ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু কেন শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৪ জুন ২০১৭

শিশু কেন শ্রমিক

যে বয়সে বই-খাতা হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলার মাঠে নিমগ্ন হওয়ার কথা, সে বয়সে যেতে হয় আয়-রোজগারে, নামতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। কুঁড়িগুলো আর ফুল হয়ে উঠতে পারে না। ‘শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত’ এই নীতিবাক্য তাদের জীবনে কখনই ধরা দেয় না। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জগত তাদের সবকিছুতেই জড়িয়ে যায়। শ্রমে যুক্ত হওয়ার কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এই রাজধানীতে প্রতিদিন দৃশ্যমান হয় শিশু শ্রমিকদের কষ্টকর শ্রমজীবন। কোমল যে হাত ভারি জিনিস বহন করতে পারে না, সেই হাতেই তুলে নিতে হয় হাতুড়ি। ভাঙতে হয় ইট কিংবা বাস, টেম্পো, লেগুনায় হেলপারের মতো কঠিন কাজও অল্প বয়সে আয়ত্ত করে নিতে হয়। হোটেলে ‘পিচ্চি’ হিসেবে অভিহিত হয়ে কাজ করতে হয় নানারকম। একটু ভুল হলে কাজে বকাঝকা বরাদ্দ হয়ে যায়। বাসা-বাড়ির কাজেও এই শিশুরা বারো ঘণ্টার মতো কাজ করে। প্রায়শই মারধর থেকে রেহাই মেলে না। পর্যাপ্ত খাবার কিংবা ঘুমও মেলে না। পিতৃ-মাতৃস্নেহবঞ্চিত এই শিশুরা বড় হয়ে ওঠে অনিশ্চয়তাকে ভর করে। এই করুণ কষ্টকর অবস্থা থেকে বুঝি মুক্তি নেই! যুগ যুগ ধরে তারা নিরন্তর ঝুঁকির ভেতর দিয়ে পাড়ি দেয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের প্রতি সহমর্মী, সমব্যথী এমনটা নয়। তবে আইন রয়েছে। কিন্তু সে আইনও যেন কাজীর গরু কেতাবে থাকার মতো। আর শুধু আইন দিয়ে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব নয়। অথচ শ্রম আইনানুযায়ী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া যায় না। এছাড়া শিশুদের দিয়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো ও চৌদ্দ বছরের কম বয়সী শিশুদের শ্রম একেবারেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ বাস্তব দৃশ্য যা তাতে এই আইন প্রয়োগের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আইনের ধারা পঁয়ত্রিশে এমনটাও বলা হয়েছে, কোন শিশুর বাবা-মা বা অভিভাবক শিশুকে কোন কাজে নিয়োগের অনুমতি দিয়ে কারও সঙ্গে কোন চুক্তি করতে পারবে না। এজন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনেও আছে কোন শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিয়োগ দিলে অথবা আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করে কোন শিশু বা কিশোরকে চাকরি করার অনুমতি দিলে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ- দিতে হবে। আর কোন শিশুর বাবা-মা বা অভিভাবক এই পঁয়ত্রিশ ধারা অমান্য করে কোন শিশু সম্পর্কে চুক্তি করলে তাকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ- দিতে হবে। অথচ বাস্তবে যে সব শিশুকে কাজে নিয়োগ দেয়া হয় সেখানে কোন নিয়োগপত্র থাকে না। চুক্তিও নয়। যে কোন সময় যে কোন শিশু কর্মচ্যুত হতে পারে যে কোন কাজ থেকে। ফলে আইন আর সেখানে পৌঁছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে কর্মজীবী শিশু এবং শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। তবে এখনও আশানুরূপভাবে কমছে না ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৫০ হাজার। আর এই শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে পাঁচ থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন, এদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে শিশু সমভাবে জড়িত। অবশ্য শিশুশ্রমের দিক থেকে বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে তিন শতাধিক কাজে নিয়োজিত অন্তত ৭৪ লাখ শিশু নিয়োজিত। এরা কলকারখানা, বাসাবাড়ি, টেম্পো, বাস, লেগুনার হেলপার, ইটভাঙ্গা, ময়লা-আবর্জনা টোকানো, খাবার দোকান, ওয়ার্কশপের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত। শ্রমে যুক্ত হওয়ার কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বর্তমানে কলকারখানায় শিশু শ্রমের সংখ্যা বাড়ার কারণ এদের মজুরি নামমাত্র। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, শিশুরা বড়দের মতো কাজ করে ৮৫ শতাংশ। স্কুলে যায় না ২৪ লাখ শিশু। মজুরি পায় না ১৬ লাখ শিশু। পরিবারকে সহায়তা দিতে কাজ করে ৬৫ শতাংশ শিশু। একটি শিশু দিনে গড়ে সাড়ে ছয় ঘণ্টা কাজ করছে। মাসে আয় করছে মাত্র পাঁচ হাজার নয় শ’ টাকা। কর্মক্ষেত্রে দূষিত পরিবেশে কাজ করছে সতেরো শতাংশ শিশু। কর্মক্ষেত্রে মালিক দ্বারা শোষিত হয়, নির্যাতনের শিকার হয়। সঙ্কট দুর্যোগ যাই হোক, শিশুশ্রম বন্ধ হোক বলে যতই হাঁকডাক দেয়া হোক, বাস্তবতায় তা ধোপে টেকে না। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে তা করার কথা থাকলেও হয়নি। শিশুশ্রমকে সামাজিকভাবে বর্জন করা দুরূহ। কারণ হতদরিদ্র, অতিদরিদ্র অবস্থার পরিবর্তন না হলে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করতে শিশুদের শ্রমজীবী হতেই হয়। পুরো বিষয় পর্যালোচনা করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। শুধু আইন দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়।
×