ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

সাফল্যের সোনারোদে বাংলাদেশের ক্রিকেট

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৪ জুন ২০১৭

সাফল্যের সোনারোদে বাংলাদেশের ক্রিকেট

কপিল দেবের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে ভারত ও অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয় ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনগুলোর মধ্যে শীর্ষে। এ দুটি বিশ্বকাপে ক্রিকেট দেখেছিল দুটি নতুন পরাশক্তির উত্থান। ’৮৩-র বিশ্বকাপ জিতে ভারত ও ’৯৬-র বিশ্বকাপ জিতে শ্রীলঙ্কা বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয়। ভারত, শ্রীলঙ্কার পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশও বর্তমানে ক্রিকেটের পরাশক্তি! গত কয়েক বছর ধারাবাহিক দুর্দান্ত পারফরমেন্স প্রদর্শন করে সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা জানিয়ে দিয়েছেন, হেলাফেলার দিন শেষ। ইংল্যান্ডে চলমান আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনালে নাম লিখিয়ে আরেকবার নিজেদের প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। এখন টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলার স্বপ্নে বিভোর গোটা জাতি। আইসিসির এ আসরে সারা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি, সাকিবরা। অথচ ২০০৯ ও ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ হয়নি র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকার কারণে। এবার অনেক আগেই ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের সপ্তম স্থান দখল করে এ মর্যাদার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ দল। সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে গেছে সেমিফাইনালে। ‘এ’ গ্রুপে টাইগারদের পেছনে পড়ে থেকে ছিটকে গেছে গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও রানার্সআপ নিউজিল্যান্ড। আইসিসির কোন টুর্নামেন্টে এই প্রথম সেমিফাইনালে উঠে সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে টাইগাররা। প্রত্যাবর্তনেই দেখিয়েছে সেরা সাফল্য। ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। আইসিসি ট্রফিতে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাফল্য পায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এরপর নিজেদের শক্ত ভিতে দাঁড়ানোর জন্য অনেক সংগ্রাম ও সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে ওই সাফল্য দেশের ক্রিকেটকে এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে দেয়। ২০০০ সালে সেই সুবাদে টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা প্রাপ্তির হিসেবে আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়ে যায় বাংলাদেশ। মূল লড়াইটা তখন থেকেই শুরু। ওয়ানডে ক্রিকেটে নিয়মিত খাবি খেতে থাকা দলটি টেস্ট ক্রিকেটে যেন মহাসমুদ্রে পড়ে গিয়েছিল। এমনকি ২০০৪-০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল প্রতিপক্ষ ছিল কেনিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মতো সহযোগী সদস্য দেশগুলো। সেটার প্রমাণ ১৯৯৯ সালেও দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজন করে দর্শক হয়ে কেনিয়া-জিম্বাবুয়ের ফাইনাল দেখেছিল দেশের ক্রিকেটাররা। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে কানাডা ও বারমুডার সঙ্গে একটি সিরিজ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। সবগুলো ম্যাচেই জিতেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে কানাডার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১৩ রানের জয় পায়। প্রথম কোন আসরের ফাইনাল খেলার সুযোগ করে নেয় টাইগাররা ২০০৯ সালে ঢাকায় আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে। জিম্বাবুয়ের কাছে হারলেও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। কিন্তু ফাইনালে হারতে হয় বাংলাদেশ দলকে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে ২ উইকেটে হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয় টাইগাররা। আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আরেকটি ফাইনাল খেলার জন্য। এটিই সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট ছিল যার ফাইনালে প্রথমবার ওঠে সবাইকে বিস্মিত করে বাংলাদেশ দল। ২০১২ এশিয়া কাপে ভারত, শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে ফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়। তবে মাত্র ২ রানে হেরে সেবার ট্রফি হাতছাড়া করে স্বাগতিক বাংলাদেশ। এখান থেকেই নতুন করে শক্তিশালী একটি দলে পরিণত হতে শুরু করে টাইগাররা। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে আইসিসির কোন টুর্নামেন্টে সেরা সাফল্য পায় বাংলাদেশ দল। ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়। ২০১৬ সালের টি২০ এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে। এবারও ভারতের কাছে হেরে যায়। একই বছর টি২০ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলতে থাকা দলটি মাত্র ১ রানে ভারতের কাছে হেরে ছিটকে যায়। এবার সব সাফল্যকে ছাপিয়ে আইসিসির কোন টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ দল। সহযোগী সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে হওয়া আইসিসি ট্রফির শিরোপা জয়ী দল ২০ বছর পর শুধু পূর্ণাঙ্গ দেশগুলোর টুর্নামেন্টই নয়, বরং বিশ্বের সেরা আট দলের আসরে শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছে। র‌্যাঙ্কিংয়ের অবস্থান সেরা আটে না থাকলে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া যায় না বলে দারুণ মর্যাদাপূর্ণ এ আসর। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত সর্বশেষ আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকা শীর্ষ আট দলই এবার ইংল্যান্ডে চলমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ সে সময় ৭ নম্বরে ওঠে আসে। অথচ এ দলটি র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ নম্বরে থাকার কারণে ২০০৯ ও ২০১৩ সালের টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারেনি। তবে এবার টাইগারদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই। মাত্র কয়েক দিন আগে ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়ার কারণে র‌্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বরে উঠে এসে আরেকবার তাক লাগিয়েছিল। সে কারণে কেউ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশকে আর আন্ডারডগ মানতে পারছিলেন না। অনেকেই বলছিলেন এবারের আসরে ‘ডার্ক হর্স’ টাইগাররা। তবে সেটার যথার্থ প্রমাণ দিতে পারেনি বাংলাদেশ শুরুতে। ইংল্যান্ডের কাছে ৩০৫ রান করার পরও হেরে গিয়েছিল। তাই সবাই আবার ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক বাজিকররা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেমিতে ওঠার বাজির দর রেখেছিল ৫০০০-১। ভাগ্যটা সহায় হয়েছে পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এক পয়েন্ট পাওয়ার মাধ্যমে। বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় ওই এক পয়েন্ট পায় বাংলাদেশ। শেষ গ্রুপ ম্যাচে অবিস্মরণীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারানোর মাধ্যমে সেমিতে ওঠার সম্ভাবনা জোরালো করে। সেটি ছিল ঐতিহাসিক কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে। এ মাঠেই ২০০৫ সালে প্রথমবার মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ দল। শেষ গ্রুপ ম্যাচে অজিরা স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়াতে সেমি নিশ্চিত হয় টাইগারদের। তবে গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে এবার দ্বিতীয় সেমি খেলতে হবে বার্মিংহামের এজবাস্টনে। পয়া ভেন্যু কার্ডিফ মিস হয়েছে টাইগারদের। তবে নিজেদের সেরা সাফল্য পেয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বে শোরগোল তৈরি করেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। টুর্নামেন্টে দুই আসর পর ফিরেই নিজেদের সক্ষমতা, সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভাসিয়ে চলেছেন অনেকে। পাকিস্তানী অলরাউন্ডার আফ্রিদি টুইটারে বলেন, ‘দারুণ লড়াই করে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ এবং মাহমুদুল্লাহ ও সাকিবের অসাধারণ জুটি। আসলেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এখনও বেঁচে আছে।’ সাবেক কিউই অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম বলেন, ‘শাবাশ বাংলাদেশ। কঠিন চাপে পড়েও সাহসিকতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দুর্ভাগ্য আমার দলের। এমনটা যেন আর না হয়।’ বাংলাদেশ দলের স্পিন উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কয়েক দফায় খ-কালীন কাজ করেছিলেন কিংবদন্তি পাক অফস্পিনার সাকলাইন মুশতাক। তিনিও প্রশংসা করলেন বাংলাদেশ দলের, ‘দুর্দান্ত জয়ের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন।’ গত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে বেশ পরিচিত। কারণ গত বছরও তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল) খেলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘অসাধারণ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের। দারুণ ব্যাটিং করেছে সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ। দুর্দান্ত লড়াই ও কর্মশক্তির পরিচয় দিয়েছে তারা।’ সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেন বর্তমানে ধারাভাষ্যকার হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘পরাক্রমশালী বাংলাদেশ ছিটকে বের করে দিল নিউজিল্যান্ডকে।’
×