ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের বেহাল দশা

টর্চ জ্বালিয়ে অনুমান করে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৪ জুন ২০১৭

টর্চ জ্বালিয়ে অনুমান করে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ৫২ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি ও ভবনে চলছে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের কার্যক্রম। দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এ অঞ্চলের মানুষ আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য চেয়ে থাকে ঢাকা অফিসের দিকে। রাডার না থাকায় এ আবহাওয়া অফিস থেকে ঘূর্ণিঝড়ের কোন পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয় না। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আর বেলুন উড়িয়ে দৈনিক গড় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপ করাই তাদের নিত্যদিনের কাজ। তাছাড়া যতটুকু তথ্য তারা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন, তা সম্প্রচারের জন্যও নেই কোন ব্যবস্থা। নিয়মিত কোন বুলেটিনও প্রকাশ করেন না তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তারা জানান, ৫২ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে এখনও তারা আবহাওয়া পরিমাপের কাজ করেন। এলাকায় দিনের প্রায় অর্ধেক সময় বিদ্যুত থাকে না। বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। ফলে দুর্যোগ আসন্ন জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয় তাদের। অথবা ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিসের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অথচ ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত উপকূলভাগের এ অঞ্চলের মানুষেরই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা বেশি দরকার। বর্ষা মৌসুম আসলেই উপকূলের মানুষদের নিয়ে চিন্তা বাড়ে স্থানীয় আবহাওয়া দফতরগুলোর। সময়মতো আবহাওয়ার পূর্বাভাস না পাওয়ায় প্রতিবছর শত শত জেলে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য শিকারে গিয়ে জাল-ট্রলারসহ ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। এরই মধ্যে উপকূলভাগের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় মোরায় বরিশাল আবহাওয়া অফিসের কোন তৎপরতাই ছিল না। সূত্রমতে, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এ অঞ্চলের বর্ষাকালীন দুর্যোগের কথা চিন্তা করে ১৯৬৫ সালে নগরীর পশ্চিম কাউনিয়াসংলগ্ন কাশিপুর এলাকায় চার একর জমির ওপর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আবহাওয়া অফিস নির্মাণ করে। সেই থেকে চারটি বিভাগে আবহাওয়া পরিমাপের কাজ চলছে। আবহাওয়া তথ্য, পাইলট বেলুন বা আবহাওয়া যাচাই বেলুন, জলবায়ু ও কৃষি বিষয়ের ওপর পর্যবেক্ষণ এবং তথ্য সরবরাহ। বছর কয়েক আগে এ্যারোমেট নামে একটি সেকশন চালু হয়েছে। তবে এ সেকশন থেকে মূলত বরিশাল বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামার জন্য অনুকূল বা প্রতিকূল আবহাওয়ার সংকেত সরবরাহ করা হয়। যদিও বিদ্যুতের অভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ সংকেত সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তারা জানান, অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুত না থাকায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিনা কাজে ফেলে রাখায় এগুলোও অকার্যকর হওয়ার পথে। এসবের যন্ত্রাংশও দেশে পাওয়া যায় না। তাই কোন অংশ নষ্ট হলে আমদানি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সেটিও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, বরিশাল আবহাওয়া অফিসে গড়ে প্রতিদিন বিদ্যুত থাকে মাত্র ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা। বাকি সময় মেশিনগুলো বন্ধ থাকে। এ সময় আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি, তাপ-চাপের পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত, বাতাসের আর্দ্রতা, গতিবেগ, মেঘের গতি-প্রকৃতি কিছুই জানা সম্ভব হয় না। মোমবাতি জ্বালিয়ে অফিস করতে হয়। টর্চ জ্বালিয়ে চোখের আন্দাজে আবহাওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অবস্থা বিপর্যয়কর বলে অনুমান হলে তড়িঘড়ি করে শরণাপন্ন হতে হয় ঢাকা অফিসের কাছে। সেখান থেকে তথ্য পেলেও সম্প্রচারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে সবার কাছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাঠানো সম্ভব হয় না। কেউ আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলে তাদের ঢাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যটুকু জানিয়ে দেয়া হয়। সূত্রে আরও জানা গেছে, ঝড়ের পূর্বাভাস জানানোর জন্য ঢাকার বাইরের কোন আবহাওয়া দফতরেই এখন পর্যন্ত যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়নি। যে কারণে ঝড়ের পূর্বাভাস পায় না উপকূলের লাখ লাখ জেলেরা। শুধু কত মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং তাপমাত্রা কত তা রেকর্ড করা ছাড়া বরিশাল অফিসের আর কোন কাজ নেই। মেঘের গতি-প্রকৃতি ঢাকার কেন্দ্রীয় দফতরকে জানানো হলে তারা স্যাটেলাইট থেকে অধিকতর তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। কিন্তু তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়া শেষে ঢাকা থেকে যখন সম্প্রচার শুরু হয়, ততক্ষণে অধিকাংশ জেলে সাগরের গভীরে চলে যান, মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকেন। বেতার বার্তায় যখন পূর্বাভাস পান তখন আর কূলে ফেরার সুযোগ থাকে না। ৫২ বছর আগে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় এ আবহাওয়া অফিসটি স্থাপন করা হলেও স্বাধীনতার পর আর কোন উন্নয়ন হয়নি। বরিশাল আবহাওয়া অফিসে বর্তমানে ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। পর্যায়ক্রমে তিনজন করে তারা শিফটে দায়িত্ব পালন করেন। যে তিনতলা ভবনটিতে কর্মকর্তারা কাজ করেন সেটিরও বেহালদশা। বাইরে ঝকঝকে দেখা গেলেও ভেতরে দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে। অর্ধশত বছরের পুরনো ভবনে নতুন রঙ করা ছাড়া আর তেমন সংস্কার কাজ করা হয়নি। আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তারা বলেন, এখানে এ অফিসটি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উপকূলের আবহাওয়ার খোঁজখবর জেনে স্থানীয়ভাবে প্রচার মাধ্যমকে জানানোর পাশাপাশি ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিসে তথ্য সরবরাহ করা। কিন্তু এখন হচ্ছেÑ উল্টো। সাগরে ঝড়ের পূর্বাভাস জানার জন্য এ অফিসটিকে ধরনা দিতে হয় কেন্দ্রীয় দফতরের কাছে। সেখান থেকে তথ্য এনে জানানো হয় স্থানীয় গণমাধ্যমকে। বরিশালের পর পর্যায়ক্রমে পটুয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলে আবহাওয়া অফিস স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু তার কোন সুফলই পাচ্ছেন না দক্ষিণের মানুষ। এ ব্যাপারে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হালিম মিয়া জানান, তারা উপকূলবাসীকে সাধ্যমতো তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে রাডার না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের কোন তথ্য দিতে পারেন না। সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, একটি ফিডার দিয়ে কাজ করতে হয়। যখন বিদ্যুত থাকে না, তখন মোমবাতি কিংবা টর্চ জ্বালিয়ে কাজ করতে হয়। বিদ্যুত সরবরাহের বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই।
×