ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের নতুন পোশাক বুটিক কারচুপির বাহারি কাজ

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১৫ জুন ২০১৭

ঈদের নতুন পোশাক বুটিক কারচুপির বাহারি কাজ

তাহমিন হক ববী ॥ ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন পোশাক। তাই ঈদের নিত্যনতুন ডিজাইনের তৈরি পোশাকে উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা শহরজুড়ে বুটিক শিল্পের কারিগররা এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা একনাগাড়ে কাজ করে চলেছেন। বিভিন্ন কাপড়ে পাথর বসিয়ে নক্সা তৈরিতে ব্যস্ত। কয়েক হাজার বুটিক নারী ও পুরুষ কারিগর মেশিন ছাড়াই, ঘরের মেঝেতে বসে কাঠের পাটাতনে বেঁধে শাড়ি, থ্রি পিস ওড়নায় বাহারি রঙের নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর পাথর বসিয়ে নক্সা তৈরি করছেন। ঈদ উৎসব ঘিরে সৈয়দপুর উপজেলা শহর হতে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে কারচুপি ও বুটিক শিল্প। এখানে মেশিনে কোন কাজ হয় না। বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকের পছন্দ হতে পারে এমন নক্সায় পাথর বসিয়ে শাড়ি বা থ্রি-পিস সরবরাহ করা হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ডার নিয়েও কাজ করে সরবরাহ করা হয়। কাপড় ও কাজের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন ছফুরা সিল্ক এক নম্বর কাপড়ের শাড়ি সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার টাকা। আবার ডিজাইনভেদে ১৫ হাজার টাকাও একেকটি শাড়ির দাম পড়ে। মাসব্যাপী মাহে রমজানের অর্ধেক দিন পার হয়ে যাওয়ায় এসব কাজের কর্মব্যস্ততা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সম্প্রতি সৈয়দপুরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ-উল-ফিতরে ঢাকার ঈদ-বাজারে চাহিদা মেটাতে নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৩০ হাজার নারী ও পুরুষ চালিয়ে যাচ্ছেন হাতের কাজের কারচুপির এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। রোজার ছুটি চলছে স্কুল-কলেজে, এ সুযোগে বাড়তি আয়ের আশায় উপজেলার মেয়ে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে এই কাজে। সৈয়দপুর শহরের উত্তরা আবাসন প্রকল্পে দেখা যায়, শত শত নারী কাপড়ে কারচুপি বসাচ্ছেন। বিশেষ ফ্রেম পেতে তাতে টান টান করে কাপড় বসিয়ে আপনমনে কারচুপি বসিয়ে যাচ্ছেন তারা। সেখানে কথা হয় উত্তরা আবাসন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী কোমলের সঙ্গে। সে বলে, রোজা উপলক্ষে স্কুল ছুটি। তাই বোনের সঙ্গে কারচুপির কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এতে বাড়তি কিছু আয় হবে। কোমলের বাবা বেঁচে নেই। তার মা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। ঈদের কারচুপির কাজ করে ১০ হাজার টাকা আয় করবে সে। যা দিয়ে মা-ভাইবোনের জন্য কিনবে ঈদ উপহার। আবাসন এলাকায় কথা হয় কারচুপি শিল্পী পারভিন আক্তারের (৩৫) সঙ্গে। হোটেল শ্রমিক আমিনুর রহমানের স্ত্রী তিনি। কাজ করছিলেন মেয়ে বৃষ্টি (১৭) ও ঝর্ণাকে (১৩) সঙ্গে নিয়ে। তিনি বলেন, সারা বছরই কারচুপির কাজ চলে। তবে ঈদ এলে এর চাপ বেড়ে যায়। রোজার মাস। তাই স্কুল-কলেজ বন্ধ। এ সুযোগে মেয়েদেরও সঙ্গে নিয়েছি। কারচুপির কাজ করে তারাও বাড়তি আয় করবে। সৈয়দপুর শহরের কাজিহাট, মুন্সিপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, বাঁশবাড়ী, হাতিখানা, নতুন বাবুপাড়া, ইসলামবাগ, গোলাহাট, রসুলপুর, বার্মাসেল প্রভৃতি মহলার বাড়ি বাড়িতে চলছে কারচুপি পোশাক তৈরির কাজ। এছাড়া উপজেলার কামারপুকুর, বোতলাগাড়ি, বাঙ্গালিপুর, কাশিরাম বেলপুকুর, খাতা মধুপুর ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামেও নারী শ্রমিকরা প্রচুর কাজ করছেন। কারচুপি শিল্পী রোশনি বলেন, এ কাজে সৈয়দপুরের শ্রমিকরা দক্ষ। তাই ঢাকা থেকে প্রচুর অর্ডার মেলে। প্রতি মাসে হাজার হাজার শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিসের অর্ডার আসে। আর ঈদ এলে তো কাজের ফুরসতই থাকে না। চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণে। তিনি জানান, মহাজনেরা ঢাকা থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে কাপড়, উপকরণ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। তারা কেবল কারচুপির কারুকাজ করে দেন। মহাজন আরমান আলী, মোঃ তারেক ঢাকা থেকে ই-মেইলে অর্ডার নিয়ে পরে নকশা (ডিজাইন) বুঝিয়ে দেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের। ঘরে ঘরে গিয়ে দিয়ে আসেন জর্জেট বা শিফন কাপড়ের থান, বিভিন্ন রকম চুমকি, রেশমি সুতা, গাম ইত্যাদি। কাপড়ে চুমকি করতে এসব উপকরণের দরকার হয়। মহাজনের অর্ডার পেলেই শ্রমিকরা রাত-দিন ব্যস্ত হয়ে পড়েন কারচুপির কাজে। তিনি বলেন, কাপড়ে কারচুপি বসিয়ে একজন নারী শ্রমিক দিনে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করেন। কারচুপির কাজে দেখা যায় কাঠের ফ্রেমের চার মাথায় আটকানো শাড়ি ও থ্রিপিস। শিল্পীরা নিপুণ হাতে কারচুপির কাজ করে চলেছেন। একটা একটা করে পুঁতি, জরি, সুতা ও চুমকি দিয়ে শাড়ি ও জামায় নক্সার কাজ চলছে। কখনও নিজের পছন্দে, আবার কখনও বা ক্রেতার পছন্দে কারিগররা নিপুণ হাতে কাজ করে চলেছেন। শুধু উত্তরা আবাসন এলাকায় নয়, ২২টি পাকিস্তানি ক্যাম্পের শত শত পরিবারের সদস্যরাও এ কাজ করছে। একটি কামিজের গলায় ও হাতে কারচুপির কাজ করতে দু-তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ভালমানের শাড়িতে কাজ করতে দুদিন সময় লাগে। সৈয়দপুর কারচুপি সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, ঢাকার বড় বড় শপিং সেন্টার ও মার্কেটে সৈয়দপুরের কারচুপির পোশাক বিক্রি হয়। বিয়ে, ঈদে এ পোশাকের অনেক চাহিদা। তিনি আরও জানান, এ সময় সৈয়দপুরের ৩০ হাজার নারী শ্রমিক কারচুপির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
×