ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুতুবদিয়ায় উদ্বিগ্ন দেড় লাখ মানুষ ॥ হুমকিতে বায়ু বিদ্যুত প্রকল্প

ভাঙ্গনে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বসতি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১৬ জুন ২০১৭

ভাঙ্গনে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বসতি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ ঘূর্ণিঝড় মোরার ধকল কেটে না উঠতেই বিপদে রয়েছে কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষ। পাঁচদিন আগে বয়ে যাওয়া তীব্র ঝড়ো হাওয়া এবং পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে কুতুবদিয়ার ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। ইতোপূর্বে দ্বীপের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩০ কিলোমিটারের বেশি বিধ্বস্ত হয়ে বাড়িঘরে ঢুকে পড়ছে জোয়ারের পানি। লোনা পানিতে ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ফসলের বীজতলা, পুকুরের মাছ ও রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা জোয়ারের ধাক্কার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জনবসতি। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে টিকে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন দ্বীপের দেড় লাখ মানুষ। হুমকিতে পড়েছে দেশের একমাত্র বায়ু বিদ্যুত প্রকল্পটিও। উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের পশ্চিম আলী আকবর ডেইল, কাহারপাড়া, কাজীরপাড়া, কিরণপাড়া, চৌধুরীপাড়া, প-িতপাড়া, তেলিপাড়া, হায়দার বাপেরপাড়া, পূর্ব তাবালেচর, পশ্চিম তাবালেরচর, জেলেপাড়া এবং বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া, রোমাইপাড়া এলাকায় জোয়ারে বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে কয়েক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে। উত্তর ধুরুং এলাকার কাইছারপাড়া, চুল্লারপাড়া, চরধুরুং, নয়াকাটা, আকবর বলীপাড়া, ফয়জানির বাপেরপাড়া, উত্তর সতর উদ্দিনসহ অন্তত ১০ গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। বড়ঘোপ আজম কলোনি, মধ্যম অমজাখালী, দক্ষিণ অমজাখালী এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর সময় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কুতুবদিয়ার জনপ্রতিনিধিরা জানান, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের কাহারপাড়া থেকে তাবালেরচর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া গ্রামের পূর্ব পার্শ্বের ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের কায়ছারপাড়া থেকে পশ্চিমচর ধুরুং পর্যন্ত ১ কিলোমিটার এবং মিয়ারা কাটা থেকে দক্ষিণে পুরাতন বাতিঘর পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সাগরের সঙ্গে মিশে গেছে। দ্বীপ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষের স্বাভাবিক বসবাস ও জানমাল রক্ষার্থে জরুরী ভিক্তিতে বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণ, জিও ব্যাগ দিয়ে মেরামতসহ স্থায়ী বেড়িবাঁধ জরুরী। অন্যথায় ইতিহাস থেকে কুতুবদিয়া নামক এই দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজিরপাড়ার পঞ্চাশোর্ধ দিলুয়ারা জানান, জোয়ারের পানিতে তার বসতবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা ঘরের ভেজা মাটিতে ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন যাচ্ছে তার। স্বামীহারা দিলুয়ারার সংসারে এখন অন্ধকার। জীবন ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ে দিনযাপন করছে। অনেকটা অর্থের ভিখারি। ইটের চুল্লি বানিয়ে কোন রকম রান্নাবান্না সারছে। যন্ত্রণার জীবনমুক্ত হতে সবার কাছে আকুতি জানায় দিলুয়ারা। একই কথা ধলুয়ারা, খালেদা, ছেনুয়ারা, মিনুয়ারা, বুলবুল আকতার, শাফিয়া, ফাতেমা, ফরিদা, পারুল, মরতুজা, কামরুন নেছার। তাদের বর্ণনা ওঠে আসে দুঃসহ জীবনের কথা। সূত্র জানায়, গত ২১ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ ৩০ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কুতুবদিয়া দ্বীপে মারাত্মক আঘাত হানে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেড়িবাঁধ। যথাসময়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার-পুনর্নির্মাণ ব্যবস্থা না নেয়ায় ১১ জুন রাতের পূর্ণিমার জোয়ারে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। ভেসে যায় বাড়িঘর। লবণ পানিতে নষ্ট হয়ে যায় ক্ষেত খামার। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে ভাঙ্গা পয়েন্ট দ্রুত সংস্কারের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এক বছরেও কাজে হাত দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাওবো)। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই জোয়ার-ভাটায় সাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে অরক্ষিত কুতুবদিয়ার জনপদ। সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত রবিবার থেকে একটানা প্রবল বর্ষণ, ঝড়ো হাওয়া এবং পূর্ণিমার ভরা কাটালে (জোয়ার) সাগরের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয় কুতুবদিয়ার প্রায় ২০টি গ্রাম। ফসলের বীজতলা বিনষ্ট হয়ে দ্বীপের চাষযোগ্য প্রায় ১৪০ হেক্টর জমিতে আউশের চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আলী আকবর ডেইল হকদার পাড়া সড়কটি পানির ধাক্কায় ল-ভ- হয়ে পড়েছে। ওই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের তেলিপাড়া থেকে ১নং ওয়ার্ডের ঘাটকুলপাড়া পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এ সংযোগ সড়কটির পূর্বাংশ পিচ ঢালাই হলেও পশ্চিমাংশে (হকদারপাড়া) ৩০ মিটার এখনও ব্রিকসলিন। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এলজিএসপি ২-এর অর্থায়নে সড়কটি পুনঃসংস্কারের কাজ শেষ হয় মাত্র। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোরাসহ সম্প্রতি সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারে প্লাবিত হয়ে ওই সড়কটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ঘাটকুলপাড়া, নয়াপাড়া, হকদারপাড়া, তেলিপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এ সড়ক। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দ্রুত মেরামতের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
×