ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধস ও ঢলে পাহাড়ে বিপর্যয় ॥ ৪ সেনাসহ হত ১২৮

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৪ জুন ২০১৭

ধস ও ঢলে পাহাড়ে বিপর্যয় ॥ ৪ সেনাসহ হত ১২৮

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/ মোহাম্মদ আলী ॥ ঘূর্ণিঝড়ের কোন ঘটনা নয়। ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার তা-ব। এর ফলে পাহাড় ধস, ঢল, দেয়ালচাপা ও বিদ্যুতস্পৃষ্টের ঘটনায় তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর চার সদস্যসহ ১২৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। মানিকছড়িতে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ১৪ সদস্যের একটি দল। নিহতদের মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলায় সাধারণ মানুষ ৭৫, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার দুজনসহ চার সেনাসদস্য, বান্দরবানে ১৫ ও খাগড়াছড়িতে চারজন রয়েছেন। অপরদিকে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার তিন উপজেলায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৩০ জন। এছাড়া তিন দিন ধরে অব্যাহত বর্ষণে সহস্রাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। পাহাড়ী ঢলে ভেসে গেছে মানুষের বিভিন্ন সম্পদ। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম-বান্দরবান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ধার কাজে আহত ও নিহতদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় উদ্ধার তৎপরতায় প্রায়শই থমকে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাহাড় ধসের ঘটনাগুলোতে অনেকে চাপা পড়ে থাকতে পারে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের কারণে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বিদ্যুত, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে আছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জেলা প্রশাসনসমূহের সূত্রগুলো জানিয়েছে। রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে ৪ সেনা সদস্যের মৃত্যু ও ১০ জনের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে পাহাড় ধসে। বান্দরবানের লেমুছড়িতে পাহাড় ধসে ৩ ভাই বোনসহ এক পরিবারের ছয়জন প্রাণ হারিয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, টানা ৪৮ ঘণ্টা অবিরাম বর্ষণের ফলে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে অমিও চাকমা, মিন্টু ত্রিপুরা, আইচ মল্লিক, লিটন মল্লিক, চুনসু মল্লিক, হাজেরা বেগম, সোনালী চাকমা, বৈশাখী চাকমা, অং সি সিং, চেনা মারমা, কেথোয় চিন মারমা, লায়লা বেগম ও নুর আক্তারের নাম জানা গেছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে প্রায় অর্ধশত। অপরদিকে ভারি বর্ষণে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলাজুড়ে দুই শতাধিক বসতবাড়ি ধসে গেছে। কয়েকশ’ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। গত সোমবার থেকে তিন পার্বত্য জেলাজুড়ে অবিরাম বর্ষণ শুরু হয়। মঙ্গলবার ভোরে বৃষ্টির মাত্রা আরও গতি পায়। ফলে একে একে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস শুরু হয়। রাঙ্গামাটি শহরের পুলিশ লাইন উন্নয়ন বোর্ড এলাকা ভেদভেদির শিমুলতলি, নতুনপাড়া, বেতার কেন্দ্র, তবলছড়ি, পুলিশ লাইন, কাপ্তাই নতুন বাজার এলাকায় পাহাড় ধসছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকলে আরও ব্যাপক আকারে ধসের আশঙ্কা রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোঃ মানজারুল মান্নান জানিয়েছেন, শহরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। অনেকে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় বড় আকৃতির পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে উন্নয়ন বোর্ড সড়কটি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। পুরো শহরে বিদ্যুত ও পানির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে আছে। বান্দরবান শহরের লেমুছড়ি, ঝিড়ি জেলেপাড়া, কালাকাটা ও ক্যাচিংঘাটা এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত তিন ভাইবোন হচ্ছে শুভ বড়ুয়া (৮), মিঠু বড়ুয়া (৬) ও লতা বড়ুয়া (৫)। এছাড়া লেমুঝিড়ি জেলেপাড়ায় আবদুল আজিজ, স্ত্রী কামরুন নাহার (৪০) ও কন্যা সুফিয়া বেগম (৮) এবং কালাকাটা এলাকায় রেবা ত্রিপুরা (২২) প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত অপর দুজনের নাম জানা যায়নি। স্থানীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ভোরে কালাকাটা কবরস্থান এলাকায় মাটিচাপা পড়ে রেবা ত্রিপুরা নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৩ জন। এরা হলেনÑ বীর বাহাদুর ত্রিপুরা, প্রসেন ত্রিপুরা ও সূর্য চাকমা। খাগড়াছড়ি থেকে জনকণ্ঠের পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জিতেন বড়ুয়া জানান, ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ায় জেলাজুড়ে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি হয়েছে। তবে পাহাড়ী ঢলে এক শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া গত দু’দিন ধরে প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢল জনজীবন বিপর্যস্ত করে রেখেছে। শহর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুত ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার তুলনায় খাগড়াছড়িতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে ছোটখাটো ধস হয়েছে। তবে এতে কোন প্রাণহানি ঘটেনি। এদিকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ সফিউল হক, চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদারসহ সেনাবাহিনী এবং সিভিল প্রশাসনের বেশকিছু উর্ধতন কর্মকর্তা রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসসহ বিভিন্ন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীর পরিস্থিতি প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসে আবারও ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। সোমবার রাত থেকে বিরামহীন বৃষ্টিপাত এবং ঝড়ো হাওয়ায় তলিয়ে গেছে অনেক এলাকা। বিভিন্ন উপজেলায় বিধ্বস্ত হয়েছে সহস্রাধিক বাড়িঘর। উপড়ে গেছে অসংখ্য গাছপালা। ধসে পড়া পাহাড়ের মাটি এবং গাছ চাপায় নিহত হয়েছেন ৩০ জন। সব মিলে আহত হয়েছেন শতাধিক। বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে ভেসে গেছে ক্ষেত খামার ও মৎস্য সম্পদ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলো থেকে দেড় শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এদিকে নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে শুরু হয়েছে মহেশখালে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত আলোচিত সেই বাঁধ অপসারণ প্রক্রিয়া। রাঙ্গুনিয়ায় নিহত ২১ রাঙ্গুনিয়া থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ভারি বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নে ঘটেছে দুটি পাহাড় ধসের ঘটনা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মোট ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের বগাবিলি বালুখালী এলাকায় সকালে পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজন এবং চাক্করঘোনা এলাকায় অপর একটি পরিবারের আরও চারজন নিহত হয়েছেন। ভোরের দিকে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় বসতঘরের ওপর নিকটবর্তী পাহাড় ধসে পড়লে মাটি চাপা পড়ে বসতি ওই দুই পরিবারের লোকজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন বগাবিলি বালুখালী এলাকার মোহাম্মদ ইসমাইল (৪২) তার স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩৭), শিশুকন্যা ইসামনি (৮) ও ছেলে ইবামনি (৪) এবং চাক্কর ঘোনা এলাকার নজরুল ইসলাম (৪০), তার স্ত্রী বাচু আকতার (৩৫) ছেলে ননাইয়া (১৫) ও মেয়ে সাথী আকতার (৯)। অপরদিকে ইসলামপুর ইউনিয়নের মঘাইছড়ি এলাকায় দুটি স্থানে পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহত তিন পরিবারের ১৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃতরা হলেনÑ মনিরটেক এলাকার মোহাম্মদ সুজন (২৪) ও তার স্ত্রী মুন্নী আকতার (২০), দুই মেয়ে হালিমা (৬) ও আঠার মাস বয়সী সন্তান মীম। দুই বোন জ্যোৎস্না আকতার (১৮) ও মনোয়ারা বেগম (১৬)। বড়বিলি এলাকার একই পরিবারের শেফালী বেগম (৫৫), তার ছেলে পারভেজ (২২) ও মোহাম্মদ হোসেন (১৯) এবং অপর পরিবারের রিজিয়া বেগম (৫৭), তার মেয়ে মুনমুন আকতার (১৭), হিরো মিয়া (১৫) ও মানিক (২০)। ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মিল্টন জানান, পাহাড় ধসে মাটিচাপার ঘটনায় আরও কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে। আহত হয়েছে ৭/৮ জন। নিহতদের উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এদিকে কাপ্তাই মিতিঙ্গাছড়ি এলাকায় দিনমজুর নূরনবীর ঘরে পাহাড় ধসে চারজন মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন দ্রুত এগিয়ে এসে নূর নবীর বউকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই পরিবারের নূর নবী, তার ছেলের বউ রুবি, নাতি রোহান মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। ঘটনাস্থলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন, নির্বাহী কর্মকর্তা তারিকুল আলম, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নুরনাহার বেগম, ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী বেবী ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মী এবং স্থানীয় জনগণকে নিয়ে চাপাপড়া লোকদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে দেখা যায়। এদিকে উদ্ধার করতে গিয়ে ছয়জন আহত হয়, তাদের চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্ধার করতে গিয়ে আহত রাসেল হাসপাতালে এই প্রতিবেদকে জানান, যেই মুহূর্তে তারা উদ্ধার করতে যায়, সেই সময় আরও একটি পাহাড় ধসে পড়ে। এদিকে রাইখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সায়ামং মার্মা জানান, গতকাল ভোরে রাইখালি ইউনিয়নের কারিগরপাড়া এলাকায় মাটিচাপা পড়ে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হন। নিহতরা হলেন কারিগরপাড়া এলাকার উনুচিং মার্মা (৩০) এবং শিশু মিখিই মার্মা (১২)। চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহামুদল হাই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, মঙ্গলবার ভোরে কাপ্তাই নতুন বাজার এলাকায় ঘরের টিনের চালে গাছ পড়ে আবুল হোসেন (৪৫) নামে এক দিনমজুর গুরুতর আহত হন। রাতে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এদিকে সকালে উপজেলা সদর বড়ইছড়ি এলাকায় নদীতে গোসল করতে গিয়ে যুবলীগ কর্মী মোঃ ইকবাল পা পিছলে নদীতে তলিয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি। কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নৌবাহিনীর ডুবুরি দলকে তলব করা হয়েছে। কাপ্তাই নতুন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাগর চক্রবর্তী জানান, মঙ্গলবার নতুন বাজার এলাকায় মাটিচাপা পড়ে এক কন্যাশিশু আহত হয়েছে। তাকে স্থানীয় উপজেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে কাপ্তাইয়ের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। বাঁশখালী বাঁশখালী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ঝড়ে বাঁশখালীর উপকূলী এলাকাসহ পাহাড়ী এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে দুর্বিষহ কষ্ট। প্রচ- ঝড়ের কারণে বাড়ির ওপর গাছ পড়ে বাহারছড়া ইউপির রতœপুর গ্রামের কবির আহমদের সাত বছরের শিশুপুত্র এনায়েতুল হক নিহত হয়েছে। এ সময় ওই এলাকার একই লাইনে অবস্থিত শতাধিক বাড়িঘর উড়ে যায়। তাছাড়া বাঁশখালীর সর্বত্র এই ঝড়ে সহস্রাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি নিহতের পরিবারকে নগদ ৩০ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করেন। রবিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া ঝড়ো বাতাস ও প্রচ- বৃষ্টিতে বিদ্যুত সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাহাড়ী ঢলে নিমজ্জিত হয়েছে অধিকাংশ রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। সাধনপুর, পুকুরিয়া, কালীপুর, বৈলছড়ি, জলদী, শীলকুপ, চাম্বল, সরলের পাইরাং, পুঁইছড়িসহ বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টলী এলাকায় দেয়ালচাপা পড়ে নিহত হয়েছেন মোঃ আবু হানিফ (৪৫) নামের একজন। তিনি বারুনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা। রাতে প্রচ- গতিতে প্রবাহিত ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফইল্যাতলি, কলেজ রোড, উত্তর সরাইপাড়া এলাকা। সেখানকার ছোটখাট অনেক ঘরবাড়ি উড়ে যায়। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে এবং কেবল ছিঁড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। বাকলিয়া এলাকায় বিদ্যুতস্পৃষ্টে মারা গেছেন একজন। নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, এক্সেস রোড এবং ছোটপুলের চিত্র মঙ্গলবারও ছিল অপরিবর্তিত। ওই সড়কটি হাঁটু থেকে বুক পানিতে তলিয়ে যায়। সড়কে রিক্সার পাশাপাশি নৌকা চলতেও দেখা যায়। মহেশখালে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণেই এ জলাবদ্ধতা বলে অভিযোগ অনেকের। মহেশখাল বাঁধ অপসারণ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে বহুল আলোচিত সেই মহেশখাল বাঁধ অবশেষে অপসারিত হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকেল তিনটার পর শুরু হয় এ কার্যক্রম। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে বাঁধটি অপসারণ করছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুরোধে বন্দর রিপাবলিক ক্লাব সংলগ্ন এলাকার মহেশখালে এ বাঁধটি নির্মাণ করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ বাঁধের সুফল পাওয়া যায়নি। বরং উজানের পানি আটকে উপরের দিকে মানুষ এবং ভাটিতে জোয়ারের পানি ফুলে নিচের দিকের মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়েছিল। বাঁধটি এলাকার অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। আবহাওয়া দফতর জানায়, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে বেলা ১২টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৩১ মিলিমিটার এবং সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। বর্ষা ঋতু আসার পূর্বে এ বর্ষণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। সমুদ্র বন্দরসমূহের জন্য এখন আর কোন সতর্কতা সঙ্কেত নেই বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বুধবার থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। বাঁশখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, পটিয়া, বোয়ালখালি, ফটিকছড়ি, মীরসরাই, সীতাকু-সহ প্রায় সকল উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি করেছে এ বর্ষণ। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর পাহাড়ী ঢলে ডুবেছে নিচু এলাকা। অনেকেরই ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। তাদের ভোগান্তি উঠে চরমে। পটিয়ায় পানিবন্দী অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পটিয়া থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। মঙ্গলবার সকালেও ভারিবর্ষণ হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে বৃষ্টির পানির পাশাপাশি পাহাড়ী ঢলের পানি পৌর এলাকা ও বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভাটিখাইন, ছনহরা, শোভনদ-ী, কচুয়াই, হাইদগাঁও, কেলিশহর, জঙ্গলখাইন, আশিয়া, কাশিয়াইশ, জিরি ও পৌর সদরের বিভিন্ন ওয়ার্ড। এসব এলাকার পাঁচ শতাধিক পুকুরের মাছ বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। একইভাবে পার্শ্ববর্তী কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা, চরলক্ষ্যা, শিকলবাহা, বড় উঠান ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি ও কর্ণফুলী নদীর পানিতে এলাকায় ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নি¤œচাপের প্রভাবে প্রথম দিন ভাটিখাইন স্ট্রিল ব্রিজ এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ী ঢলের পানি ঢুকে ভাটিখাইন, ছনহরা, কচুয়াই এলাকা প্লাবিত হয়। পটিয়া ইন্দ্রপোল-গিরিশ চৌধুরী বাজার পাঁচ কিলোমিটার বাইপাস সড়কের ঠিকাদারের অবহেলায় শ্রীমাই খালের ভাটিখাইন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। প্রতিবছর দুর্যোগকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাৎক্ষণিক ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হলেও চলতি মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত কোন ধরনের ত্রাণসামগ্রী পাননি। তবে ভাটিখাইন এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগ গত দুই দিন ধরে খিচুড়ি ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ হয়েছে। উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের অলিরহাট এলাকার একে মৎস্য হ্যাচারির অমর কৃষ্ণ সর্দারের ১২টি পুকুরের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছেন। দুই দিনের প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে উপজেলা ও পৌর এলাকার বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ ব্যাপক ক্ষতি সাধিক হয়েছে। বেশির ভাগ এলাকায় নেই বিদ্যুত। পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আলম মামুন জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শীঘ্রই ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী মানুষের তালিকা করে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছনো হবে। ফটিকছড়িতেও ব্যাপক ক্ষতি ফটিকছড়ি থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নি¤œচাপের প্রভাবে গত দুই দিনে ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীর ২১ ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন চার লাখ লোক। তাছাড়া হালদা নদী, সপ্তা খাল, কুতুবছড়ি খাল, ফটিকছড়ি খাল, ধুরুং খাল এবং মন্দাকিনী খালের পাহাড়ী ঢলের পানিতে গ্রামীণ অবকাঠামো নষ্ট হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে দুই শতাধিক দীঘি, পুকুরের মাছ ও মৎস্য ঘের। হালদার পানি বিপদসীমার তিন ফুট উপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় নাজিরহাট-রামগড় সড়কের (সেকশন-১) নাজিরহাট কলেজ গেট এলাকায় প্রধান সড়ক হুমকির সম্মুখীন। বিদ্যুত সংযোগ এবং উত্তর-দক্ষিণ ফটিকছড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির ১০টি হাটবাজার পানিতে ডুবে রয়েছে। তানভীরের বাড়িতে মাতম পাহাড় ধসে আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধার অভিযান চালানোর সময় পাহাড় ধসে নিহত হন সেনা কর্মকর্তা তানভীর সালাম ওরফে শান্ত। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের কালিশুরি ইউপির সিংহেরকাঠি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মোঃ আবদুস সালাম মোল্লা। পিতা সালাম মোল্লার চাকরির সুবাধে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার টঙ্গী এলাকায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন তানভীর। তানভীরের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে পড়েছে তানভীরের পুরো পরিবার। তানভীরের চাচা মোজাম্মেল মোল্লা বলেন, পরিবারের একমাত্র গর্বের ধন তানভীরকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন সবাই। শোকে মুহ্যমান থাকায় ঢাকায় অবস্থানরত তানভীরের পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
×