ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্ধার কাজে গিয়ে প্রাণ দিলেন ৪ সেনা সদস্য

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৪ জুন ২০১৭

উদ্ধার কাজে গিয়ে প্রাণ দিলেন ৪ সেনা সদস্য

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পবিত্র রমজান মাস। প্রতিরাতের মতো সোমবার দিবাগত রাতেও তারা সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন। অফিস সময় শুরু হওয়ার পর ঠিকই তারা যোগ দেন স্ব স্ব কর্মে। কিন্তু কে জানত মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে যমদূত। হার মানতে হবে মৃত্যুর কাছে। শেষ পর্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাটিই ঘটল। ওরা দেশের গৌরবের সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্য। ওরা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে নিয়োজিত ছিলেন পাহাড়ে ‘শান্তি সম্প্রীতি ও উন্নয়ন’ কাজে। ওরা সাহসী। ওরা দুর্জয়। পাহাড়ে শান্তি রক্ষায় দেশের সেনাবাহিনী বছরের পর বছর যে কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে এরই প্রক্রিয়ায় মাত্র বছরখানেক আগে সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটি জোনে যোগ দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটি সদর এলাকা ও জেলা জুড়ে রবিবার থেকে অবিরাম ভারিবর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত ছিল। অতি মাত্রার বর্ষণের ফলে একদিকে যেমন বাড়িঘর, গাছপালা বিধ্বস্ত হয়ে যায়, তেমনি পাহাড়ী ঢলে ভেসে যায় মানুষের বাড়িঘর ও সহায় সম্পদ। এমনিতর পরিবেশে মঙ্গলবার ভোর আনুমানিক ৪টার দিকে জেলার মানিকছড়ি এলাকায় চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের ওপরে ঘটে পাহাড় ধস। বিরাট আকৃতির পাহাড় থেকে বড় একটি অংশ ধসে পড়ার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ। লোকালয়ের অদূরে এ ঘটনাটি ঘটে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীর মানিকছড়ি ক্যাম্পের পক্ষ থেকে ধ্বংসস্তূপ সরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অপরদিক থেকে রাঙ্গামাটি জোনের নির্দেশে মেজর মাহফুজের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি সেনাদল ঘটনাস্থলে চলে আসে। তারা ত্বরিতগতিতে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের জন্য ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে লিপ্ত হন। সময়টা ছিল তখন সকাল ১০টা। কাজ শুরু করার পর সেনা সদস্যরা পাহাড়ী এক পরিবারের ৬ সদস্যকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এর মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যেই একই পাহাড় থেকে বড় আকারের আরেকটি অংশের ধস সৃষ্টি হয়। ফলে ১৪ সেনা সদস্যই চাপা পড়েন ধসে পড়া মাটির নিচে। যারা অপেক্ষাকৃত কম আহত হন তারা অন্যদের উদ্ধার কাজে লিপ্ত হন। এরইমধ্যে মানিকছড়ি ক্যাম্পের সেনাসদস্য ও স্থানীয় লোকজন যোগ দেয় উদ্ধার কাজে। একে একে ১৫ জনকে উদ্ধার করে আনা হলেও এদের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় টিম লিডার মেজর মাহফুজ (৩৭), ক্যাপ্টেন তানভীর (২৭), সৈনিক শাহীন (৩০) ও কর্পোরাল আজিজ (৩২)। ক্যাপ্টেন তানভীরের তখনও শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল। দ্রুতগতিতে তাকে পাঠানো হয় রাঙ্গামাটি হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অবস্থায় আরও উদ্ধার হয় সৈনিক মামুন, আজমল, মোজাম্মেল, ফিরোজ ও সেলিম। এদের মধ্যে সৈনিক ফিরোজের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন বলে জানা গেছে। এছাড়া মাটিচাপা অবস্থায় নিখোঁজ রয়েছেন সৈনিক আজিজ। দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার কাজ দফায় দফায় ব্যাহত হচ্ছে। সেনা, বিজিবি, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিখোঁজ সৈনিক আজিজের কোন খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, পাহাড়ী ধসেপড়া মাটির নিচে চাপা পড়ে তিনিও প্রাণ হারিয়েছেন। আহত ১১ জনের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের বিকেলের মধ্যেই হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে নেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৫ জনকে রাঙ্গামাটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সকাল ১১টার মধ্যেই বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রাঙ্গামাটি থেকে বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য, পুলিশ, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করার পর চট্টগ্রাম থেকে দ্রুত প্রেরণ করা হয় একটি হেলিকপ্টার। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে হেলিকপ্টারটি কয়েকবার আকাশে চক্কর দিয়ে নামতে না পেরে পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে আসে। এরপর আবহাওয়া কিছুটা অনুকূলে এলে প্রথমে একটি হেলিকপ্টার গিয়ে গুরুতর আহত ৫ জনকে সরাসরি ঢাকায় সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আরেকটি হেলিকপ্টার প্রেরণ করা হয় নিহতদের নিয়ে আসার জন্য। এই হেলিকপ্টারটি মৃত ৪ জনকে নিয়ে বিকেল ৩টা নাগাদ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছায়। নিহতদের নেয়া হয় সিএমএইচে। রাখা হয়েছে হিমঘরে। এরইমধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক ও সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার রাঙ্গামাটিতে যান। সেখানে গিয়ে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। এদিকে, নিহত চার সেনা সদস্যের লাশ আজ বুধবার ঢাকায় প্রেরণ করার কথা রয়েছে। সেখানে তাদের পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়েছে। বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হেলিকপ্টার থেকে নিহত মেজর মাহফুজ, ক্যাপ্টেন তানভীর, সৈনিক শাহীন ও কর্পোরাল আজিজের লাশ যখন নামানো হচ্ছিল তখন সহকর্মীদের অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেনা সূত্রে জানা গেছে, নিহত মেজর মাহফুজ ৫ বছর বয়সী এক পুত্র সন্তানের জনক। আর ক্যাপ্টেন তানভীর মাত্র ছয়মাস আগে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি একজন কমান্ডোও। এদিকে, আইএসপিআর জানিয়েছে, রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে উদ্ধার কাজ চালানোর সময় ২ কর্মকর্তাসহ ৪ সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। গত তিনদিনের প্রবল বর্ষণের ফলে সোমবার রাত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস শুরু হয়। এতে করে সমগ্র এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃউদ্ধারে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য সেনাক্যাম্পের সদস্যরা সোমবার থেকেই উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মঙ্গলবার ভোরে মানিকছড়িতে বিরাট আকৃতির পাহাড় থেকে মাটি ও গাছপালা পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে রাঙ্গামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল উক্ত সড়কে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এতে যোগ দেয় রাঙ্গামাটি জোনের উক্ত ১৪ সেনা সদস্য। উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে সকাল ১০টার পর একই পাহাড়ের আরেকটি বড় অংশ মূল সড়কের ওপর ধসে পড়ে। এতে সেনা সদস্যরা মূল সড়ক থেকে ৩০ ফুট নিচে পড়ে যান। ঘটনার পর পরই মানিকছড়ি ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ২ সেনা কর্মকর্তাসহ ৪ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। আহত অবস্থায় উদ্ধার হয় ১০ সেনা সদস্য। আহতদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকার সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। আইএসপিআরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিহতদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। নিহত মেজর মোঃ মাহফুজুল হকের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। ১৯৯৯ সালে তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন এবং ৪৪ বিএমএ লং কোর্সে কমিশনপ্রাপ্ত হন। নিহত ক্যাপ্টেন তানভীর সালাম শান্ত’র বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন এবং ৬৪ বিএমএ লংকোর্সে কমিশন প্রাপ্ত হন। নিহত কর্পোরাল মোঃ আজিজুল হক ৯৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বিবাহিত ও ১ পুত্র ও ১ কন্যার জনক। নিহত সৈনিক মোঃ শাহীন আলমের বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি। তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। এছাড়া এখনও নিখোঁজ সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমানের বাড়ি মাদারীপুরে। তিনি বিবাহিত এবং এক কন্যার জনক।
×