ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে আফগানিস্তান

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ১৪ জুন ২০১৭

ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে আফগানিস্তান

গত ৩১ মে কাবুলে সন্ত্রাসীদের একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে কমপক্ষে ৯০ জন নিহত ও ৪শ’ জনেরও বেশি আহত হয়। উনিশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি দুর্গ যেখানে আফগান প্রেসিডেন্টের অফিস ও বাস ভবন দুটোই অবস্থিত সেখানে এই বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ এতই প্রচ- ছিল যে সংলগ্ন একটি ব্যস্ত সড়কে ১৩ ফুট গভীর গর্ত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পূর্ণ হয়ে যায়। বিভিন্ন ভবনের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়। ধাতব কাঠামোগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায়। আফগানিস্তানে এত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা আর কখনও হয়নি। সন্ত্রাসী নির্মূলের নামে ১৫ বছর আগে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা ও দখলদারী শুরু হয়েছিল। ৩১ মের বোমা বিস্ফোরণ বেশ ভালভাবেই স্মরণ করিয়ে দিল যে সেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ স্তিমিত হওয়া তো দূরের কথা বরং সেই যুদ্ধ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। আফগান যুদ্ধই হলো বিদেশের মাটিতে জড়িয়ে পড়া আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ। দেশটির পরিস্থিতি যে উত্তরোত্তর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে নিচের কিছু পরিসংখ্যান থেকে তার পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। গত বছর আফগানিস্তানের সংঘর্ষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার সিভিলিয়ান নিহত হয়েছে যার প্রায় এক হাজারই হলো শিশু। এক বছরে এত বেশি সিভিলিয়ান নিহত হওয়ার রেকর্ড আর নেই। তালেবান, আইসিস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ দেশের ৪০৭টি জেলার মধ্যে মাত্র প্রায় ৬০ শতাংশ জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। প্রায় ৩০ লাখ আফগান বা জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবাধীন এলাকায় বাস করে। আমেরিকা সারাবিশ্বের যে ৯৮টি সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে ২০টি সংগঠন আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় তৎপর। ২০০৯ সাল থেকে সিভিলিয়ান হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। লড়াই প্রায় সর্বক্ষণিক রূপ ধারণ করেছে। আফগানিস্তানে এখন বিদেশী সৈন্য আছে ১৫ হাজার। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪০০ আমেরিকান। বাকিরা ন্যাটোর। তবে এই সৈন্য সংখ্যা আরও বাড়ানোর আয়োজন চলছে। কিন্তু পরিস্থিতির যেভাবে ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে তাতে বাড়তি সৈন্য আনলে খারাপ ছাড়া ভাল হবে না। জানা গেছে আমেরিকা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার বাড়তি সৈন্য পাঠাবে। এটা ওবামা যুগ থেকে একটা ব্যত্যয়। ওবামা প্রশাসন ক্রমান্বয়ে সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছিল। আর ট্রাম্প ঠিক তার উল্টো পথে চলেছেন। কিন্তু তাতে কি কোন লাভ হবে? ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে ২ হাজার ২০০ মার্কিন সৈন্য নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার আহত হয়। আফগানিস্তানের সরকারী বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। এই দেশী-বিদেশী সৈন্য মিলে সন্ত্রাসী তৎপরতা কিছুতেই রোধ করতে পারছে না। গত ১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ২১ হাজার টন ওজনের মহাশক্তিশালী বোমা ফেলে। এতে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের একটি গুহা কমপ্লেক্সে অবস্থানকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইসিস নেতা নিহত হয়। কিন্তু তার পরও এই সংগঠনের শত শত ভয়াল যোদ্ধা কমে গেছে। আফগানিস্তানে আল কায়েদা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে। তালেবানদের শক্তি তো যথেষ্টই বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির ভাষায় আফগানিস্তান এখন একটা ফ্রন্টলাইন। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ কিংবা আল্লাহ না করুক অর্ধাংশ যদি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং সেটাকে যদি ঠেকিয়ে রাখতে না পারা যায় তাহলে কেউই নিরাপদে থাকতে পারবে না। সেই ১৯৭০ দশকের শেষভাগে সোভিয়েত দখলদারীর সময় থেকে যুদ্ধ চলছে আফগানিস্তানে। অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। মার্কিন দখলদারীর এক পর্যায়ে দেশটিতে ঢালাও বৈদেশিক সাহায্য আসায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালে তা ১৪ শতাংশেরও বেশি দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেই সাহায্য এখন ব্যাপক পরিসরে হ্রাস পাওয়া ২০১৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশেরও কমে নেমে আসে। আফগানিস্তানের চারপাশে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, রাশিয়া, চীন ও ইরান। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ। দেশটির স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা পাকিস্তান। কারণ এই পাকিস্তান তালেবানসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী শক্তিকে মদদ দিয়ে চলেছে। দেশে স্থিতিশীলতার লেশমাত্র না থাকায় সাম্প্রতিককালে সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে জনগণের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। দুর্নীতি লাগামহীনভাবে চলছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে আফগানরা দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে মস্ত বড় সমস্যা বলে মনে করে। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির মধ্যে গত বছর দেশটিতে আফিম উৎপাদন ৪০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা বেআইনী আফিম ব্যবসা থেকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ পাচ্ছে। আফগানদের একটা বড় অংশ মনে করে যে দেশটা ধীরে ধীরে নরকের পথে এগিয়ে চলেছে। সূত্র : টাইম
×