ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদ সদস্যদের ক্ষোভের মুখে অর্থ প্রতিমন্ত্রী

আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক কমানোর বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায়

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১৪ জুন ২০১৭

আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক কমানোর বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায়

সংসদ রিপোর্টার ॥ ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির কঠোর সমালোচনা করে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, এটি একটি রাজনৈতিক সরকারের বাজেট, কোন সেনাপ্রধানের বাজেট নয়। একটি বিষয় কিছু ব্যক্তির কাছে যতই যৌক্তিক এবং ন্যায্য মনে হোক, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরুর মতামত পক্ষে না থাকলে সেই সিদ্ধান্ত অচল ও অর্থহীন। প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হয়। তাই জনমতের প্রতি এই সংবেদনশীলতার অভাব কেন, তা কারও বোধগম্য নয়। সংসদ সদস্যদের তীব্র ক্ষোভের মুখে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এ এম মান্নান আশ্বাস দিয়ে বলেন, ব্যাংক আমানতের আবগারি শুল্ক কমানোর বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজরে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সরকারী দলের খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, এ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, নজরুল ইসলাম বাবু, সফুরা বেগম, সামশুল হক চৌধুরী, কাজী নাবিল আহমেদ, নবী নেওয়াজ, হাসান ইমাম খান, আবুল কালাম, সাবিহা বেগম, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী, ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা লুৎফুল্লা এবং বিরোধী দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এই বাজেট দেয়া হয়েছে। সমালোচনা থাকবেই। বাজেট নিয়ে অতীতেও অনেক সমালোচনা হয়েছে। আমাদের দেখতে হবে বাজেটের কারণে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কি না। যদি কেউ বলেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না, অগ্রগতি হচ্ছে না, দেশ ডিজিটাল হচ্ছে না তাহলে কিছু বলার নেই। চোখে চশমার কারণে হয়তো অনেকেই এটা দেখতে পারেন না। তিনি বলেন, হৈ চৈ হচ্ছে মোটা চালের দাম বেশি কেন। খাদ্য সঙ্কটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় খাদ্য সঙ্কট? কৃষকরা এবার ধানের দাম একটু বেশি পেয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আমাদের এক কাপড়ে বের করে দেয়ার কথা বলছেন। আমরা তো একটি কাপড় পরি না। আর আমাদের চারপাশে তো ভারত। উনি (খালেদা জিয়া) তো ভারতকে পছন্দ করেন না। তাহলে কোথায় যাবেন আপনি? বঙ্গোপসাগর ছাড়া তো আর কোন জায়গা নেই। কথায় আছেÑ কয়লা যায় না ধুলে স্বভাব যায় না মলে। খালেদার জিয়ার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। ২১ আগস্ট, অগ্নিসন্ত্রাসসহ কয়েকটি আলোচিত মামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব মামলার বিচার যদি ঠিকমতো হয় তাহলে বিএনপির একজন লোকও জেলের বাইরে থাকবে না। সংসদ সদস্যদের তীব্র দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এবারের বাজেট সারাদেশেই আগ্রহ জাগিয়েছে। এবারের বাজেট নিয়ে কোন ভীতি নেই। তবে আলোচনা আর সমালোচনা রয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের কর্মী হিসেবে কথা দিচ্ছি সবার পরামর্শ ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতির জন্য যেটা মঙ্গল হবে তাই করা হবে। তিনি বলেন, আমরা জাতিকে একুশ শতকের একটি আধুনিক সভ্য উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে চাই। আগে কেউ কেউ বাজেট দিতেন হিসাবরক্ষকের বাজেট। আমরা এটা করি না। আমরা উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি নিয়ে বাজেট দিয়েছি। এর আগে থিংক ট্যাংক সিপিডি বলেছিল এত বড় বাজেট বাস্তবায়ন হবে কি করে। আল্লাহর রহমতে এর আগের বাজেট আমরা বাস্তবায়ন করেছি। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসকে ভ্যাটের বাইরে রাখা হযেছে। তাহলে কেন বলা হচ্ছে আমরা কল্যাণকারী দ্রব্যের ওপর ভ্যাট বসিয়েছি? আবগারি শুল্ক ৪৭ সাল থেকে এ দেশে ছিল। ২০০৯ সালে এটা ছিল ৫শ’ টাকা। এখন বাড়িয়ে ৮শ’ টাকা করা হয়েছে। বিগত কয়েক দিনে এ নিয়ে অনেকে মন্তব্য করেছেন। সংসদে এমপিরা কথা বলেছেন। আমার বিশ্বাস আবগারি শুল্ক নিয়ে আমরা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারব। তিনি বলেন, বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাস্তবায়ন। আমরা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেই কিন্তু যার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। অনেক সময় পুরস্কার হিসেবে তাদের প্রকল্প পরিচালক করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এক ব্যক্তি এক প্রকল্পের পরিচালক হবেন। ৮-১০টির হতে পারবেন না। অনেক পরিচালককে দেখা যায় ঢাকায় বসে থাকেন। সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করেন। কিন্তু প্রকল্পে যান না। তিনি বলেন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমরা আঞ্চলিক সহায়তা বাড়াচ্ছি। ভারত নিয়ে নিন্দুকেরা নানা কথা বলবেন। আমরা ভারতের বাজার নয় ভারত হচ্ছে আমাদের বাজার। এখানে উভয়পক্ষ লাভবান হবে। বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখন আমরা তা দেখছি না। বাজেটের আয় অনেকটা মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তদের ওপর নির্ভর করছে। ব্যাংকে টাকা রাখা ও বিমানের টিকেট কাটার ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। যারা বিদেশে টাকা পাচার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ এই বাজেটে খুশি হতে পারেনি। আবগারি শুল্ক আর ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট বাড়ানোর ইস্যুতে চাপা পড়ে গেছে বাজেটের আরও অনেক দিক। অতিরিক্ত ভ্যাটের কারণে অনেক কোম্পানি ও কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। আর ১০৪৩টি পণ্য ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখাকে আমি শুভঙ্করের ফাঁকি বলেই মনে করি। তিনি বলেন, এবারের বাজেটের অন্যতম দিক হলো অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। আবগারি শুল্ক নিয়ে সারাদেশে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। জনগণের সঞ্চয়ের ওপরও অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে। এর ওপর যেন উনার কাঁচি না পড়ে সে জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দুর্নীতি সহায়ক, অবিবেচক এবং অতিরিক্ত করারোপের পথ থেকে অর্থমন্ত্রীকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিরোধী দলের নেতারা দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চায়। কিন্তু বিরোধী দলের এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। তাই আমরা সরকারী দলের সহায়তা চাই। গণতন্ত্র ধ্বংসকারীদের খপ্পরে যেন সরকারী দল না পড়ে। দেশে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের মিথ্যা গল্প ফাঁদা হচ্ছে এমন মন্তব্য করে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের কোথাও খাদ্য সঙ্কট নেই। কোথাও খাবারের অভাবে মানুষ মারা গেছে বলেও কেউ শোনেনি। হাওড়ে এত বড় বিপর্যয় ঘটার পরও সরকারের পদক্ষেপের কারণে কোন বিপর্যয় ঘটে নাই। অথচ প্রতিদিন ইফতারের সময় মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এসব ইফতারের অনুষ্ঠানে একদিন যদি চালের দাম ৪০ টাকা বলা হয়, পরের দিনই তা বলা হচ্ছে ৫০ টাকা, তারপর দিনই ৬০ টাকা। এভাবে মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে একটি পক্ষ দেশে চালের দাম বাড়িয়ে চলছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, বাজেট গণমুখী, সরকার এবার হতো দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। অর্থমন্ত্রীর মধ্যে আশ্চর্যজনক কিছু বিষয় আছে। তিনি সাহসী ও বড় প্রস্তাবিত বাজেট দিয়েছেন। কিন্তু কিছু সমালোচিত কাজ করে পুরো বিষয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো করলেন। এটা তো সেনা শাসনের বাজেট নয় এটা একটি রাজনৈতিক দলের বাজেট। অর্থমন্ত্রীর মধ্যে জনগণের প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব কেন, আমার বোধগম্য নই। এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তদের ওপর একটু বেশি চাপ দেয়া হয়েছে। যা ভোটের রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। গণতান্তিক সরকারে অনড় অবস্থান বলে কিছু নেই। বাজেট বাস্তবায়নের চালকের আসনে যেখানে রয়েছেন শেখ হাসিনা, সেখানে ১৬ কোটি যাত্রীর কোন ভয় নেই বলে মনে করি। ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বর্ণসময় অতিক্রম করছে। কিন্তু এই স্বর্ণসময়েও বৈষম্য কমেনি। দেশের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মানুষের মোট সম্পদের সপরিমাণ ভোগ করছে হাতেগোনা ৭-৮ ভাগ মানুষ। এই বিশাল বৈষম্য দূর করতে না পারলে বাজেটের সুফল আসবে না।
×