতুন করে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় উদ্ধার তৎপরতা বিঘ্নিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার পাহাড়জুড়ে ভূমিধস ও পাহাড়ী ঢলের আঘাতে যে প্রলয়ঙ্করী ঘটনা ঘটে গেছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোটা রাঙ্গামাটি শহর এলাকা। সঙ্গে রয়েছে এর আওতাধীন দশটি উপজেলা। শত শত বিদ্যুত খুঁটি ভেঙ্গে গেছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের ঘাগড়া এলাকা পর্যন্ত যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হলেও ঘাগড়ার পর থেকে মানিকছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছানোর কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে রাঙ্গামাটি শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে। বাজারে যে পরিমাণ রয়েছে এর মূল্য দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। পেট্রোল পাম্পগুলোতে যে সামান্য পরিমাণ জ্বালানি তেল রয়েছে তা লিটারপ্রতি ২০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। আর শহরজুড়ে দোকানগুলোতে কোথাও কোন মোমবাতি মিলছে না। জ্বালানি তেলের অভাবে সংশ্লিষ্ট স্থানের জেনারেটরগুলোও আর চলছে না। মূলত, বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের অভাবে চারদিন ধরে পুরো রাঙ্গামাটি জেলা রাতের বেলা ভুতুড়ে নগরীতে রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী সাবস্টেশন ও কাপ্তাই থেকে রাঙ্গামাটি শহরে বিদ্যুত সরবরাহ হয়ে থাকে। এ দুই স্থান থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের শত শত খুঁটি উপড়ে যাওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থার এ বিপর্যয়। এর পাশাপাশি মানিকছড়ি থেকে সাপছড়ি পর্যন্ত পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ-গাছালির স্তূপে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করলেও এক ধরনের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠেছে। রাঙ্গামাটির সর্বশেষ পরিস্থিতি রাঙ্গামাটি শহরের ৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে সহস্রাধিক আশ্রিত নর-নারী ও পুরুষের আহাজারি অব্যাহত রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা এ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে তা একেবারে অপর্যাপ্ত। ঘরবাড়ি হারানো শত শত মানুষ পুনরায় নতুন করে কখন বসতবাড়ি পাবে বা নিজেরা করবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। পুরো রাঙ্গামাটি জেলায় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ হয়ে থাকে চট্টগ্রাম থেকে। রাঙ্গামাটি শহরে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে তা অন্যান্য উপজেলাগুলোতে পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে যেহেতু রাঙ্গামাটিতেই সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অপরাপর উপজেলাগুলোর অবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে এসেছে। শহরের ডিসির বাংলো, সার্কিট হাউস এলাকাসহ সর্বত্র সড়কগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়টি পাহাড়ী চূড়ায় অবস্থিত। এর উভয় পাশে পাহাড় ধস হওয়ায় ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটি এখন ঝুঁকির মুখে রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সব ধরনের পণ্য সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় বুধবার থেকে লঞ্চ মালিক সমিতি কাপ্তাই থেকে বিভিন্ন পণ্যের ছোট ছোট চালান নিয়ে আসা শুরু করেছে। এসব চালান চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই পৌঁছানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের কিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় মালবাহী বড় ধরনের কোন যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে ছোট আকৃতির যানবাহনে যেসব পণ্যের চালান যাচ্ছে তা একেবারে স্বল্প। রাঙ্গামাটি শহর ও উপজেলাগুলোতে এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। যদিও জেলা প্রশাসন সূত্রে এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ বলছে, কিন্তু বেসরকারী সূত্রসমূহ এ সংখ্যা অর্ধশতাধিক হবে বলে দাবি করছে। রাঙ্গামাটির ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষও স্বজনদের লাশের খোঁজে তৎপরতা চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মানিকছড়িতে নিখোঁজ থাকা সৈনিক আজিজুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে সেনা ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। এছাড়া বেদভেদি এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও ৩ জনের লাশ। উদ্ধার কাজে সরকারী প্রশাসন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে। শহর ও দশ উপজেলায় এমন কোন পাহাড় নেই যে যেখানে ধস সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে এ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের আওতায় ১৩৭টি পয়েন্টে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সড়ক বিভাগ, এলজিইডির সঙ্গে সেনা সদস্যরাও একযোগে কাজ চালাচ্ছে। এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি উত্তরণে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারা। অপরদিকে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ধস সৃষ্টি হওয়ায় সেখানেও অনুরূপ টিমগুলো কাজ করছে। এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৩২ লাখ টাকা, ৫০ মেট্রিক টন খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ৫০০ বান টিন, ১৫ লাখ পিস সিআইসি শিটের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এদিকে, রাঙ্গামাটিতে উদ্ধার কাজে সহস্রাধিক সেনা সদস্যের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ১২০ সদস্য উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কাজ বিঘিœত হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষ ও শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রিতদের অবস্থার কোন উন্নতি নেই। কেননা, রাঙ্গামাটিতে যে পরিমাণে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে সে পরিমাণে এখনও সাহায্য-সহায়তা পৌঁছেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বুধবার জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখায় ৫ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। এ অর্থ উন্নয়ন বোর্ডের সর্বস্তরের কর্মচারীদের একদিনের বেতন থেকে প্রদান করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, আশ্রিতদের অবস্থা খুবই খারাপ। সহস্রাধিক আশ্রিতদের মাঝে ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ স্বজন হারানোর বেদনা গুমরে কাঁদছে। এর সঙ্গে পানি, বিদ্যুত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ খাদ্য সঙ্কটের কবলে পড়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি জেলায় উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি পরিবহন ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে পচতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আম, কাঁঠাল, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ধরনের ফল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়ে থাকে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। রাঙ্গামাটি থেকে বরকল, লংগদু, বাঘাইছড়ি, জুরাইছড়িতে কোন ধরনের ভোগ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যাচ্ছে না। ফলে এসব উপজেলায়ও বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে লংগদু ও বাঘাইছড়িতে কিছু কিছু পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পুরো রাঙ্গামাটি জেলায় বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি সঙ্কটে সাধারণ মানুষের অবস্থা অবর্ণনীয়। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি অবহিত হয়ে দুই মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে সেনাবাহিনী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব সংস্থার কর্মীরা উদ্ধার কাজেই দিবারাত কাজ করছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে সরকার পক্ষে এখনও কোন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। কিছুটা যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বেসরকারী পর্যায়ে। এদিকে, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বরইছড়ি এলাকার সড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম থেকে কর্ণফুলী নদী পথে কাপ্তাই নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের ছোট ছোট চালান। এসব চালান কাপ্তাই থেকে নদী পথে যাচ্ছে রাঙ্গামাটি শহর এলাকা। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। বান্দরবান পরিস্থিতি কয়েকদিনের টানা বর্ষণে বান্দরবানের সাত উপজেলায় দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। পাহাড় ধসের ফলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে এসেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে এখনও বান্দরবানের সঙ্গে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানছি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর পাহাড় ধসে পড়ার কারণে এ তিন উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরও কদিন সময় নেবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। কর্মীদের সঙ্গে সেনা সদস্যরাও এ কাজে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করে যাচ্ছেন। তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বান্দরবান শহরের মধ্যমপাড়া, উজানিপাড়া, ইসলামপুর, হাফেজঘোনা, শেরেবাংলা নগর, বাস স্টেশন এলাকায় মোট ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে এখন দুই শতাধিক মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে, শহরে বালাঘাটা, আগাপাড়া, লেমুছড়িতে পাহাড় ধসের ঘটনায় উদ্ধার অভিযান শেষ করেছে সেনাবাহিনী, ফায়ার কর্মী ও প্রশাসনের কর্মীরা। বান্দরবানে মোট সাতটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। নিহত পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলা পাহাড়ি হলেও এ দুটি স্থান পাহাড়ী ঢলমুক্ত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর। এ সময় তার সঙ্গে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক, পুলিশ সুপার রঞ্জিত কুমার রায়, পৌর মেয়র বেবী ইসলামসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। খাগড়াছড়ি পরিস্থিতি খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে এখনও বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। গত রবিবার থেকে টানা কয়েক দিনের বর্ষণে জেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পাহাড় ধস হয়েছে। এ জেলায় প্রাণহানির সংখ্যা এ পর্যন্ত ৪ জন হলেও ঝুঁকিমুক্ত নয়। প্রতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় প্রশাসন নড়াচড়া করলেও স্বাভাবিক সময়ে থাকে নির্বিকার। গত দশ বছরে এ জেলায় প্রাণহানি হয়েছে অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে শুধু রামগড় উপজেলায় রয়েছে ২৮ জন। গত মঙ্গলবারের ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তা পাহাড় ধসে। লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার যতী চাকমা জানিয়েছেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড় ধসে মাটিচাপায় মারা যায়। এ পরিবারের আরও ৭ জন মারাত্মক আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আহতরা হচ্ছেনÑ মধ্যম বর্মাছড়ির সজিব চাকমার স্ত্রী রজমালা চাকমা, নয় বছরের কন্যা পারকি চাকমা, ছয় বছরের শিশু তুষি চাকমা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ধনঞ্জয় চাকমা (৬৫) ও তার স্ত্রী পিতুর বালা চাকমা (৫৫), মেয়ে সাবিত্রী চাকমা (৪০) এবং সাবিত্রির পুত্র একিন চাকমা। এ ঘটনা দুর্গম এলাকায় হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদরেও আনা যাচ্ছে না। আহতদের চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একটি মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে, খাগড়াছড়ি পৌর এলাকার কলাবাগান, লেমচি বাজার, মোল্লাপাড়া, কৈবল্য পিঠ, আঠার পরিবার, শালবন ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড়ের ঢালে ঢালে জীবন ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। বৃহস্পতিবারও থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়জুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েকদিনের বর্ষণে কলাবাগান, শালবাগান, সবুজবাগসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস সৃষ্টি হয়েছে। এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব মানুষকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাহাড় কাটা ও পাহাড়ের ঢালে বসতি স্থাপনে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা বা নির্দেশনা নেই। ফলে পাহাড়ের চূড়ায় বা পাদদেশে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে বসতি। এর পাশাপাশি জুম চাষ ও বন উজাড় হওয়ার কারণে পাহাড় ধসের ঝুঁকি কেবলই বাড়ছে। রাঙ্গামাটি জেলায় যা ঘটেছে অনুরূপ ঘটনা যে কোন মৌসুমে খাগড়াছড়ি জেলাতেও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। নিখোঁজ সৈনিকসহ ৪ লাশ উদ্ধার রাঙ্গামাটি শহরের মানিকছড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনায় নিখোঁজ সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমানসহ (৩০) ৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। সেনা সদস্যদের উদ্ধার অভিযানে এ চারটি লাশ পাওয়া যায়। সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে, নিহত আজিজুর রহমান ছিলেন একই ঘটনায় নিহত মেজর মাহফুজুর রহমানের রানার। আজিজুর রহমানের বাড়ি মাদারীপুর। বুধবার উদ্ধার হওয়ার পর তার লাশ হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়েছে। বিকেলে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ শুক্রবার তার লাশ গ্রামের বাড়িতে হেলিকপ্টারযোগে পৌঁছানো হবে। নিহত সেনা সদস্য আজিজুর রহমানের সঙ্গে অপর যে তিনটি লাশ পাওয়া গেছে তারা হলেনÑ লিটন চন্দ্র দাশ (৩১), তার স্ত্রী চুমকি রানী দাশ (৩০) ও তাদের দুই বছরের শিশুপুত্র অয়ন চন্দ্র দাশ। এ পরিবারটি প্রায় ৬ বছর আগে রাঙ্গামাটি বেদভেদি এলাকায় বসতি স্থাপন করে। নিহত লিটন বেদভেদি বাজারে একটি হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী ছিলেন।
×