ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তবু ঘরে ফেরা

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৬ জুন ২০১৭

তবু  ঘরে ফেরা

ঈদ উদযাপনে নিরাপদে ও নির্বিঘেœ ঘরমুখো হওয়ার নিশ্চয়তা তেমন মেলে না। শত সহস্র দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা সহ্য করে, কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের পর বাড়ি ফেরার আনন্দ তবু পায় মানুষজন। ঈদ মানেই তাদের কাছে প্রিয়জনের সান্নিধ্য। তাই যে কোন মূল্যে শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ ছেড়ে গ্রামমুখো কিংবা অন্য শহরমুখো হওয়ার মধ্যেই যেন মনের আনন্দ, প্রাণের উচ্ছ্বাস জেগে ওঠে। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতিটা শুরু হয় রমজান মাসের গোড়াতেই। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরে ফেরার সব আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য সে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টা চলে। ঝড়-বৃষ্টিতে মধ্যরাত থেকে দীর্ঘ লাইন দিয়ে টিকেট কেনা। কোন কোন ক্ষেতে আবার বাড়তি ভাড়ায়। মূল ভাড়ার দ্বিগুণ, তিনগুণ হলেও টিকেট প্রাপ্তির আনন্দ বুঝি অপরিসীম। যেন এ এক ধরনের বিজয় অর্জন। লঞ্চ, বাস ও ট্রেনযাত্রীরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকার পরও অনেক ক্ষেত্রে সামনের কয়েকজন টিকেট পাওয়ার পর পেছনের যাত্রীদের ‘টিকেট শেষ’ লটকানো সাইন বোর্ড দেখা এবং পাশে টিকেট কালোবাজারির ফিসফিসিয়ে বাড়তি দাম দিলে পাবেন ভাষ্য শোনা চিত্রগুলো পুরনো, এনালগ যুগের। আর এই ডিজিটাল যুগেও এসব দৃশ্যপটের কোন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট না পাওয়ার ব্যর্থতায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ে। কিন্তু কিছুই করার নেই। কারণ এই একটা সময়, যখন যাত্রীরা জিম্মি হয়ে যায় পরিবহন ব্যবসায়ীদের দাপটের কাছে। আগাম টিকেট ব্যবস্থা চালু হলেও টিকেট প্রাপ্তি যেন মহার্ঘ লাভ; কিন্তু তাও হাতেগোনা যাত্রীর ভাগ্যেই জোটে। যতই কর্তাব্যক্তিরা হাঁকডাক দেন প্রতিবছরÑ এবারের ঈদে ঘরমুখো মানুষের কোন কষ্ট হবে না, যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, বাড়তি ভাড়া নেয়া হবে নাÑ এসবই বাহুল্য চর্চিত মুখরোচক কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবে এসব নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা আর প্রদর্শিত হয় না। বছরের পর বছর একই চিত্র চলতে থাকার ফলে ঈদে ঘরে ফেরার অর্থ দাঁড়ায় একগাদা দুর্ভোগ, সঙ্কট এবং দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তা। আর এবারের ঈদে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়তে বাধ্য। আগের মাসের বর্ষণ সেই জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বহাল থাকছে আরও বেশ কিছুদিন। তদুপরি রাস্তাঘাট জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত শুধু নয়, বহু স্থানে সড়কের বেহাল অবস্থার মাত্রা তীব্র। সাংবাৎসরিক সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি অসহনীয় অবস্থাকে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলেছে। যানজটে এমনিতেই নাকাল হতে হয়। তার ওপর সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টির কারণে খানাখন্দগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কপথের করুণ অবস্থা দুর্ঘটনা ডেকে আনে। জনসংখ্যা হ্রাসে সড়ক পরিবহন যে দক্ষতা প্রদর্শন করে বছরব্যাপী, ঈদে এর মাত্রা আরও বাড়ে। দেশের প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক যানচলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে বৃষ্টির কারণে। তার ওপর রয়েছে ফিটনেসবিহীন যানের আধিক্য। বাসের ছাদে যাত্রীদের গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়া মানে দুর্ঘটনাকে ডেকে আনা। রেলের অবস্থা তেমন ভয়াবহ না হলে বর্ষণজনিত কারণে বহু স্থানে রেললাইনের অবস্থা নড়বড়ে। টিকেট কিনেও বগিতে ঠাঁই মেলে না। আশ্রয় নিতে হয় ছাদে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ। নৌপথের অবস্থা কম ভয়াবহ নয়। বহন ক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো যেভাবে ছুটে চলে, তা দুর্ঘটনার আশঙ্কাকে সামনে আনে। অধিক ভাড়ার টিকেট কিনে লঞ্চে কোনরকমে আশ্রয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আর বর্ষা মৌসুমে নদী ভয়ঙ্করভাবে ফুঁসে উঠেই। লাখ লাখ বাড়তি নৌযাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে অকেজো পরিত্যক্ত নৌযানগুলোকে কোনরকমে মেরামত ও রং লাগিয়ে যাত্রী পরিবহন যখন করে, তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। আনন্দ উদযাপনে ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষ স্বস্তির আশায় তবু থাকে। কিন্তু পুরোপুরি হবে তার যাতায়াতে স্বস্তি, নিরাপত্তা? বরং অব্যবস্থার বহরটা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে। জীবন বাজি রেখে তবুও ঘরে ফিরতে হয়।
×