ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জিয়াউর রহমানের অন্ধকার অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৪ জুন ২০১৭

জিয়াউর রহমানের অন্ধকার অধ্যায়

রক্ত ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৭৫ সালের নবেম্বর মাসে। তাঁর ক্ষমতায় থাকার সময় একের পর এক সেনা বিদ্রোহ হয়েছে। শেষতক এক সফল সেনা বিদ্রোহে ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি নিহত হন। মানুষ, সৈনিক বা রাজনীতিক হিসেবে জিয়া কেমন ছিলেন? ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইতিহাসে জিয়ার পদার্পণ। দুঃখজনক হলেও সত্য শুরুটা হয়েছিল কিন্তু একটা প্রতারণা দিয়েই। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণার সময় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের অন্তর্বতী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি এটা পরিষ্কার করেন বাঙালীর ‘মহান জাতীয় নেতা’ আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা এটি। জিয়ার জন্য এক সর্বোত্তম মুহূর্ত এটি। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের শুরু হলো এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যুদ্ধে জিয়ার অংশগ্রহণে ঐকান্তিকতা নিয়ে খুব সামান্যই প্রশ্ন আছে। জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা এসেছে তা তিনি সযতেœ অতিক্রম করে গেছেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও কৌশলগত দিক বিবেচনায় তিনি যোদ্ধা হিসেবে খুব ভালো ছিলেন না। তিনি কঠোর ছিলেন আচরণে ও নিয়মানুবর্তিতায়। জিয়া অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন। এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতিতে তাঁর বুদ্ধির ধার আরও প্রখরতা পেল। অন্য সময়ের মতো জিয়া চরিত্রের এক জটিল রূপ এ সময় প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে তিনি দেশের এক প্রথম সারির সাপ্তাহিক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করে একটি পুরোদস্তুর লেখা প্রকাশ করেন। চার বছর পর, উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং মীজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে যাওয়া আওয়ামী লীগের একটি দলের সঙ্গে আলোচনায় তিনি জোর গলায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘আমার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগ আর কে আছে? আমি চট্টগ্রামের রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ সবাইকে শুনিয়েছি।’ এটা সেই সময়, যখন তাঁর উচ্চাশা একটি পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই করে নেয়ার জায়গা খুঁজছেন। জিয়া আওয়ামী লীগের কাছে আসলে সমর্থন চাচ্ছিলেন। এ সমর্থন তিনি কখনোই পাননি। এই অসমর্থন এ জন্যই নয় যে, একদল বিপথগামী সেনা যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে পনেরো আগস্টে এর সকালে হত্যা করল তখন তিনি নীরব দর্শক ছিলেন। যখন তাঁকে এ হত্যার কথা জানানো হলো, তখন তিনি শেভ করছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শুনে নির্বিকারভাবে বলেছিলেন, ‘তাতে কী হয়েছে? উপ-রাষ্ট্রপতি আছেন!’ সশস্ত্র বাহিনীর আরও অনেক প্রথম সারির কর্মকর্তার মতো জিয়া সেই কাল সকালে এই বর্বর হত্যা রুখতে এগিয়ে আসেননি। জাতি পরে জেনেছিল, জিয়া ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের ষড়যন্ত্র ১৯৭৫-এর মার্চেই জেনেছিলেন। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ বা সরকার কাউকেই এ বিষয়ে জানাননি। এই অভ্যুত্থানের কয়েক দিনের মধ্যে তিনি সেনাপ্রধান বনে গেলেন। এতে কাজের কাজ কিছু হলো না। ১৫ আগস্টে হত্যাকারী মেজর-কর্নেলদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা গেল না। ১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর চেন অব কমান্ড যে ভেঙ্গে পড়েছিল তা উদ্ধার করতে পারলেন না জিয়া। ১৯৭৫-এর ৩ নবেম্বর জিয়াকে উৎখাত করলেন খালেদ মোশাররফ। চার দিন পর বিপ্লবের মোহে আচ্ছন্ন কর্নেল আবু তাহেরের বদৌলতে জিয়া মুক্ত হলেন। আবার সেনাপ্রধান হলেন। সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে হত্যা করা হলো খালেদ মোশাররফকে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাখা তাঁর মৃতদেহ জিয়ার অনুসারী সৈনিকেরা চরম অবমাননা করে। খালেদ মোশাররফ হত্যার পরিপ্রেক্ষিত আজও পরিষ্কার জানা গেল না। তবে তাঁর হত্যায় সন্দেহের তীর সবসময় জিয়ার দিকেই বিদ্ধ থেকেছে। যে সেনা নিবাসে খালেদ মোশাররফ বন্দী ছিলেন, সেখানে থাকা এক সেনা কর্মকর্তা ৭ নবেম্বর সকালে জিয়াকে খবরটি জানিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পর খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদা এবং এটিএম হায়দারকে ঠা-া মাথায় হত্যা করা হয়। কর্নেল তাহেরের ভ্রান্ত নির্দেশে এরপর আরও বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। তাহেরের তথাকথিত বিপ্লবী সেনাবাহিনীর দর্শনের ভয়াবহতা জিয়া দ্রুতই বুঝে গিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে লড়েছিলেন এবং তাই তিনি ১৯৭৫ সালে তাহেরের এই আপাত রোমাঞ্চকর পথে পা বাড়াননি। জিয়া আর তাহেরের এই প্রত্যাশিত লড়াইয়ে শেষতক অনেক বেশি ধূর্ত জিয়া জয়ী হলেন। তাহের যুদ্ধে হেরে গেলেন এবং আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো। জিয়ার নির্দয়তার প্রথম স্মারক এটিই। কর্নেল তাহেরের নারকীয় হত্যাকা- জিয়ার মধ্যযুগীয় বর্বরতার একটি নমুনা ছিল। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এই বর্বরতাকেই সম্বল করেছিলেন জিয়া। এরপর এর ধারাবাহিকতা চলেছে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে কয়েক হাজার বিমান ও সেনাবাহিনীর সদস্যকে আবারও বিচার করে ফাঁসি দেয়া হয়। বিচার প্রক্রিয়ার এক কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল এটি। এই প্রহসনের বিচারে যারা দ- পেয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই জানতেন না তাদের দোষ কী। দ- পাওয়া এসব মানুষের পরিবারের সদস্যরা দুই দশক পর তাদের কারও বাবা, কারও স্বামী বা কারও ভাইকে ঢাকা ও কুমিল্লার নাম না জানা অনেক কবরস্থানে খুঁজে পেয়েছেন। দ্রুত বিচার করে, ফাঁসি দিয়ে অধিক দ্রুততার সঙ্গে যাদের কবর দেয়া হয়েছিল। জিয়া অনুসারীরা সবসময় একটি কথা বলে যান। তাহলো দেশের এই প্রথম সামরিক স্বৈরাচার ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন! এটা নিহায়ত সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়। আওয়ামী লীগ এবং আরও কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের সমর্থনে জিয়ার একটি রাজনৈতিক ভিত্তি দরকার ছিল। জিয়ার এই ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে প্রত্যাখ্যাত, এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের বিরোধিতাকারী পাকিস্তানী বাহিনীর দালাল ঘাতকসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে। জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করেননি। তিনি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দকে প্রতিষ্ঠা করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১, এ সময়ে বীর যোদ্ধা জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তিনি ‘জিন্দাবাদের’ রাজনীতির ধ্বজাধারীদের সাহচর্যে সুখী ছিলেন। জিয়া ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্থান নিয়ে নিজে কখনও প্রশ্ন তোলেননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শাসনের প্রথম দিকে তিনি বাংলাদেশ বেতারের কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৭ মার্চ ১৯৭১ এ দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা আনিয়েছিলেন। তিনি এই ঘোষণা বার বার শোনেন। এক তোষামোদকারী রেডিও কর্মকর্তা যখন জিয়ার ইচ্ছা অনুযায়ী এই ভাষণ কাটছাঁট করার প্রস্তাব দেন জিয়া খুব নরম সুরে তাঁকে এবং সঙ্গে থাকা অন্যদের বলেছিলেন, ‘ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না।’ তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন মুজিব এবং মুজিবনগর সরকারের সমস্ত নেতাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। তাঁর সময় দাফতরিকভাবে ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী’ হয়ে গেল ‘হানাদার বাহিনী।’ ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সত্যিই অন্যরকম হতো, যদি জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের পাস করে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের ঘাতকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা না করতেন। তিনি এভাবে এসব হত্যাকারীকে রক্ষা করেই ক্ষান্ত হননি, পাকিস্তান, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তাদের কূটনীতিকের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এক বিরামহীন আলো-আঁধারীর মধ্য দিয়ে গেছে জিয়ার জীবন। সেই জীবনে অন্ধকারই আলোকে বেশি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সন্ত্রস্ত এক জনগোষ্ঠীকে ১৯৭১ এর মার্চে তাঁর কণ্ঠ উজ্জীবিত করেছিল। কর্নেল তাহেরের হঠকারিতা প্রতিরোধ করে একটি দুর্যোগ বা বলা যায় একটি গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে এক প্রকারের শৃঙ্খলা এনেছিলেন। এগুলো ছিল আলোর দিক। কিন্তু এরপরই আছে গভীর অন্ধকার। তাঁর উচ্চাভিলাষ ছিল চরম। সহযোগীদের মুহূর্তের মধ্যে ফাঁসির দড়িতে লটকাতে কোন দ্বিধা ছিল না তাঁর। তিনি আমাদের দেশে বিভেদের এক রাজনীতির অধ্যায় শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও সেই বিভেদ আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত করুণ ও দুঃখজনক মৃত্যু হয়। ক্ষমতায় থাকার সময় হাজার হাজার সেনা সদস্য এবং সাধারণ মানুষকে তিনি যেভাবে করুণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন এমন মৃত্যু তাঁকেও বরণ করতে হলো। তাঁর সামরিক শাসন শুধু মানুষ হত্যার প্রতীক বহন করে না, এই ধর্মনিরেপক্ষ দেশটির ইতিহাস ও ভাবনাকেও হত্যা করেছিলেন তিনি। লেখক : দ্য এশিয়ান এজ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক
×