ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংযমহীন রোজার বাজার

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৪ জুন ২০১৭

সংযমহীন রোজার বাজার

রমজান। পরিশুদ্ধ হওয়ার একটি পবিত্রতম মাস। হিজরী সনের নবম মাসটি মুসলিম সম্প্রদায়কে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানায়। রমজানের পুরো মাসজুড়ে গোটা মুসলিম বিশ্ব থাকে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত। উদ্দেশ্য এই সুযোগে নিজেদের পাপশূন্য করে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করা। সারা বছরের মন্দ কাজে আড়ষ্ট মানুষ রোজা পালনের মাধ্যমে নিজেদের শুদ্ধময় স্থানে নিয়ে যাওয়ার একটি বড় সুযোগ পেয়ে যায় পবিত্র রমজান মাসে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে রোজা। এটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য ফরজ এবং অবশ্য পালনীয়। রমজান শুভ, সুন্দর ও কল্যাণের শিক্ষা দেয়। সকল মানুষকে মঙ্গলজনক ময়দানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা, চলাফেরা, কাজকর্ম তথা মানবজীবনের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন অর্থাৎ পবিত্রতার পথে হাঁটার দিকনির্দেশনা নিহিত রয়েছে সেখানে। মুসলমানদের জন্য অতি উত্তম এ মাসটি সর্বোপরি সকলকে কল্যাণকামী বার্তা পৌঁছানোর সর্ববৃহৎ সন্ধান দিয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মের বিধি অনুসারে মুসলমানরা ঊষাকালের সামান্য পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে উপবাস পালন করে থাকে তার অন্য নাম হচ্ছে রোজা। যাকে আরবীতে সিয়াম, ফারসীতে রোজা আর বাংলায় সংযম বলা হয়। আমরা যে ভাষায়ই রোজার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করি না কেন তার সারমর্ম এক এবং অদ্বিতীয়। সিয়াম সাধনার পুণ্যময় মাসে বাঙালী কতটা সওয়াব অর্জন করতে পারছে। এ দেশে একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা সৎকর্মের বিপরীতে গর্হিত কাজে সর্বদা লিপ্ত রয়েছে। রমজানে সংযমী হওয়া তো দূরের কথা উল্টো অসাধু পথে অহর্নিশ বিচরণ করছে। হাট-বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিপণি বিতানগুলোতে চলছে নিন্দনীয় কাজের মহরত। রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে উর্ধগতি ও পোশাক-পরিচ্ছদের দোকানে থাকে তিন থেকে চারগুণ দাম বাড়ানোর অহেতুক প্রতিযোগিতা। তাদের কাছে বছরে ওই একটি সুযোগই যেন মুনাফা অর্জনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। এবার হাওড়ের ফলন তলিয়ে যাওয়ায় চালের বাজার এমনিতেই উর্ধমুখী। এছাড়াও ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, তেল, সবজি ও মাংসের দরে ভোক্তাবিমুখ অবস্থা। যেমন দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ চিনি মজুদ আছে, আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কম। তবু কৌশলে চিনির দর বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ছোলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। সোজা কথায় ক্রেতা ঠকানোর মহোৎসব লক্ষ্য করা যায় পুরো রমজানজুড়ে। বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় ব্যবসায়ীরা মূল্যছাড় ও দাম কমানোর কাতারে শামিল হয়। সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্য তালিকা মেনে চলেন সবাই। বিবিসির সংবাদ অনুযায়ী, গত বছর রমজানের আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন পণ্যের দাম কমিয়েছে। কাতার সরকার রমজান উপলক্ষে এবার দেশটিতে ৪১৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিয়েছে। এই তালিকায় চাল, ময়দা, দুধ, দই, মাংস, সাবান, আচার, শুকনো ফল, হিমায়িত পণ্য রয়েছে। আর এ তালিকার বাইরে আরও এক হাজার চার শ’রও বেশি পণ্য রয়েছে, যেগুলো ন্যায্য দামে বিক্রি করতে বিক্রেতাদের আহ্বান জানিয়েছে দেশটির সরকার। রমজান উপলক্ষে কাতারের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আল মিরা কনজ্যুমার গুডস কোম্পানি তাদের দেশজুড়ে থাকা ৩৫টি শাখার মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে এক হাজার ৪৩৮টি ভোগ্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে। পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরাও রোজায় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রধান ভারতের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রোজায় পণ্যমূল্যে ছাড় দিচ্ছে। শুধু মুসলিম রাষ্ট্রই নয়, অমুসলিম অনেক দেশেই রমজানে ছাড় দেয়ার মানসিকতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ তার বিপরীত। সরকার নিয়ম-নীতি বেঁধে দিলেও মানা হচ্ছে না এক আনাও। বরং দাম হাঁকানোর বাড়তি প্রতিযোগিতায় নামেন এ দেশের সকল ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কতটা বিবেক ও মনুষ্যত্বহীন এরা! রমজান সংযত হওয়ার আদেশ দেয় ও সংযমী হতে শেখায়। কিন্তু কই সংযম, কোথায় সংযত আচরণ? অনৈতিক কর্মকা- কোন ধর্মই গ্রহণ করে না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্যের মজুদ করাকে ইসলাম ধর্ম অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়।’ হাদিসে এটাও বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি (সঙ্কট তৈরি করে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে, সে অপরাধী।’ ভেজাল মেশানো বন্ধে উম্মতদের সতর্ক করে দিয়ে মহানবী (সা) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে দ্রব্যসামগ্রীর অধিক মূল্য বৃদ্ধি এবং পণ্যে ভেজাল মিশ্রণকে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অবৈধ বলা হয়েছে। তারপরও পবিত্র রমজানে চলছে জুলুম, অন্যায়, অনৈতিকতা। শতকরা নব্বইজনেরও অধিক মুসলমানের দেশে কয়জন ইসলামী ভাবধারা মেনে ব্যবসা করছেন? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজারে গেলে হাঁফিয়ে ওঠা ছাড়া কোন গতি নেই। সবজি ও মাছ-মাংসের হাটে একই অবস্থা। আর পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই ক্রেতা ঠকানোতে দক্ষ। এই তো সময় ক্রেতাদের পকেট কাটার এমন বাস্তবতায় সারারা, পাখি, চিকনিচামেলী, কিরণমালা ইত্যাদি চরিত্রে পরিহিত পোশাকের আদলে তৈরি বেনামী পোশাকী গায়ে লাগাচ্ছেন নামযুক্ত মোটা মূল্যের চোখ ধাঁধানো রঙিন ট্যাগ। যেখানে লেখা আছে ক্রয়মূল্য থেকে তিন-চারগুণ বেশি অর্থমূল্য। গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে দেখেছে বিক্রেতারা যে মূল্যে জামা, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গাসহ রেডিমেড পোশাক বিক্রি করছে, তাদের কেনা দাম তার তিন ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ১০০ টাকা দিয়ে কেনা একটি ড্রেস তারা ৩০০ টাকায় বিক্রি করছে। যা সংযমের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দেশের ছোট থেকে বড় কোন ব্যবসায়ীই সংযমের যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষা করছেন না। সিয়ামের সময় এলেই প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে শুরু হয় সিন্ডিকেট খেলা। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে। সারা বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে কমবেশি দর উঠানামা করলেও রমজানে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ। অস্তির হয়ে ওঠে বাজার। ভোক্তা মনে জন্ম নেয় ব্যাপক ক্ষোভ, নাভিশ্বাস। রোজা, সিয়াম, সংযমের কথা ভুলে ক্রেতাসাধারণকে বেকায়দায় ফেলে ব্যবসায়ীরা বনে যান অল্প সময়ের নীতিনির্ধারক, হর্তাকর্তা। সংযমের মাসে বাজারে তাদের এমন অসংযত আচরণ মেনে নেয়া কঠিন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ তারপর আবার ভেজালের কবলে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাংলাদেশে এমন আকার ধারণ করছে যা ঠেকানোর পথ সত্যি কঠিন। মানুষের প্রয়োজনীয় এমন কোন দ্রব্যাদি নেই যেখানে ভেজাল নেই। ফলমূল, মাছ-মাংস, সবজি, ভোজ্যতেল, ঘি, দুধসহ খাদ্য সামগ্রীর সব বস্তুতেই ভেজালের অস্তিত্ব বিরাজমান। এক কথায় আমরা যা খাচ্ছি, ব্যবহার করছি সবকিছুই ভেজালে সয়লাভ। এভাবে কি জীবন চলে? হ্যাঁ, ভেজালে ভেজালে জীবন তো চলছেই! তবে জীবন চললেও মনুষ্য দেহটিতে ভর করে আছে নানা রোগবালাই। সর্বাগ্রে ভেজাল আমাদের মুমূর্ষু অবস্থায় পতিত করছে। অকালে নিভে যাচ্ছে অসংখ্য জীবন প্রদীপ। উপাসনা ও আরাধনার এ মাসেও ভেজাল? সিয়াম সাধনার পবিত্র রমজানেও চলছে ভেজালের বিভীষিকাময় তৎপরতা। রোজায় সেহরি আয়োজন ঘরে হলেও ইফতারে বেশিরভাগ মানুষ বাজারের তৈরিকৃত মুখরোচক বাহারি সামগ্রী গ্রহণ করে থাকে। একবার চিন্তা করে দেখুন তো সারাদিন রোজা রাখার পর আমরা সন্ধ্যায় যা খেয়ে যাচ্ছি তার কতখানি স্বাস্থ্যসম্মত। ইফতারের নামে বাজারে যা বিক্রি হয় প্রায় সবগুলোতেই দেহের জন্য ক্ষতিকারক বস্তু মেশানো হচ্ছে। রমজানের পবিত্রতা রক্ষা যদি হয় ধর্মশীলতা তাহলে বলা যায় সিয়াম সাধনার মাসে ব্যবসার নামে অনৈতিক মুনাফা লাভও এক ধরনের প্রতারণা। যা করে দেখাচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ। তাদের কাছে রমজান মানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ভেজালে মিশে যাওয়া। যে যত পারছে মুনাফা অর্জনের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। এই এগিয়ে থাকার দুর্দান্ত গতি রোধ করার সামর্থ্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কোন পক্ষের আছে কি? প্রতি বছর রমজানের দিনগুলোতে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্রব্যমূল্যের দুষ্টচক্রের বেপরোয়া তা-বলীলা থামাতে প্রায় ব্যর্থ। রমজানে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাটা খোদ সরকারের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরগুলোর নজির সামনে রেখে আগেভাগেই স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাণিজ্য, শিল্প, স্বরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়গুলো তৎপর হলেও মাঠে এর প্রভাব দেখা যায়নি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তোড়জোড় দেখে মনে হয় এবার বুঝি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। কিন্তু রমজান পূর্ব পরবর্তী বাজার দরে তেমন তুষ্টিদায়ক খবর নেই। আছে শুধু অস্বস্তি হাহুতাশ। রাষ্ট্রের এই আগডুম-বাগডুম প্রতিযোগিতা যেন অবৈধ মুনাফাভোগীদের বৈধতা দেয়ার জোর প্রয়াস বৈকি। এবারকার রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদরের উর্ধমুখী তালিকা দেখে মনে হয় না সরকারের দায়িত্বশীল কোন সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকি চালিয়ে যাচ্ছে। রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক বেআইনী কাজ প্রতিরোধে আইন থাকলেও বিচার নেই, প্রতিরোধের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হাঁকডাক থাকলেও দমনের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। এ দেশের ব্যবসায়ীগণ যেন ক্রেতা সন্তুষ্টি নয়, নিজেদের পেট পালনে সদাব্যস্ত। মুসলমানদের জন্য অতি উত্তম এ মাসটিতে সরকারের বাজার মনিটরিং কার্যক্রমে গতি আনতে হবে। খুচরা বাজার নয়, পাইকারি বাজারসহ সিন্ডিকেটধারীদের হাতে হাতকড়া লাগাতে হবে। কারণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে পাইকারি বাজার অস্থিতিশীল করলে খুচরা বাজারে এসে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তখনই দেখা দেয় ভোক্তা বিরক্তি ভাব। সংযম পালনে ব্রতী হওয়া মুসল্লীদের স্বস্তি দিতে প্রতি রমজানে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন সভ্য রাষ্ট্রের এটা নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই দেশের ব্যবসায়ী সমাজকে আরও সংযমী হতে হবে। লেখক : সাংবাদিক
×