ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে চালের মূল্য স্থিতিশীল করুন

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৬ জুন ২০১৭

দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে চালের মূল্য স্থিতিশীল করুন

সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্তের বিপদ-আপদ এবং দুঃখ-কষ্টের কোন শেষ নেই। গরম ও খরা হলেও বিপদ, বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি হলেও বিপদ। এতদিন মানুষ ভুগেছে গরমে ও খরায়। তাদের শীতাতপ যন্ত্র নেই। পাখা, কোন কোন ক্ষেত্রে হাত পাখাই সম্বল। অতএব উপরওয়ালাকে ডাকা ছাড়া উপায় নেই। এবার বিপদ হচ্ছে বৃষ্টির। অতিবৃষ্টি কী করতে পারে, অকাল বন্যা কী দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে তা এবার প্রত্যক্ষ করেছে বৃহত্তর সিলেটের লোক এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার লোক। তাদের প্রায় ৪-৬ লাখ টন খাদ্যশস্য বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গাইগরু গেছে, ছাগল গেছে, হাঁস-মুরগি গেছে, গেছে ঘেরের মাছ, যা সিলেটীদের অন্যতম সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের লোক এখন সরকারের আনুকূল্যে বেঁচে আছে। অতিবৃষ্টির বিপদ কী তার আরেক প্রমাণ গত বুধবারের বৃষ্টি। আমি তখন প্রেসক্লাব লাইব্রেরিতে। হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ চলে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। জ্যৈষ্ঠের শেষ। বৃহস্পতিবার আষাঢ় মাস। মনে হলো ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’র কথা। বেশ কিছুক্ষণ বন্দী থেকে যখন রাস্তায় নামলাম তখন দেখলাম চারদিকে জল। প্রেসক্লাব জলে বন্দী। সামনের রাস্তায় প্রায় হাঁটু জল। মানুষের দুর্ভোগ। তখনও রাস্তায় অফিস ফেরতা লোক। ছাতা কম লোকের হাতেই। সবেমাত্র ইফতার শেষ হয়েছে। রাস্তা ফাঁকা। রিক্সা নেই বললেই চলে। অটোরিক্সা নেই। বাস দু’ একটা আছে। কিন্তু উঠতে গেলে জলে ভিজতে হচ্ছে সবাইকে। শান্তিনগর আসতে দেখলাম যেখানে আগে জল জমত না, এখন সেখানেও জল। মানুষ জলের মধ্যেই বাড়িমুখী এটা বুঝলাম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামনে, সেখানকার ছয়রাস্তার আশপাশ, সেগুনবাগিচার রাস্তাঘাট জলে থৈ থৈ। বিজয়নগরও জলে থৈ থৈ। এর মধ্যেই মানুষের চলাচল। প্রাইভেট কার জলে বসে গেছে। অটো জলে ডুবে গেছে। রিক্সা ভেঙ্গে নারী-পুরুষ রাস্তায় জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। বলাবাহুল্য, সরকার জল নিষ্কাশনের জন্য গভীর থেকে গভীরতর করে কংক্রিট দিয়ে ‘কভার্ড ক্যানেলের’ মতো করেছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। ফলে রাস্তায় জল আগের চেয়ে বেশি। এর জন্যই বলছিলাম, খরা ও গরম হলেও বিপদ, অতিবৃষ্টি হলেও বিপদ। এই বিপদে, এই দুঃখে আর আবগারি শুল্কের কথা মনে থাকে না। অথচ এটিই এখন সংসদের কথা, মানুষের মুখে মুখের কথা। কত লোক প্রশ্ন করছে আমাকে তার হিসাব নেই। আমি বলছি, এতদিন পরে আপনাদের খবর হলো। সরকার তো আমানতের ওপর এক্সাসাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক কাটছে অনেকদিন থেকে। মানুষের সমালোচনা লাখ টাকার ওপর কেন আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলো। অনেকে খবরই রাখে না এক লাখ এক টাকা থেকে তার ওপরের সকল আমানতেই শুধু আবগারি শুল্ক ধার্য করা নেই, তার নিচের পরিমাণ আমানতেও আবগারি শুল্ক চাপানো আছে। বিশ হাজার এক টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতে আবগারি শুল্ক নির্ধারিত আছে ২৫০ টাকা। অনেক দিন থেকে। যেহেতু এর ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়নি তাই সমালোচনা নেই। এখন প্রশ্ন : এক লাখ এক টাকার ওপর শুল্ক বসলে যদি অন্যায় ও অবিচার হয়, তাহলে বিশ হাজার এক টাকার ওপর আবগারি শুল্ক থাকলে তাকে কী বলা হবে? মুশকিল হচ্ছে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অর্থাৎ যেসব এ্যাকাউন্টে লেনদেন আছে তাতে অনেক কর নানা নামে চাপানো আছে। সরকার শুধু আবগারি শুল্কই কাটে না, সরকার অগ্রিম আয়করও কাটে। এবং তা ১০-১৫ হারে। এটাও অনেকদিন থেকে। এই আয়কর ধার্য হয় সুদের ওপর। আবগারি শুল্ক এ্যাকাউন্টের ব্যালেন্সের ওপর। আবগারি শুল্ক চেকবই ইস্যু করলেও দিতে হয়। আবার রয়েছে ব্যাংকের উৎপাত। ব্যাংক সার্ভিস চার্জ কাটে প্রতি এ্যাকাউন্টে। কেউ টের পায়, কেউ টের পায় না। ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট বছরে দুইবার দেয়া বাধ্যতামূলক। তারা তা দেয় না অথচ স্টেটমেন্ট চাইলে টাকা কাটে। অনেকে এ খবর জানে না। কাজেই প্রতিবাদও নেই। বস্তুত ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে কী? মানুষ এসব নিয়ে আগে ভাবত না। কারণ সঞ্চয়কারীরা আমানতের ওপর মোটামুটি পরিমাণের একটা সুদ পেত। এই নিয়েই সবাই সন্তষ্ট ছিল। এখনও আমানতের ওপর কার্যত কোন সুদ নেই। কারণ মূল্যস্ফীতির হার সুদের হারের চেয়ে বেশি। অবস্থা এমন যে, ব্যাংকে টাকা রাখলে উল্টো ব্যাংককে পয়সা দিতে হয়। মিডিয়া অবিরতভাবে এ রিপোর্ট করছে। হঠাৎ মানুষ দেখে তাই তো! ব্যাংক তো কোন সুদ দিচ্ছে না। দল বেঁধে তারা ক্রমাগতভাবে সুদের হার কমাচ্ছে, অথচ তারা খেলাপী ঋণ-কমাতে পারছে না। এটা করতে পারলে আমানতের ওপর এমন নির্দয়ভাবে সুদ কমাতে হতো না। যখন মানুষ জানতে পারল তারা ক্ষেপে লাল হয়েছে। ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ পড়ার মতো অবস্থা। সুদ দেয় না অথচ আবগারি শুল্ক কেটে নেয়। এবারের বাজেট কার্যত একটা বড় অস্বস্তিকর বাজেট হয়েছে। ভাল কাজ, প্রকল্প বাজেটে কী আছে তার আলোচনায় এবার কেউ নেই। সবাই আবগারি শুল্ক নিয়ে ভাবিত। অথচ কেউ দেখছে না যে, কৃষি উপকরণের দায় বাড়বে। অবাক করা ঘটনা। একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। তার মানে? মানে খুব সহজ। অর্থ মন্ত্রণালয় বেশকিছু পণ্য ও দ্রব্যে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে। এই অব্যাহতির তালিকায় ‘পাওয়ার টিলার’, ‘হারভেস্টার’, ‘রাইস রিপার’ ও ‘ট্রাক্টর’ নেই। অথচ এসব ক্রয়ে কৃষককে ভর্তুকি দেয়া হয়। কেন দেয়া হয়? দেয়া হয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। কৃষককে সহায়তা প্রদান করা হয়। এটি একটি মাত্র উদাহরণ। প্রতিদিন এমন খবর ডজন ডজন ছাপা হচ্ছে। ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ হলে কোন্্ কোন্্ শিল্পপতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কোন্্ কোন্্ ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, রফতানিতে কী প্রভাব পড়বে, সাধারণ মানুষের কী ক্ষতি হবেÑ এসব খবর প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে। গার্মেন্টের দরিদ্র মেয়েরা ইমিটেশন জুয়েলারি পরে, নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমনকী মধ্যবিত্ত মহিলারাও পরে। কেউ পরে সোনার অলঙ্কার কিনতে পারে না বলে, কেউ পরে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ভয়ে। উভয় ক্ষেত্রেই এটা মধ্যবিত্ত ও গরিবের একটা পণ্য। এর দাম বাড়বে। প্রিন্টিং প্রেসের অবস্থা খারাপ হবে বলে প্রিন্টার্সরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। প্রতিদিন শিল্প ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা নানা ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এতে পরিষ্কার, এই বাজেট বিবেচনায় এবার অন্য কোন বিষয় নেই। সবার কাছে বাজেট হয়ে দাঁড়িয়েছে আতঙ্কের বাজেট। সবার আশঙ্কা জিনিসপত্রের দাম পহেলা জুলাই থেকে বাড়বে। বিপরীতে মানুষের আয় কমছে। একটা বড় প্রমাণ সুদ আয়। সুদ আয় তিন ভাগের এক ভাগ হয়েছে। তার ওপর আবগারি শুল্ক, অগ্রিম আয়কর এবং সার্ভিস চার্জ। মানুষ ধরে নিয়েছে বাঁচার আর পথ থাকবে না। গ্যাসের দাম বেড়েছে, খবরের কাগজে এর দাম আরও বাড়বে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসছে গ্যাস বিলের ওপর। বিদ্যুত বিল বাড়বে। তাও ১৫ শতাংশ হারে। ওয়াসার বিল বাড়বে। বাড়বে প্রচুরসংখ্যক পণ্য ও দ্রব্যের দাম। যেসব পণ্যকে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে বাজারের চালু পণ্য নয়। এখানে একটা চাতুরি করা হয়েছে বলে ‘মিডিয়া’ মতপ্রকাশ করছে। সব মিলিয়ে মানুষ ধরে নিয়েছে আরেক দফা পণ্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। কী প্রেক্ষাপটে তা আবার ঘটবে? এই সেইদিন এক দফা জিনিসের দাম বেড়েছে। তা বেড়েছে রোজার ঠিক আগে থেকেই। শুনেছি অনেক দেশে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে মানুষকে ছাড় দেয়। কম দামে পণ্য বিক্রি করে। আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। অথচ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। আবার ঈদের সময় বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, এমন কী অত্যাচারী ব্যাংকগুলো তথাকথিত ‘কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি’ (সিএসআর) করতে যায়। শাড়ি-লুঙ্গি, জামা-কাপড় ও ক্যাশ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে ছবি তুলে, টেলিভিশনে দেখায়। শুনেছি ধর্মীয় বিধান হচ্ছে এক হাতে দান করলে অন্য হাত যাতে তা না জানে। এখানেও দেখছি ঠিক উল্টো চিত্র। আসলে ‘সিএসআর’-এর মতো ঠকামি আর কিছু নেই। মানুষ তো দান-দক্ষিণা চায় না। শাড়ি, লুঙ্গি, নগদ টাকা চায় না। তারা চায় ন্যায্যমূল্যে পণ্য ও সেবা। লাভ ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু অনৈতিকভাবে ব্যবসা করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন তো আইনগতভাবে এবং নৈতিকভাবে কাম্য নয়। ছোলা, চিনি, লবণ, সয়াবিনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে ‘সিএসআর’ করতে যাওয়াটা কী কাম্য ঘটনা? নিশ্চয়ই নয়। এসব দেখেশুনে মানুষ দিন দিন ভীত হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত মানুষের আরও মজুরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে বাজারকে স্থিতিশীল করা। বিশেষ করে চালের দাম। এটা সঙ্কটাবস্থা যাতে সৃষ্টি না করে তা আশু কর্তব্য। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×