ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ শফিকুল ইসলাম

আইএইএর মহাপরিচালকের সফর ॥ প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৬ জুন ২০১৭

আইএইএর মহাপরিচালকের সফর ॥ প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইসেনআওয়ারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ‘এটমস ফর পিস’ (অঃড়সং ভড়ৎ চবধপব) বিষয়ে বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু শক্তির সামরিক প্রয়োগে বিশ্ববাসী যে মানবিক বিপর্যয়ে ছিল তা থেকে দৃষ্টি সরানোর লক্ষ্যে, পারমাণবিক শক্তি কীভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে আস্থায় আনা। অপরটি হচ্ছে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর মাধ্যমে পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কোন দেশ যাতে পারমাণবিক প্রযুক্তি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি (আইএইএ) নামক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। অতপর ১৯৫৭ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় আইএইএ নামক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনসহ ৫টি দেশের সমন্বয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধকল্প চুক্তিটি (এনপিটি) ১২ জুন ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘের সদর দফতর নিউইয়র্কে গঠিত হয়। ওই চুক্তিতে এ পাঁচটি দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র অধিকারী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। অতপর আইএইএর মাধ্যমে ৫ মার্চ ১৯৭০ সালে ওই পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য সব দেশকে আহ্বান করা হয়। বাংলাদেশ ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে আইএইএর সদস্যপদ লাভ করে, কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ৩১ আগস্ট ১৯৭৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিটি মূলত পারমাণবিক জ্বালানি অতিমাত্রায় সমৃদ্ধিকরণ থেকে নিবৃত্তকরণ, নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তিপূর্ণ প্রয়োগে তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৯১টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং এখনও স্বাক্ষর করেনি ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল। উত্তর কোরিয়া স্বাক্ষর করলেও ঘোষণা দিয়ে তাঁরা চুক্তি থেকে বের হয়ে আসে। বর্তমানে বিশ্বের ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক চুল্লি চালু রয়েছে। ৬০টি নির্মাণাধীন, ১৬০টি পরিকল্পনাধীন এবং আরও ৩২০টি প্রস্তাবনাধীন রয়েছে। এ ছাড়া সাবমেরিনে যুক্ত পারমাণবিক চুল্লি ও গবেষণা চুল্লি বিবেচনায় নিলে বিশ্বে মোট প্রায় ১ হাজারটি পারমাণবিক চুল্লি রয়েছে। থ্রি-মাইল আইল্যান্ড (১৯৭৯), চেরনোবিল (১৯৮৬) ও ফুকুশিমার (২০১১) পারমাণবিক দুর্ঘটনা বিশ্ববাসীকে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকে অনাস্থায় ফেলে দিয়েছে সত্য, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে পারমাণবিক প্রযুক্তি একটি পরীক্ষিত ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে কারিগরি ক্রটি, মানবভুল ও প্রকৃতির বিরূপ আচরণের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে প্রয়োজন নিত্য-নতুন প্রযুক্তির প্রবর্তন, যা অব্যাহত রয়েছে। এদেশে সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে গবেষণা কাজে বাংলা একাডেমি সংলগ্ন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সালে তৎকালীন সরকার পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার-১৫, ১৯৭৩ এর মাধ্যমে দেশে পরমাণু শক্তি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা ও পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ এবং তাঁর জামাতা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পরামর্শে পরমাণু শক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আদলে দেশে পরমাণু গবেষণাগার তৈরি করার জন্য সাভারে ২৬৫ একর জমি বরাদ্দ দেন এবং সেখানে পরে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অতপর এ প্রতিষ্ঠানেই ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয় ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি। সদস্যপদ লাভ থেকেই বাংলাদেশ আইএইএর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আইএইএর সদস্যপদ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ প্রতি বছর যৎসামান্য অর্থ প্রদান করে থাকে। কিন্তু তার বিনিময়ে বাংলাদেশ আইএইএর নানাবিধ কারিগরি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শান্তিপূর্ণ প্রয়োগে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, জনবল প্রশিক্ষণ, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভৌত অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের কাজে অভাবনীয় সহায়তা পেয়ে আসছে। আইএইএ কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ১৩৮টি জাতীয় প্রকল্প এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির অধীনে ১১১টি আঞ্চলিক প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। আইএইএর কারিগরি সহযোগিতায় পরমাণু শিক্ষা ও গবেষণা, খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, পানিতে আইসোটোপ কৌশল প্রয়োগ, পরিবেশ সুরক্ষা, নন-ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিংয়ের মতো শিল্প সহায়তা, শস্য ও গবাদি পশুর উন্নয়ন এবং পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এ ছাড়াও আইএইএর কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা)-এর উচ্চফলনশীল জাত ও লবণাক্ত সহিষ্ণু শস্য জাতের উন্নয়ন ও উদ্ভাবন এবং দেশে নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেবায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। গত ৩০ মে, ১ জুলাই বাংলাদেশ সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ভিয়েনায় আইএইএর কারিগরি সহযোগিতা কর্মসূচীর ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করে দেশের এ সমস্ত অর্জন অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি পারমাণবিক শক্তিকে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে বিদ্যুতের সবচেয়ে টেকসই উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি যথার্থই অনুধাবন করেছেন যে, তেল, গ্যাস, কয়লা কিংবা সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে দেশের বিদ্যুত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রূপপুর থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪০০ মেগাওয়াট ছাড়াও ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক উৎস থেকে আরও ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। পারমাণবিক বিদ্যুতকেদ্র নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, সকল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে আইএইএর কারিগরি সহায়তা ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে আইএইএর মহাপরিচালক হেন্স ব্লিক্স সাভারে পরমাণু গবেষণা চুল্লি চালুকরণ উপলক্ষে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। অতঃপর ২০১০ সালে ইউকিয়ো আমানো বর্তমান সরকারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের সংকল্প ব্যক্তকরণের পর বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি আগামী ৩-৪ জুলাই দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসবেন। পরমাণু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল একটি জটিল, স্পর্শকাতর ও পেশাদারিত্বে¡র বিষয়। এ ধরনের প্রযুক্তি রপ্ত করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অপরদিকে পরমাণু প্রকৌশলবিদ্যা মানব কল্যাণে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুসরণ করতে হয়। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র একটি বহুশাস্ত্রীয় উচ্চ প্রযুক্তি বিধায় পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনায় সুদৃঢ় ভৌত অবকাঠামো, পরমাণু আইন, রেগুলেশন, পেশাদারি স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, দক্ষ ও পেশাদার জনবলের প্রয়োজন। নিচে প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় নিয়ে আইএইএর মহাপরিচালকের সঙ্গে মতবিনিময় করলে বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার ভিত মজবুত হতে অনেকটা সহায়ক হতে পারে। ১. বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে আইএইএ সেইফগার্ডস দ্রুত বাস্তবায়ন বিষয়ে সহায়তা প্রদান; ২. পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের রেগুলেশন, সেইফটি, সিকিউরিটি ও সেইফগার্ডস সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের কারিগরি গাইড তৈরিতে সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা প্রদান; ৩. পারমাণবিক ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নতকরণে সহায়তা প্রদান; ৪. দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন; ৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে সহায়তা প্রদান। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউকিয়ো আমানোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চকিত আসনে অধিষ্ঠিত হবে অচিরেই। লেখক : চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইমেইল : [email protected]
×