ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বন্ধ হোক পাহাড়ের কান্না

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৬ জুন ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বন্ধ হোক পাহাড়ের কান্না

রাজনীতি বোবা বলে পাহাড়ও নীরবে ধসে পড়ে। আজকাল এমন এক সময় সত্য বলাটাও আইনের বাইরে নেই। আওয়ামী লীগের আমলে আমরা শুধু চেতনা বা মুক্তিযুদ্ধের জয় চাই? না আমাদের চাওয়া সুশাসন? এটা জানি, চাইলেই সব পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা একা লড়ছেন। দলের চারপাশে ভিড় করা সুবিধাবাদীদের দেখলেই পঁচাত্তরের কথা মনে পড়ে। রাজনীতির যা হবে হোক আপাতত আমরা মানুষের জীবনের কথায় ফিরে আসি। পাহাড়ের পাদদেশে বড় হওয়া মানুষ আমি। বলতে গেলে জন্মই পাহাড়ে। আহা কী সে শহর। পাহাড়ের পাদদেশে বঙ্গোপসাগর। আজ সে শহর ও রাঙ্গামাটি বান্দরবানে পাহাড় দেখতে গেলে দূরবিন সঙ্গে নিতে হয়। মানুষের দোষ? সেই কবে জিয়াউর রহমান সেটেলারের নামে গরিব মানুষদের পাহাড়ে পাঠিয়ে সেখানে বাঙালী আধিপত্য কায়েমের সূচনা করেছিলেন আজও কি তার কমতি আছে কোথাও? আমি দেখেছি পাহাড়ীরা তাদের এলাকা বা সম্প্রদায়ের বাইরে এলেই সমতলের বাঙালীদের ভয় পায়। কেন পাবে না? তাদের তো বিপদের অন্ত নেই। এমনকি বাঙালী হিন্দু বৌদ্ধ বা খ্রীস্টানদের মতো সমতলের মানুষের সঙ্গে চেহারারও মিল নেই। থাকলে না হয় জনারণ্যে লুকিয়ে বাঁচতে পারত। এত ইউনিক আর এত সহজে পরিচয় চিহ্নিত করার মতো আদল পেলে অন্য দেশের সংখ্যাগুরুরা এদের আগলে বড় করত। দুনিয়ার বহু দেশে আমি আদিবাসী সংখ্যালঘুদের চমৎকার আধিপত্য দেখেছি। আমাদের দেশের যারা একেবারে গরিব বা পাহাড়ের ভেতর আদিম জীবনযাপন করেন তারাও কিন্তু ইতিহাস। বাকিদের আপনি দেখবেন আম বাঙালীর চাইতে আধুনিক। পোশাক খাবার চলনে বলনে স্মার্ট। অথচ আমরা তাদের জাতীয় স্রোতে নিতে পারিনি। বলছিলাম এবার যখন আওয়ামী লীগ শাসনে কেন তাদের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দেয়া গেল না? খালি দুর্ঘটনা ঘটলেই আমাদের তৎপরতা? পাহাড়ের যেমন রাজনৈতিক বা সামাজিক ভবিষ্যত নেই এখন তো দেখা যাচ্ছে জীবনের নিশ্চয়তাও নেই। পাহাড় চট্টগ্রামেও ধসেছে। তবে তফাৎ এই চাটগাঁর পাহাড় ধসায় রাজনীতির মাতবরেরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় আছে জমির লোভ। সেটেলারের অবৈধ বাড়িঘর। এই প্রক্রিয়া সরকার বা প্রশাসন জানে না এটা কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মূলত এর জন্য যে সচেতনতা বা সাবধানতা সেদিকে মনযোগ নেই কারও। পাহাড় কি শুধু আমাদের আছে? আর কারও নেই? বছরের পর বছর এমন ঘটনা কেবল বাংলাদেশে কেন ঘটে? কারণ আমরা একটি কথা খেকো জাতি। আমাদের কাজ হচ্ছে কথা বেচা। কথা কেনা। সব সরকার মুখে বললেও পাহাড়ে বা সমতলের গরিবদের জীবনে আসলে কোন পরিবর্তন ঘটে না। তাছাড়া মৃত্যু এখন আমরা এতটাই স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলেছি যে জীবন বা বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের। এই যে লন্ডনে ছুরিকাঘাতে মানুষ প্রাণ হারাল খেলার মাঠ থেকে সংসদ সংসদ থেকে আয়োজন সবকিছুতে তারা তাদের স্মরণ করল। দুনিয়া জানল মানুষের জীবনের চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না। করব আমরা? এখন একটা প্রবণতা হয়েছে উন্নয়নের গল্প প্রচার করা। আওয়ামী লীগের আমলে বাংলাদেশ এগিয়েছে। তাদের সাফল্য বা সফলতা কম কিছু না। রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রচারের জায়গা যেখানে শক্ত হবার কথা সেখানে তা হয়নি। সেটা আমরা নানা সঙ্ঘাত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় দেখেছি। এছাড়াও তাদের জয়গান বা জয়যাত্রার পেছনে যে সত্যি তাকে স্বীকার করার অভাব বড় বেশি। আমি আবারও পাহাড়ের কথায় ফিরব। স্বাধীনতার এত বছর পরও তাদের যদি কেবল শান্তি চুক্তির কথা বলে সান্ত¡না দেয়া হয় সেটা কি আসলেই বাস্তবোচিত? এরা আমাদের অপরিহার্য অংশ। যেসব বাঙালী সেখানে বসবাস করে তারাও দেশের নাগরিক। কোন পাহাড় কাটলে মানুষ মরবে আর কোনটা থাকলে বাঁচবে এই বোধ কি আমাদের লোপ পেয়েছে? আজকাল সামাজিক মিডিয়ার রমরমা যুগে কোন ঘটনাই গোপন থাকে না। যেসব লোভী বেনিয়াদের কারণে এই সব ঘটনা আমাদের মন কে দুখিয়ে তোলে বিবেককে পরাজিত করে তারা অচেনা কেউ না। ধরে বেঁধে শাস্তি দেয়াও কষ্টের কিছু না। তবে ঘণ্টা বাঁধবে কে? রমজান মাসে এমন ঘটনা ছিল অনভিপ্রেত। কেবল প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে পার পাওয়া যাবে না। বড় বড় শহরে এত পানিবদ্ধতা এত সঙ্কট মানুষ নৌকা নিয়ে কৌতুক করছে। বাজারে চালের দাম বাড়তি। দেশের আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের গলায় কণ্ঠে উত্তাপ। এদিকে খালেদা জিয়া বলছেন, আর কোন নির্বাচন ভোটার ছাড়া হবে না। আওয়ামী লীগ কি টের পাচ্ছে তাদের পায়ের তলার পাহাড়েও টান লাগছে। এখন সময় প্রতিকার ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়ার। কথায় কাজ হবে না। হলপ করে বলতে পারি কেবল চেতনায় মানুষ মজবে না। সকালে উঠেই দুঃসংবাদ আর নিজেদের সাফাই কাউকে ভাল রাখে না। এবং সমাজ বা সময়ও তা ভুলে যায় না। পাহাড়ে যা ঘটেছে তা জাতীয় দুর্যোগ। আমরা এমন কোন নিষ্ঠুর জাতিতে পরিণত হইনি যে এমনটি ঘটবে আর মানুষ চোখ বুজে মেনে নেবে? তাই সাবধানতার বিকল্প নেই। কারণ সময়মতো মানুষ এর জবাব চাইবেই। আপাতত পাহাড়ের কান্না থামানো এবং ভবিষ্যতে এমন ধস বন্ধ করার পথ খুঁজে বের করা জরুরী। সত্যি বলছি দেশে, দেশের বাইরের মানুষ, মানে বাঙালী এখন তেতে আছে কেন জানি। বন্ধ হোক পাহাড়ের কান্না।
×