ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধী বিচার;###;সাক্ষী আইয়ুব আলীর জবানবন্দী

মজিদসহ আসামিরা হেমচন্দ্রসহ ৩ জনকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৩ জুন ২০১৭

মজিদসহ আসামিরা হেমচন্দ্রসহ ৩ জনকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার শেখ মোঃ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মওলানাসহ ছয় রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মোঃ আইযুব আলী জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, আমি প্রত্যক্ষদর্শী রঞ্জিত জোয়াদ্দারের নিকট জানতে পারি আসামিগণ ১৫-২০ জন রাজাকার ও পাকিস্তানী আর্মি ডাঃ হেমচন্দ্রসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে আসামিরা ওই বাড়ি লুটপাট করে পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে আজ মঙ্গলবার আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরার দিন ধার্য করা হয়েছে। বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে দুই সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছে। এ সময় প্রসিকিউশন পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মুখলেসুর রহমান বাদল, প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি। আসামিপক্ষে ছিলেনÑ এ্যাডভোকেট গাজী এইচ এম তামিম। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম মোঃ আইয়ুব আলী। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৬৭ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম পূর্বধলা, থানা-পূর্বধলা, জেলা নেত্রকোনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নেত্রকোনা কলেজের বিএ পরীক্ষার্থী ছিলাম। ১৯৭১ সালে ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানী আর্মি ও স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পূর্বধলা থানা হানাদারমুক্ত করি। আমি পূর্বধলা থানার আইনশৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব নেয়ার দুই-একদিন পর পূর্বধলা থানার কালডোয়া গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী রঞ্জিত জোয়াদ্দারের নিকট জানতে পারি যে, পূর্বধলা সদরের রাজপাড়ার ডাঃ হেম চন্দ্র বাগচিকে তার আত্মীয় হরিদাস সিংহ, বাসার চাকর মেঘুনাথকে একাত্তরের ১ মে বেলা আনুমানিক ১১টার সময় আসামি মোঃ কবির খান, শেখ মোঃ আব্দুল মজিদ, খালেক তালুকদার ও আব্দুল রহমানসহ ১৫-২০ জন রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানী আর্মি ডাঃ হেম চন্দ্র বাগচির বাড়ির সামনে পাশে পুকুরের ঘাটলায় মেঘুনাথকে গুলি করে হত্যা করে। ডাঃ হেমচন্দ্র বাগচির বাড়িতে ঢুকে ওই বাড়ির ভেতরে ডাঃ হেমচন্দ্র বাগচি ও হরিদাস সিংহকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে আসামি কবির খানের নেতৃত্বে ঐ বাড়িতে রাজাকাররা লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় আমি আসামি মোঃ কবির খানের বাড়ি থেকে লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করে থানা হেফাজতে রাখি। সাক্ষী আরও বলেন, বাড়হা গ্রামের আব্দুল কাদেরের নিকট জানতে পারি যে, তার ভাই আবদুল খালেককে একাত্তর সালের ২১ আগস্ট বেলা আনুমানিক ১১টার সময় আসামি শেখ মোঃ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানাসহ অন্যান্য আসামি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর কাদেরকে আটকের জন্য তার বাড়িতে যায়। তাকে না পেয়ে ওই আসামিগণ ও রাজাকাররা তার ভাই আব্দুল খালেক তালুকদারকে ওই বাড়ি থেকে আটক করে তাদের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা আব্দুল খালেককে জারিয়া বাজার রাজাকার ও পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে ও তারপর তাকে কংস নদীর পাড়ে হত্যা করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় আসামিরা হলেনÑ শেখ মোঃ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মওলানা, মোঃ আব্দুল খালেক তালুকদার, মোঃ কবির খান, আব্দুর রহমান, আব্দুস সালাম বেগ ও নুরউদ্দিন ওরফে রদ্দিন। এ মামলার মোট সাতজন আসামির অপরজন আহাম্মদ আলী গ্রেফতারের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় তাকে অভিযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। ছয় আসামির মধ্যে গত বছরের ১২ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন আব্দুর রহমান। বাকি পাঁচজন পলাতক রয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আটজন নিরীহ মানুষকে অপহরণের পর হত্যা, তিনটি বাড়ির মালামাল লুট, আটটি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও একজনকে ধর্ষণের অভিযোগ। মজিদ মওলানা মুক্তিযুদ্ধের সময় নেজামে ইসলামির নেতা হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর খালেক তালুকদার একাত্তরে মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তিনি পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এছাড়া কবির খান মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন, বর্তমানে উপজেলা বিএনপির সদস্য। আব্দুর রহমান, আব্দুস সালাম বেগ ও নুর উদ্দিনও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন, বতর্মানে তারা বিএনপির সমর্থক। গত বছরের ১২ আগস্ট গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পূর্বধলার জারিয়া ইউনিয়নের গণকপাড়া গ্রামের মৃত মৌলভী হোসেন আহম্মদ ওরফে হোসেন মৌলভীর ছেলে আব্দুর রহমান ও ঘাগড়া ইউনিয়নের সুনাইকান্দা গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে আহাম্মদ আলীকে যার যার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে স্থানীয় পুলিশ। ১৩ আগস্ট তাদের হাজির করা হলে কারাগারে পাঠিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান আহাম্মদ আলী।
×