ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন ৮০ বছরের হাওয়া বেগম

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৬ জুন ২০১৭

শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন ৮০ বছরের হাওয়া বেগম

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ৮০ বছর বয়সী হাওয়া বেগম শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। সেভ দ্য চিলড্রেন ‘রিডিং এনহেন্সমেন্ট ফর এ্যাডভান্সিং ডেভেলপমেন্ট’ প্রজেক্টের আওতায় দেশজুড়ে ‘কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প’ এর কাজ শুরু করেছে। শিশুদের পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবনীমূলক উপায়ে শিক্ষা প্রদান এই ক্যাম্পের মূল উদ্দেশ্য। কুড়িগ্রামের ভোগডাঙ্গার কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পে দুই নাতীকে নিয়ে প্রতিদিন হাজির হন ৮০ বছর বয়সী হাওয়া বেগম। তিনি এই ক্যাম্পের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যাম্পে আসা প্রতিটি শিশুর সঙ্গেই তাদের মা-বাবা আসলেও হাওয়া বেগম তার দুই নাতিকে নিয়ে উপস্থিত হন ক্যাম্পে। দুই নাতিকে শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি অন্য শিশুদের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন হাওয়া বেগম। একজন সফল দাদি হিসেবে তিনি কুড়িগ্রাম জেলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার ইচ্ছে প্রতিটি শিশুকে বইয়ের বাইরে গিয়ে বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা। কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প হলো রিড প্রকল্পের আওতাভুক্ত নির্ধারিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য আনন্দঘন পরিবেশে পড়তে শেখার একটি নিরাপদ স্থান। এখানে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত অধিবেশন পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের কারিগরি, ইউএসএইডের আর্থিক সহযোগিতায়। সরকারী স্কুলের কাছেই স্ব স্ব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এসএমসি কর্তৃক নির্ধারিত উন্মুক্ত ও শিশুবান্ধব নিরাপদ পরিবেশে এই রিডিং ক্যাম্পগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। এখানে সরকারী স্কুলের শিশুরা (প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী) বিদ্যালয় পরবর্তী সময়ে তাদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির জন্য একটি কার্যকর সুযোগ পায় এবং প্রতিটি ক্যাম্পে দুইজন প্রশিক্ষিত কমিউনিটি লিটেরেসি ভলেন্টিয়ার সরাসরি এই কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। প্রতিটি কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর শিশুরা প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় রিডিং ক্যাম্পে অতিবাহিত করে। রিডিং ক্যাম্পগুলোতে সাধারণত মুক্তখেলা, গান, গল্প, হাতে-কলমে কাজ, লেখা অনুশীলন, মূল্যায়ন ও বর্ণ বা শব্দ নিয়ে খেলার মাধ্যমে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী সেশন পরিচালিত হয়ে থাকে। পাশাপাশি ছয় স্তরের গল্পের বই রয়েছে যা শিশুরা ক্যাম্প থেকে বাড়িতে নিয়ে যায় ফলে তারা তাদের পাঠের অভ্যাস অব্যাহত রাখতে পারে। হাওয়া বেগম কেন কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের সদস্য হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘আমার ছেলে যখন ছোট ছিল তখন আমি তার সঙ্গে খেলা করে, গল্প, গান এবং কবিতা শুনিয়ে তাকে পড়া শেখাতাম। আমার মনে হতো এভাবে শিশুকে শিক্ষা দিলে তাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ বাড়ে। আমি তখন ভাবতাম বিভিন্ন উদ্ভবনীমূলক কর্মকা-ের মধ্য দিয়েও তো শিশুদের পড়ানো যেতে পারে। এ বছরের জানুয়ারিতে যখন আমি কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের বিষয়ে জানলাম তখন আমি ভেবে খুব খুশি হয়েছিলাম যে, এবার অবশ্যই শিশুরা বইয়ের বাইরে গিয়ে পড়া শিখবে খেলার ছলে।’ অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় হাওয়া বেগমের। বিয়ের পর যখন তিনি কুড়িগ্রামে তার শ্বশুর বাড়িতে আসেন তারপর পড়ালেখার ইতি ঘটে। এখন তার বয়স ৮০ বছর। তিনি এখন কুড়িগ্রামের ভোগডাঙ্গা গ্রামে তার ছেলে, পুত্রবধূ ও তার দুই নাতির সঙ্গে বসবাস করেন। হাওয়া বেগম শুধু তার নাতিদের শিক্ষায় সহায়তা করছেন না বরং ব্যতিক্রমী শিক্ষাদানে সমান অবদান রাখছেন কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের শিক্ষা কার্যক্রমে। এই ক্যাম্পের একজন স্বেচ্ছাসেবী সদস্য হয়ে তিনি বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করছেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদেরও। এভাবেই তিনি শিশু শিক্ষায় এক ব্যতিক্রম প্রয়াস দেখাচ্ছেন। ভোগডাঙ্গা কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর থেকে হাওয়া বেগমের জীবন কিভাবে চলছে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঘরের কাজে সময় পার করতেই আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন আমি শুধু আমার দুই নাতির ভবিষ্যত নিয়েই ভাবছি। বর্তমানে আমি প্রায়ই ভোগডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শনে যাই। আমি চেষ্টা করছি স্কুলের সকল শিক্ষকদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে। সেইসঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মতবিনিময় সভায় নিয়মিত যোগদানের চেষ্টা করি।’ পাঠাভ্যাস বা পঠন দক্ষতা শিশুর সমগ্র শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলে। শুরুতেই পড়ার একটি মজবুত ভিত তৈরি হলে একই শ্রেণীতে শিশুর পুনরাবৃত্তি বা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ঝরে পড়ার হার হ্রাস কমবে। রিড প্রকল্প বিশ্বাস করে এই কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের মাধ্যমে শিশুর শিখন টেকসই হবে, শিশুর মধ্যে স্কুল ভীতি কমবে; পড়া ভীতি থাকবে না, একে অন্যের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠবে, সমবয়সী এক শিশু অপর শিশুর কাছ থেকে শিখবে, উপকরণ ব্যবহার করে পড়া শিখতে পারবে এবং সৃজনশীল হবে। সর্বোপরি শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। এই উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ৭ বিভাগের ১৩ জেলার ৩৪ উপজেলার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ও এসএমসি কর্তৃক নির্ধারিত উন্মুক্ত ও শিশুবান্ধব নিরাপদ পরিবেশে মোট ১ হাজার ৩৫৬ কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প পরিচালিত হয়ে আসছে। কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প দেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পঠন দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
×