ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

বাজেটে ওষুধ খাতে ভ্যাট সরকারের ভাল কাজেরও প্রচার হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৩ জুন ২০১৭

বাজেটে ওষুধ খাতে ভ্যাট সরকারের ভাল কাজেরও প্রচার হচ্ছে না

অর্থমন্ত্রী গত ১ জুন ২০১৭ জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট উপস্থাপনকালে বলেছেন-“২১৩। ভ্যাট অব্যাহতির তফসিল। ..... মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর অব্যাহতি সংক্রান্ত প্রথম তফসিলে ১৯৯১ সালের আইনের অব্যাহতিপ্রাপ্ত ৫৩৬টি ঐ ঝ ঈড়ফব ভুক্ত আইটেমের পরিবর্তে প্রায় ১,০৪৩টি ঐ ঝ ঈড়ফব ভুক্ত আইটেমকে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করছি। ..... এছাড়াও ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ওপর এবং ..... জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা ..... এর ওপর ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করছি।” “২২৭। খ) শিল্প খাত : রর) ওষুধ শিল্প : বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। প্রচুর সম্ভাবনাময় এই খাতকে আরও বিকশিত করার জন্য এই শিল্পে ব্যবহৃত বেশ কিছু কাঁচামালে শুল্ক রেয়াত সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করছি। এখানে উল্লেখ্য, এ সমস্ত কাঁচামালের মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধের কাঁচামাল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।” আমরা সবাই জানি, মরণব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা সারাবিশে^ই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশেও। তবে বাংলাদেশের একটি সুবিধা হচ্ছে, সরকারের নীতিমালার আলোকে এবং দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের মেধার কারণে এখানকার ওষুধ কোম্পানিগুলো এন্টিক্যান্সারগুলো ড্রাগ অনেক কম দামে বাজারজাত করতে পারছে। একটি কোম্পানি বাদে অন্য কোম্পানিগুলোর এন্টিক্যান্সার ওষুধের মানও সন্তোষজনক। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে যে প্রায় ৮০টি জেনেরিক নামের এন্টিক্যান্সার ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম দামের হচ্ছে এনাস্ট্রোজোল আর সবচেয়ে বেশি দামের হচ্ছে ট্রাস্টোজোম্যাব। এনাস্ট্রোজোল একেকটি ট্যাবলেটের দাম আমদানি করা হলে ৩৫৭ টাকা, আর মানসম্মতভাবে দেশে তৈরি হলে ৬৭ টাকা। ট্রাস্টোজোম্যাব একেকটি ইনজেকশন আমদানিকৃত হলে ২,০৮,৭৬৬ টাকা, আর দেশে মানসম্মতভাবে উৎপাদিত হলে ৮০,০০০ টাকা। মাঝামাঝি দামের উদাহরণও দেয়া যায়। যেমন ক্যাপসিটাবিন ট্যাবলেট আমদানি করা হলে একেকটি ৫৬০ টাকা, দেশে উৎপাদিত হলে ৯০ টাকা। ফিলগ্রাসটিম আমদানি করলে একেকটি ইনজেকশন ২১,০০০ টাকা, দেশে উৎপাদিত হলে ২,৮৯০ টাকা। মেসনা ইনজেকশন আমদানি করা হলে একেকটি ৪,৪৭৪ টাকা, আর দেশে তৈরি হলে ১৯০ টাকা ইত্যাদি। আমদানি করা ওষুধের দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণ ওগুলোর পেটেন্ট স্বত্ব ও সীমাহীন মুনাফা। আর দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের দাম কম হওয়ার কারণ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ, গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অবদান, ওষুধ কোম্পানির অতি মুনাফা না করা এবং সরকার কর্তৃক এন্টিক্যান্সার ওষুধের ওপর থেকে ভ্যাট তুলে নেয়া। উপরের উদাহরণগুলো থেকেই স্পষ্ট যে, এন্টিক্যান্সার ওষুধের ওপর যদি ভ্যাট থাকত, তাহলে তার দাম কী পরিমাণ বেড়ে যেত। দেশের লাখ লাখ ক্যান্সার রোগী সীমাহীন কষ্টের মধ্যে থাকে। তদুপরি এসব ওষুধের অতি উচ্চ মূল্যের কারণে ক্যান্সার রোগীদের দুর্দশা যাতে আর না বাড়ে, সে লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থ মন্ত্রণালয় গত বছরের বাজেটে এন্টিক্যান্সার ওষুধের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছিল। এর ফলে এন্টিক্যান্সার ওষুধের দাম উপরোল্লিখিত দামের মধ্যে রয়েছে। নইলে তা আরও বেড়ে যেত। কিন্তু দেশের মানুষ কি বিষয়টি জানে? সরকারের এই জনহিতকর উদ্যোগটির কথা গত এক বছরেও মানুষকে জানানো হয়নি। যেমন করে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অনেক অর্জনের কথা অধিকাংশ মানুষেরই অজানা। এবারও অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে এন্টিক্যান্সার ওষুধের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার কথা বলেছেন। তবে গত বছরের সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো এবার এন্টিক্যান্সার ওষুধের আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপরও ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ওষুধের ভ্যাট দু’রকমের। প্রথম ভ্যাটটি হলো ওষুধের কাঁচামাল আমদানির সময় ৪% অগ্রিম আয়করের সঙ্গে ৫% অগ্রিম ভ্যাট কোম্পানি কর্তৃক সরকারকে প্রদান করতে হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভ্যাট অর্থাৎ প্রস্তুতকৃত ওষুধ বিক্রির জন্য বাজারে পাঠানোর আগে বাণিজ্যিক মূল্যের ওপর ১৫% ভ্যাটও ওষুধ কোম্পানি পরিশোধ করে। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের সময় এসব আয়কর ও দুটি ভ্যাট এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। গতবারের বাজেটে দ্বিতীয় ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে এর সঙ্গে প্রথম ভ্যাট অর্থাৎ কাঁচামালের ৫% ভ্যাটও অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন আর এন্টিক্যান্সার ওষুধের ওপর কোন ভ্যাটই থাকছে না। এটি ভাল উদ্যোগ। বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই সরকারের এই ভাল কাজটিকে স্বাগত জানাবে। তবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে পরিপত্রে যে বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাতে ভ্যাট অব্যাহতির জন্য ২৭টি এন্টিক্যান্সার ওষুধের নাম বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এন্টিক্যান্সার ওষুধ রয়েছে প্রায় ৮০টি। সম্ভবত উদাহরণ হিসেবেই ২৭টি ওষুধের নাম পরিপত্রে এসেছে। আমরা আশা করি বিভ্রান্তি এড়িয়ে জনগণের আস্থা দৃঢ় করার জন্য সরকার নিশ্চয়ই সবগুলো অর্থাৎ ৮০টি এন্টিক্যান্সার ওষুধের জন্যই উভয় প্রকার ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেবে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ৯৩টি ক্ষেত্রেও ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছেন। এখানেও উভয় ধরনের ভ্যাট অব্যাহতির কথা পরিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এটিও অত্যন্ত ভাল উদ্যোগ। তবে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তালিকা ৯৩টিতে সীমিত রাখা ঠিক হবে না, এর আওতা বাড়াতে হবে। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ, যেমনÑকার্ডিওভাসকিউলার, এন্টিডায়াবেটিক, হেপাটিক, নেফ্রোলজিক, হরমোন, ব্লাড প্রডাক্টস্, ভ্যাকসিন, ইমিউনোসাপ্রেসেন্টস্, ইমিউরোথেরাপিউটিকস্, এন্টিবায়োটিকস্ ইত্যাদি জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধের ক্ষেত্রেও ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা প্রদান করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও ওষুধের খাতে সরকার অনেক কল্যাণকর কাজ হাতে নিয়েছে এবং বাস্তবায়ন করছে। এগুলো দেশে যেমন জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এন্টিক্যান্সার ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ওপর থেকে সব শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিলে ওষুধের দাম কমবে, জনস্বাস্থ্যের সম্যক অগ্রগতি হবে, সরকারের ভাবমূর্তিও আরও উন্নত হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আগামী বছরের বাজেটে সরকার এন্টিক্যান্সার ও জীবনরক্ষাকারীসহ সব ধরনের ওষুধের ওপর থেকে সব কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দেবে। এর ফলে মৌলিক চাহিদার আরও একটি এলাকায় মানুষের কাছে সরকারের অর্জনটি সাফল্যের একটি ঐতিহাসিক মাইলস্টোন হিসেবে স্থায়ী আসন পাবে। অপরদিকে সব ওষুধের কর ও ভ্যাট অব্যাহতিতে সরকারও লাভবান হবে। কারণ এর ফলে আপাতত রাজস্ব আয় কিছু কম হলেও তা হবে আসলে জাতির জন্য একটি স্থায়ী বিনিয়োগ। কার্যকরভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতে কাজে দেবে। জনগণের, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের কল্যাণে সরকার বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজ উন্নয়নের যে রোডম্যাপে বাংলাদেশ, সেখানে জনস্বাস্থ্য খাতে উন্নতি হবে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিকসহ সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম অনুঘটক। লেখক : ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় [email protected]
×