ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৪ জুন ২০১৭

মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ মাহে রমজানের আজ ১৮তম দিবস। দুদিন পরই মাগফিরাতের প্রতিশ্রুত ২য় দশকের সমাপ্তি ঘটবে। রোজাদারদের উচিত নিজেকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক সাধনা চালিয়ে যাওয়া, নিজেকে আত্মোৎসর্গিত বান্দায় পরিণত করা। আমাদের মনে রাখা উচিত সমাজ থেকে কিছু পেতে হলে সমাজকে কিছু দিতে হয়। কিন্তু মানুষ এ বিষয়টি খেয়াল করে না। এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না; বরং ত্যাগের চেয়ে ভোগের নিরন্তর স্পৃহাই মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে বেশি। অবশ্য, ব্যতিক্রম চরিত্র মাধুর্যের মানুষ যে নেই তা নয়। আছে, তবে তাদের সংখ্যা খুবই নগন্য। ভোগবাদী মানুষের পাশাপাশি যুগে যুগে ত্যাগী ও আত্মোৎসর্গিত মানুষের উপস্থিতিও আছে বলে সমাজ অন্তত আজও এতটুকুন আবাসযোগ্য রয়েছে। যারা ভোগবাদী তারা মনে করে, ভোগের মাধ্যমে তারা দুনিয়াটাই কব্জ করে নেবে, কিন্তু আসলে তা একটি মিথ্যা ও ভ্রান্ত ধারণা। যুগে যুগে তারা ঘৃণিত, বিস্মৃত ও ধিকৃত হয় এবং ক্রমেই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। পক্ষান্তরে যারা ত্যাগী, তারা মনুষ্য সমাজে চিরস্থায়ী সম্মানজনক আসন লাভ করে থাকে। তারা পরম অনুপ্রেরণা হন সত্যাশ্রয়ী মানুষের জন্য। দাতা হাতেমতাই, হাজী মুহাম্মদ মহসিন মাবেতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন ত্যাগের, দানের, সমাজসেবা ও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বিবেচনার ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। নিজের জন্য কিছু গ্রহণ, ভোগবাদিতা প্রকাশের কোন ফুরসত জীবনে কখনও তিনি পাননি। সমাজের জন্য, একটি সুশীল সুসভ্য জাতি সৃষ্টির জন্য তিনি জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ ও কুরবানি দিয়েছিলেন। এমনকি পানাহার, ঘুম, আরাম-আয়েশ কিছুই তিনি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেননি। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও আল্লাহর প্রিয় হাবীব হয়েও তিনি নিজে ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিলেন। হযরত ফাতেমার শ্বশুরালয়ে একবার তিনি অহেতুক সাজসজ্জা দেখে নিরবে গৃহত্যাগ করেছিলেন। আর দান করার ক্ষেত্রে এমন হয়েছিলেন যে, জনৈক দীনহীন লোকের আবদার রাখতে গিয়ে নিজের পরনের একমাত্র জামাটি খুলে দিয়েছিলেন। অবশ্য এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে কুরআনের আয়াত নাযিলের মাধ্যমে দানের কতিপয় নিয়মও শিক্ষা দিয়েছেন। কোরানে বলা হয়েছে: তুমি এমনভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকো না, যাতে লোকজন তোমাকে কৃপণ বলে তিরষ্কার করবে, আবার এমনভাবে দানও করবে না যাতে তুমি রিক্তহস্ত হয়ে পড়। সমাজের স্বার্থে যুগে যুগে মহামনীষীগণ ত্যাগ ও দানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ধর্মীয় গ্রন্থগুলো দানের বিষয়ে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। সমাজে অন্যের সেবা করা, অন্যকে কাছে টানা, অন্যের জন্য জানমাল ত্যাগ করার মানসিকতা হ্রাস পেলে সে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে, হতাশা গ্রাস করে সাধারণ মানুষদের। এমনকি একশ্রেণীর ভোগবাদীদের দোরগোড়ায় মজলুম নিঃস্ব বনি আদমের এক মুঠো ভাত অথবা এক টুকরো পরনের কাপড়ের জন্য আর্তনাদ দেখা দিলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। ফলে সমাজে নানা গজব, মহামারী, অশান্তি, অস্থিতিশীলতা নেমে আসে। কারণ পরম স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে বাস করেন, তাঁর মজলুম বান্দাদের কান্নায় তিনি বিচলিত হন, তাদের দোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। একজন মায়ের কয়েক সন্তানের মধ্যে যে সন্তানটি বেশি দুর্বল, তার দিকে যেমন কোন পিতা-মাতার অধিক বেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ পায় ঠিক তদ্রƒপ আল্লাহর কাছেও তার দুঃখী ও নির্যাতিত অবহেলিত বান্দাটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। হাদীস শরীফে আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ কতিপয় মানুষকে অভিযোগ করবেন: ‘আমি ক্ষধার্ত ছিলাম আমাকে খাদ্য দাওনি, আমি তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমার তৃষ্ণা নিবৃত্ত করনি; আমি কাপড়ের মুহতাজ ছিলাম তুমি আমাকে কাপড় দাওনি।’ বান্দা তখন বলবে: ‘ওহে মহামহিম প্রভু! আপনি তো অমুখাপেক্ষী, বে-নিয়াজ। আপনি তো এসব হাজত হতে মুক্ত-পবিত্র। কখন কিভাবে আপনি তা আমাদের কাছে চেয়েছিলেন?’ আল্লাহ উত্তরে বলবেন: ‘আমি যাইনি ঠিকই, আমার গরিব-অভাবী বান্দাগণ ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ও বস্ত্র সমস্যা নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিল। তুমি তাদের প্রয়োজনীয় সেবাদান করলে তাদের মধ্যে আমার সন্তুষ্টিই খুঁজে পেতে।’ এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে: ‘ওয়া ফী আমওয়ালিহিম হাক্কুন লিস সায়িলি ওয়াল মাহরুম’—অর্থাৎ তাদের ধন-সম্পদে ভিখারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। কুরআনুল কারিমে আরও বলা হয়েছে: ‘যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে আর তা থেকে আল্লাহর রাহে খরচ করে না, তাদেরকে পরকালে ভয়ানক আযাবের সুসংবাদ দান করো।’ অর্থাৎ তাদের আযাব বা শাস্তির পরিণাম ও মজা গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে বলো। হযরত মুহম্মদ (স.) হাদীস শরীফে বর্ণনা করেছেন : যখন তোমাদের নেতৃত্ব উত্তম যোগ্যতার অধিকারী হয় আর তোমাদের ধনিক শ্রেণী দানশীল হয় এবং তোমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে হয়, তবে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের অভ্যন্তর ভাগ হতে উত্তম হয়। অর্থাৎ এ দুনিয়া আল্লাহর রহমতে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠে। সুতরাং আমাদের মধ্যে যারা ধনী, তাদের উচিত, সময়মতো যাকাতের টাকা-পয়সা গরিবদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা। এটি একজনের হাতে পুঞ্জীভূত থাকলে সমাজের অর্থনীতির চাকা থেমে যায়। নিজেকেও নানা পাপ, সংকীর্ণতা ও গজব এসে গ্রাস করে।
×