ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মাপারের জনজীবন

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৪ জুন ২০১৭

পদ্মাপারের জনজীবন

প্রমত্তা পদ্মার তীর ঘেঁষে বহুকাল আগে নদীকেন্দ্রিক নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠলেও পদ্মা তীরের বাঘার জনপদ এখন মরুময়তার দিকে। সে সময় ছিল পদ্মার উত্তাল যৌবন। কালের আবর্তে পদ্মার বুকে চর জেগে এখন সেখানে বাড়িঘর, গাছপালা। তবে বর্ষায় এসব বাড়িঘর পানিতে সয়লাব হয়। অথৈ পানিতে ভাসে জনবসতি। বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙ্গনে ফসলী জমি, গাছপালা ভেঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে জনবসতি। শুষ্ক মৌসুমে চরে দেখা মেলে বালির ঝিলিক ও ধুÑধু শূন্যতা। পদ্মা তীরের পুরনো জনপদ বাঘা ঘুরে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। শীতে ও শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্ত পানি দিয়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ হয় না এ জনপদের মানুষের। সৃষ্টি হয় পানির টানাপোড়েন। বাংলাদেশের উজানে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এখানে। পানি প্রবাহ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে প্রচ- খরা এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে মহা প্লাবনের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে জলবায়ু ক্রমেই মরুময়তার দিকে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের বিনাশসহ নানা পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় সেচের জন্য ২৫% পানির চাহিদা মিটত নদীÑনালা, খালÑবিল থেকে, কিন্তু বর্তমানে তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গভীর নলকূপের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক উপরের দিকে উঠে আসছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং শীতে ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞদের ধারণা তাপমাত্রার সমন্বয় না হওয়ায় ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ঘটে মরুময়তার দিকে ধাবিত হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টির উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে। পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি নদী মরু নদীতে পরিণত হচ্ছে। পদ্মার উৎপত্তি ভারতের গঙ্গা থেকে। আর হিমালয়ের হিমশৈলে অলকানন্দা এবং ভাগীরথী এই দুই ধারায় গঙ্গার উৎপত্তি। এই দুটি নদী ভারতের উত্তর প্রদেশের তেহরী গুরুয়াল জেলার গঙ্গোত্রীর কাছে দেবপ্রয়াণ নামক স্থানে মিলিত হয়ে গঙ্গা নামে হরিদ্বারের কাছে ভারতের সমতল ভূমিতে প্রবেশ করে। পরে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে। বাংলাদেশে রাজশাহীতে প্রবেশের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী শহর, সারদা ও বাঘার তীর বেয়ে হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচ দিয়ে রবীন্দ্র নাথের শিলাইদহ হয়ে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দের উজানে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ অঞ্চলে নৌপথ ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। কালের আবর্তে বাঘা এলাকার নৌঘাটে এখন ধুÑধু শূন্যতা। স্থানীয় জনসাধারণ এক সময় নদীকেন্দ্রিক জীবনÑজীবিকা চালালেও সীমান্তবর্তী এ এলাকায় এখন অনেকেই জড়িয়ে গেছে নানা পেশায়। নানা প্রতিকূলতার কারণে এই বিশাল অঞ্চল এখন খাদ্য ঘাটতি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। পদ্মার তীরে বাঘার এ প্রাচীন জনপদ প্রশাসনিক সীমানা চিহ্নিতকরণে স্বীকৃত হয়েছে রাজশাহীর একটি উপজেলা হিসেবে। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২৮ কিমি দক্ষিণÑপূর্ব দিকে এ জনপদের অবস্থান। জনশ্রুতি অনুযায়ী সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলের শেষ দিকে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ থেকে হযরত শাহদৌলা নামক একজন দরবেশ তাঁর পাঁচজন সঙ্গীসহ এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করেন। তখন এ এলাকায় ছিল কম জনবসতি ও গভীর অরণ্য। জঙ্গলে ছিল বাঘ, ভাল্লুক ও শ্বাপদসঙ্কুুল। হযরত শাহদৌলা ও তার পাঁচজন সঙ্গী জীবজন্তুর ভয় না করে এ এলাকায় বসবাস ও ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। ফলে বিস্তৃতি ঘটে জনবসতির। বর্তমানে বাঘা উপজেলা সদর থেকে পিচঢালা সড়ক বেয়ে মাত্র দুই কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে এগুলেই পদ্মা নদী। এক সময় এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করত বাঘসহ নানা বন্য প্রাণী। জনশ্রুতি আছে, বাঘ হেঁটে পদ্মার তীরে গিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে স্বচ্ছ পানিতে নিজ চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখত। পদ্মার পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাত বন্য প্রাণিকুল। কালের আবর্তে এ সবই এখন কল্পনা স্মৃতি। এখানে তৈরি হয়েছে উপজেলা সদর ও জনপদ রক্ষায় বেড়িবাঁধ। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও জীবন- জীবিকার তাগিদে জনপদ গড়ে উঠলেও এখন তা বদলে গেছে ভিন্ন আদলে। নদীতে চর জেগে ওঠা, নাব্যহ্রাস এবং বর্ষা মৌসুমে বন্যা হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এ এলাকার মানুষ। চর জেগে বন্ধ হয়েছে নৌপথ। মৎস্য ও পশু সম্পদ বিলীন হওয়ার পথে। জীবিকা হারিয়েছে পদ্মার ওপর নির্ভরশীল নানা পেশার মানুষ। অনেকেই হারিয়েছে বসতভিটা, যেখানে কেটেছে তাদের শৈশবÑকৈশোর। এখন সেখানে ধুÑধু চর, নয়ত ভাঙ্গন। শীত মৌসুমে পদ্মার বুকে তাকালে চোখে পড়ে সরিষা, আখ, তিল, তিষিসহ নানা রবিশস্য। হেঁটে পার হওয়া যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পদ্মা তখন ইলিশের বদলে শোভিত থাকে নানা ফুল-ফলে। চরের ভূমিতে বেড়ে উঠেছে কাশবন, শন, ওলু, নলখাগড়া, বাবলা, খেজুরসহ নানা রকমের গাছ। শীত মৌসুমে এগুলো হাত ছানি দেয় পর্যটকদের। এখানে পদ্মার উত্তর তীরের জনপদ পানিকামড়া, কালিদাসখালি, নারায়ণপুর, বিলবাড়িয়া। নদীর তীরের এসব গ্রাম আম্রকাননসহ নানা প্রাকৃতিক শোভায় বর্ণিল হলেও বর্ষার চিত্র করুণ। বেড়িবাঁধ হওয়ার ফলে উপজেলা সদরের মানুষকে তেমন একটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, তবে যেভাবে পদ্মা ভাঙছে, তাতে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে এক সময় হয়ত বেড়িবাঁধও ধ্বংস হয়ে যাবে। এই আমলের বর্ষা মৌসুমের মতিÑগতির ঠিক না থাকায় এবং উজানের পানি প্রবাহের ফলে বিলীন হয়েছে ও হচ্ছে আম্রকাননসহ হাজার হাজার একর ফসলী জমি, জনবসতি। আবার খড়া মৌসুমে পানিশূন্য নদীতে চর জেগে ওঠায় তৈরি হয় করুণ চিত্র। যেখানে এক সময় পানিতে সয়লাব থাকে সেখানেই পানির অভাবে মানুষ, পশুপাখি সবাই তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। মানুষ ছটফট করতে থাকে। এক সময়ের প্রমত্তার বর্তমান ক্ষীণকায় রূপের লাবণ্যহীনতা সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে। পানিকামড়া গ্রামের বয়োজেষ্ঠ আমিনুল হক লালু, ও নাড়ু বলেন প্রমত্তা পদ্মার গর্জনে নিত্য দিন আমাদের ঘুম ভাঙত। পানির ওপরে চাঁদনী রাতের আলোকচ্ছটার ঝিলিক ও রুপালি ইলিশের লাফÑঝাঁপ উপভোগ করার জন্য আমরা গভীর রাতে গিয়ে হাজির হতাম নদীর তীরে। তখন পদ্মার হুঙ্কার থাকলেও ছিল না ভাঙ্গন। পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে গেছে আমাদের ফসলী জমি। মনিগ্রামের সফিকুল ইসলাম বলেন পদ্মার যৌবনকালে বাঘার তীর দিয়ে যাতায়াত করত বড় বড় জাহাজ। দূরের বাণিজ্য জাহাজ ভিড় করত এখানকার ঘাটে। পালের নৌকা দিয়ে আমরা যাতায়াত করতাম রাজশাহী, ঈশ্বরদীসহ বহু দূর-দূরান্তে। এখন এসবই স্মৃতি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নদীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে এই নদী গড়ে তুলেছে জনপদ, ব্যবসায় ও শিল্প-কারখানা। সৃষ্টি হয়েছে সমাজের অগ্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্য। অপরদিকে এ সকল নদ-নদী ভাঙ্গন ও প্লাবনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের দুর্ভোগ এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। ভয়ঙ্করী পদ্মার তীরের নানা জনপদের ক্ষীণকায় রূপ যেমনি কালের নীরব সাক্ষী, তেমনি ভাঙ্গা গড়ার ফলে আপন অবিস্মরণীয় কীর্তিতে নদী হয়েছে ভাস্বর। নদীর ইতিহাসে চিরন্তন হয়ে আছে তার গতি। এর চলমান ধারা যেমনি কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি চিত্তাকর্ষক। এসব নদীর ইতিহাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার সভ্যতা, সংস্কৃতি অতীতÑঐতিহ্যের প্রকৃত সন্ধান মেলে। যেমনটি খুঁজে পাওয়া যায় পদ্মার তীরের বাঘার জনজীবনে। এখানে প্রতি বছর ঈদÑউলÑফিতরের পরের দিন থেকে তিন দিনের জন্য বিশেষ মেলা বসে। রাজশাহীর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা-, লোকগাথা, লোকগীতির পরিস্ফুটন ঘটে এ সময়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ নানা স্থান থেকে আগমন ঘটে বিচিত্র বর্ণ ও পেশার মানুষের। এই মেলার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় এ এলাকার ঐতিহ্য ও শেকড়ের স্বরূপ। তবে বর্তমান সময়ের তাবদাহের কারণে এ এলাকার মানুষ ভুলে যেতে বসেছে তাদের ঐতিহ্য ও নানা স্মৃতি। গত কয়েকদিনের অসহ্য গরমে সারাদেশের মানুষ অতিষ্ঠ। তবে আরও অতিষ্ঠ এবং সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে এই খড়া অঞ্চলের মানুষেরা। সারা দিনের অসহ্য গরম ও ক্লান্তিতে মানুষ কোন কাজ করতে পারছে না। পেটের তাগিদে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেও বেলা বাড়ার ফলে অসহ্য গরমে প্রতিদিন নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে তারা। যন্ত্রণায় ছটফট করে বৃদ্ধ ও শিশুদের জীবন প্রায় যায় যায়। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মহলসহ সবাই এগিয়ে না আসলে অন্যান্য খড়া অঞ্চলের ন্যায় বাঘার জনপদও হয়ত রেহাই পাবে না। লেখক : গবেষক উপ-আঞ্চলিক পরিচালক, বাউবি
×