ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টি উপেক্ষা করে টিকেটযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৩ জুন ২০১৭

বৃষ্টি উপেক্ষা করে টিকেটযুদ্ধ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বৈরী আবহাওয়া। ভোর থেকে বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির বাধা। সঙ্গে বাতাসের তীব্রতা তো আছেই। রাস্তায় জমে থাকা পানির বিড়ম্বনা তো আছেই। তাই বলে কি ম্লান হবে উৎসবের আনন্দ। না। তা হয় না। ঈদ মানেই খুশি। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়া। একসঙ্গে মিলেমিশে উৎসবকে আরও বর্ণিল করে তোলা। তাই তো বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে চলা টিকেটের উদ্দেশ্যে। যে যেভাবে পেরেছেন, ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন। কেউবা বাড়তি ভাড়ায় অটোরিক্সা বা রিক্সা। কেউবা বাসে চড়ে। স্বল্প দূরত্বের লোকজন ছাতা হাতে হেঁটে এসে যুক্ত হয়েছেন ট্রেন কিংবা বাসের অগ্রিম টিকেট নেয়ার লাইনে। প্রথম দিনে ট্রেনের টিকেট হাতে পেয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন যাত্রীরা। দুপুরের অগেই ফাঁকা হয়ে যায় কাউন্টার। অনেক টিকেট ছিল অবিক্রীত। বাসে টিকেটের চাহিদা ছিল বেশি। অনেকে না পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। যারা পেয়েছেন তাদের অনেকের অভিযোগ বাড়তি ভাড়া নেয়ার। আসন্ন ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের সুবিধার্থে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত টিকেট থাকলেও প্রথম দিনে টিকেট সংগ্রহে তেমন একটা যাত্রী চাপ ছিল না কমলাপুর রেল স্টেশনে। সোমবার সকাল ৮টা থেকে অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়। প্রথম দিনে বিক্রি করা হয় ২১ জুনের টিকেট। একজন যাত্রী সর্বোচ্চ চারটি টিকেট সংগ্রহ করতে পেরেছেন। প্রতিবছরের মতো এবারও অনলাইনে ২৫ ভাগ, রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৫ ভাগ ও ভিআইপি কোটা থাকছে আরও পাঁচ ভাগ। ৩৫ ভাগ বাদে বাকি ৬৫ ভাগ টিকেট সাধারণ যাত্রী সরাসরি সংগ্রহ করতে পারবেন। পাঁচদিনব্যাপী টিকেট বিক্রির প্রথম দিনে সব যাত্রীই টিকেট নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন। প্রথম দিনে টিকেটের চাহিদা খুব একটা ছিল না। সোমবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ২১ জুনের টিকেটের তেমন চাহিদা না থাকলেও পরের দুদিন ২২ ও ২৩ জুন টিকেটের ব্যাপক চাহিদা থাকবে বলে জানিয়েছে স্টেশন সূত্র। এ দুদিনে রাজধানী ছেড়ে যাবেন কর্মজীবী মানুষের সবচেয়ে বড় অংশ। সকাল ১১টার দিকে কমলাপুর স্টেশন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টায় রাজশাহী আর দিনাজপুর ছাড়া সব জেলার টিকেট কাউন্টার ফাঁকা দেখা গেছে। এ বছর ২৩টি কাউন্টার থেকে টিকেট দেয়া হচ্ছে। নারীর জন্য খোলা হয়েছে পৃথক দুটি বুথ। টিকেট কালোবাজারি ঠেকাতে কমলাপুর স্টেশনজুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। রেল পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য থেকে শুরু করে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে অভিযোগ কেন্দ্র। তবে প্রথম দিনে তেমন কোন অভিযোগ জমা পড়েনি। দুপুরের দিকে অগ্রিম টিকেট বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি সুষ্ঠুভাবে প্রথম দিনের টিকেট বিক্রি চলছে। কারো কোন অভিযোগ পাইনি। যাত্রীরা জানিয়েছেন, তারা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, টিকেট কালোবাজারি রোধে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পুরো কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা সিটিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। একই ব্যক্তি একাধিকবার টিকেট নিচ্ছেন কিনা তা দেখা হচ্ছে। যদি কাউকে সন্দেহ হয় তাহলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আশা করি, এবারের ঈদ যাত্রাও আনন্দদায়ক হবে। শিডিউল অনুযায়ী যথাসময়ে যেন ট্রেন চলাচল করতে পারে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তিনি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী জানান, ভোর থেকে দীর্ঘ লাইনে টিকেটের জন্য মানুষ অপেক্ষমাণ থাকলেও টিকেট বিক্রি শুরু হলে তা আস্তে আস্তে কমে যায়। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ট্রেনের অগ্রিম টিকেট দেয়া হচ্ছে। আজ ২১ জুনের জন্য ২২ হাজার ১২২টি টিকেট দেয়া হবে। দুপুরে তিনি বলেন, এখনও অনেক টিকেট অবিক্রীত রয়েছে। সারাদিন টিকেট দেয়া হবে। আশা করছি যাত্রীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী টিকেট পাবেন। শুরুর দিনই টিকেটের চাহিদা কম থাকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেকে টিকেটের জন্য আসতে পারেননি। এছাড়াও ২১ জুন বুধবার হওয়ায় এ দিনের টিকেটের চাহিদা একটু কম। তবে ২২ ও ২৩ জুনের (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) টিকেটের চাহিদা বেশি থাকবে। এজন্য যাত্রীদের বাড়তি চাপ মোকাবেলায় পার্বতীপুর ও রাজশাহীগামী স্পেশাল ট্রেন ২২ জুন থেকে চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে তিনি জানান। কমলাপুরে দিনাজপুরের টিকেট নিতে আসা শিক্ষার্থী কামাল বলেন, সেহরি খেয়ে ভোর সাড়ে ৪টায় টিকেট নিতে এসেছি। সকাল ১০টায় টিকেট পেলাম। অনেক বড় লাইন ছিল, এখন কমে গেছে। দিনাজপুরের যাত্রী হামিম জানালেন, টিকেট বিক্রিতে ধীরগতির কারণে একটা কষ্ট হয়। রাজশাহীর অগ্রিম টিকেট হাতে পেয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন নাহিদা ও সোনিয়া দুই বোন। তারা জানালেন, সকাল আটটায় এসে ১১টায় টিকেট পেলাম। গত ৮ জুন রাজধানীর রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক জানান, পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরে ঘরমুখো যাত্রীর সুবিধার্থে ১২ জুন থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হবে। যাত্রীর ভ্রমণ সুবিধার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সকাল ৮টা থেকে টিকেট বিক্রি করা হবে। আজ মঙ্গলবার দেয়া হবে ২২ জুনের অগ্রিম টিকেট। পর্যায়ক্রমে ২৩, ২৪ ও ২৫ জুনের টিকেট বিক্রি হবে। বাড়তি টাকায় বাসের টিকেট দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যের বাসে অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। ভোর থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরমুখো মানুষ কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান। কোন কাউন্টারের সামনে ছাউনি করা হলেও বেশিরভাগ কাউন্টারের সামনে ছাতা নিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। প্রথম দিনে ২২ ও ২৩ জুনের টিকেটের চাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। কাউন্টারে দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিকেট হাতে পেলেও চাহিদার বিপরীতে টিকেটের সংখ্যা কম কথা বলে বাড়তি দাম নেয়ার অভিযোগ মিলেছে কিছু পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ‘কিছুটা’ বাড়তি ভাড়া নেয়ার কথা স্বীকার করে পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদযাত্রার পর ফিরতি পথে যাত্রী ‘কম থাকায়’ ব্যবসার স্বার্থে বেশি দাম নিতে হচ্ছে। সোমবার সকাল ৬টা থেকে রাজধানীর গাবতলী ও কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারগুলোতে অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়। ২৩ জুন থেকে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় আগের দিন বৃহস্পতিবারের টিকেটের চাহিদা বেশি বলে জানিয়েছেন কাউন্টার ব্যবস্থাপকরা। বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে দেখা যায়, টানা বৃষ্টির মধ্যেও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাস টিকেটের জন্য মানুষের ছিল দীর্ঘ লাইন। তবে দক্ষিণবঙ্গমুখী কাউন্টারে সেই চিত্র ছিল অনেকটা কম। হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার মাস্টার চৌধুরী আলম বলেন, সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এজন্য হয়ত যাত্রীর চাপ কম। আবার অফিস টাইমও। বিকেলে অথবা রাতে টিকেট নেয়ার চাপ বাড়তে পারে। কল্যাণপুরে শ্যামলি পরিবহনের কাউন্টারে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে সাড়ে ১১টায় বগুড়ার দুটি টিকেট হাতে পান মঈনুল হাসান আশিক। অন্য সময়ে ৩৫০ টাকার বিপরীতে বাড়তি দামে ৪৭০ টাকা নেয়ার অভিযোগ করেন বেসরকারী ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষার্থী। আশিক বলেন, অনেক অপেক্ষা করে ২২ তারিখ বিকেলের দুটি টিকেট নিয়েছি। ঈদের সময় দাম একটু বাড়তি। কিছু তো করার নেই। একই কাউন্টারে সকাল ৬টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে জয়পুরহাটের অগ্রিম টিকেট কেনেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী রশিদ মিয়া। তিনি বলেন, সকালের দিকে আসায় টিকেটটা পেয়েছি। যাত্রীর অভিযোগ প্রসঙ্গে শ্যামলি পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের রাজশাহীগামী কাউন্টারের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, যাত্রীরা বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করছে, সেটা ঠিক; আর টিকেট হাতে রেখে দেয়ার কথাও তারা বলে। আমরাও কিছু বেশি দাম নিচ্ছি। অন্য সময়ে আসা-যাওয়ার ট্রিপে যাত্রী পূর্ণ থাকায় বিআরটিএর বেঁধে দেয়া দাম থেকে কিছুটা কম নিতে পারি। ফিরতি পথের কথা চিন্তা করে এখন কম নেয়া সম্ভব নয়। প্রথম দিন বেলা ১১টায় রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী সব অগ্রিম টিকেট শেষ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। হানিফ এন্টারপ্রাইজ গাবতলী বালুর মাঠ এলাকার কাউন্টারে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এসআর ট্রাভেলসের গাবতলী কাউন্টারেও যাত্রীদের ভিড় ছিল অনেক। এ কাউন্টারের যাত্রীরাও বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন। ডিপজল পরিবহনের সামনের কাউন্টারেও বাড়তি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে সকাল ৮টা থেকে লাইনে দাঁড়ানোর চার ঘণ্টা পর ঠাকুরগাঁওয়ের টিকেট হাতে পান কাসেম রহমান। তিনি জানান, ৬০০ টাকার বিপরীতে সাড়ে ৮০০ টাকা নিলেও ‘টিকেট তো পেয়েছি। হানিফ এন্টারপ্রাইজের মহাব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন বলেন, আমাদের একেকটা রুটে ৪/৫টা গাড়ি, আর যাত্রীর সংখ্যা দেড়-দুই হাজার। এত টিকেটের ব্যবস্থা তো আমরা করতে পারব না। তিনি বলেন, হানিফের অধিকাংশ রুটে ২২ তারিখের ‘টিকেট’ নেই বললেই চলে। তার মধ্যে ২২ তারিখ বিকেলের টিকেট চাচ্ছেন অনেক যাত্রী। বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএর ‘নির্ধারিত ভাড়া’ তারা নিচ্ছেন বলে দাবি করেন মোশারফ।
×