ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো ডন কালা জাহাঙ্গীর অন্তর্ধান রহস্য!

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৩ জুন ২০১৭

আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো ডন কালা জাহাঙ্গীর অন্তর্ধান রহস্য!

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক সময়কার রহস্যময় ডনের অন্তর্ধানের অজানা কাহিনী। এ গ্যাংস্টারের নাম শুনলে বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খেত, একটি ফোনকলেই ব্যবসায়ীসহ অনেকেরই ঘুম হারাম হয়ে যেত। তার নাম কালা জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটের মোস্টওয়ান্টেড তালিকায় আছে তার নামটি। ইন্টারপোলের রেড নোটিসেও তার নামটি ভেসে বেড়াচ্ছে। তার দুঃসাহসিক সন্ত্রাসী কাহিনী যেন সিনেমার রূপকথার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। সরকারের পুরষ্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অন্যতম এই ডন কি আদৌ জীবিত, নাকি মৃত? এক যুগের বেশি সময় ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সরকার ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে কালা জাহাঙ্গীরের নাম ছিল সবার শীর্ষে। এরপর র‌্যাব গঠন এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের টালমাটাল অবস্থায় ধীরে ধীরে আত্মগোপনে চলে যায় জাহাঙ্গীর। তার অন্তর্ধান সম্পর্কে একের পর এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলছেন, ২০০৪ সালেই পিচ্চি হান্নানের হাতে খুন হয়েছে কালা জাহাঙ্গীর। কেউ বলেন, না- কালা জাহাঙ্গীর খুন হয়নি আবার কেউ বলেন আত্মহত্যা করেছে, কেউ বলেন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে উঠে এলো এমন আরও অনেক গল্প। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না কেউই। কিন্তু গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কালা জাহাঙ্গীর অন্তর্ধান রহস্যের কোন উত্তর নেই। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের মোস্টওয়ান্টেড কালা জাহাঙ্গীর ঘটনাটি কাল্পনিক নয়। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি সত্য ঘটনা। ঢাকাই অন্ধকার জগতের এককালের শিরোমণি কালা জাহাঙ্গীর বস্তুত আন্ডারওয়ার্ল্ডের রহস্যময় ডন হয়েই আছে এখনও। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে মোস্টওয়ান্টেড লিস্টে এখনও সবার উপরে ভেসে আসে তার নাম। কিন্তু তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য নেই তাদের কাছে। একমাত্র সম্বল কালা জাহাঙ্গীরের আঠারো বছর আগেকার একটি ছবি। আর তার এ রহস্যময়তাকে পুঁজি করে এখনও বিভিন্ন চক্র তার নাম বেচে খাচ্ছে। এক সময় বড় কোন সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করলে কালা জাহাঙ্গীরের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছিল পুলিশের রুটিন কাজের একটি। জানতে চাওয়া হতো, শেষ কবে দেখা হয়েছিল বা যোগাযোগ হয়েছিল কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তার কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারও কাছেই। বিস্ময়কর হচ্ছে, বিশ্বের তাবৎ গ্যাংস্টারের কোন না কোন খোঁজ ইন্টারপোলের কাছে থাকে। কিন্তু কালা জাহাঙ্গীর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইন্টারপোলের মোস্টওয়ান্টেড লিস্টে নাম থাকার পরও কোন রকম সন্ধান জানা নেই কালা জাহাঙ্গীরের। গোয়েন্দা সূত্রমতে, ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাঁচটি লেটারসহ স্টার মার্কস নিয়ে পাস করে কালা জাহাঙ্গীর। এমন রেজাল্ট করত বাছাই করা অল্প কিছু ছাত্রই। সে হিসেবে ভবিষ্যতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে স্কুলশিক্ষিকা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করারই কথা ছিল তার। কিন্তু সময়ের অদ্ভুত খেলার কথা কে জানত! কে জানত তার এ মেধা কাজে লাগবে অন্ধকার জগতে? কালা জাহাঙ্গীরের ভাল নাম ফেরদৌস জাহাঙ্গীর। ১৯৭৭ সালে বগুড়ায় জন্ম। বগুড়ার ধুনট থানার বনানীগাঁও তাদের গ্রামের বাড়ি। তবে বেড়ে ওঠে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে। ১৩১/১নং আদর্শপল্লীর বাসায় থাকত মায়ের সঙ্গে। অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুল পেরোনোর পর ভর্তি হয়েছিল তেজগাঁও কলেজে। কিন্তু ওই সময় ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। কাফরুল এলাকার লিটন ও মাসুম নামের দুই যুবকের সঙ্গে বিরোধ বাধে জাহাঙ্গীরের। বিরোধের একপর্যায়ে তাদের ছুরিকাঘাত করে বসে জাহাঙ্গীর। এ ঘটনার জের ধরে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জীবনে এই একবারই গ্রেফতার হয় সে। ২১ দিন হাজতবাস করে ছাড়া পায়। কিন্তু এ ২১ দিনের হাজতবাসে বদলে যায় অনেককিছুই। ২১ দিনে তার ভেতরকার তুখোড় মেধাবী ছেলেটি বনে যায় এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীতে। এ ২১ দিনে ফেরদৌস জাহাঙ্গীর হয়ে ওঠে কালা জাহাঙ্গীর। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ১৯৯২ থেকে অন্ধকার জগতে পথচলা শুরু হয় এ গ্যাংস্টারের, নাম কালা জাহাঙ্গীর। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুর্ধর্ষ সব কিলিং মিশনে অংশ নিয়ে আর মেধার জোরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষে উঠে আসে। নৃশংস সব গ্যাংস্টারকে নিয়ে গড়ে তোলে নিজের দল ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ডে রদবদল হলে যোগ দেয় ফাইভস্টার গ্রুপে। এখানে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আরেক কুখ্যাত গ্যাংস্টার পিচ্চি হান্নানের সঙ্গে। এ সময় রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে কালা জাহাঙ্গীর। দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে অপরাধ জগতের সর্বত্র। ১৯৯৫ সালের পর থেকে ঢাকার চাঁদাবাজির অধিকাংশই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দেশের সবচেয়ে বেশি অবৈধ অস্ত্রের মজুদও ছিল তার কাছেই। ১৯৯৬ সালে কিসলু হত্যার মধ্য দিয়ে পেশাদার খুনে হাতেখড়ি হয় কালা জাহাঙ্গীরের। এরপর একে একে তার হাতে খুন হতে থাকে ওয়ার্ড কমিশনার, আইনজীবী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নামকরা ব্যবসায়ীও। সে সময়ে ঢাকা শহরে অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর খুনগুলোর হোতা ছিল জাহাঙ্গীর। পিচ্চি হান্নান আর কালা জাহাঙ্গীর একসঙ্গে সরাসরি অংশ নেয় কমিশনার শাহাদাত, এ্যাডভোকেট হাবিব ম-ল ও আদালতপাড়ায় মুরগি মিলন কিলিং মিশনে। কালা জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা ঘটনাটি ছিল কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আট নং ওয়ার্ডের কমিশনার নিউটন নিজেই ছিলেন প্রবল ক্ষমতাধর এক নেতা। নিউটনের নির্বাচনী এলাকা মিরপুর নিয়ে তার সঙ্গে বিরোধ চলে আসছিল আন্ডারওয়ার্ন্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। এর চূড়ান্ত রূপই দেখা যায় ২০০২ সালের ১০ মে। সেদিন নিউটনের ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সে উপলক্ষে তিনি ধানম-ি ২৭ নম্বরের অর্কিড প্লাজার শীতল হেয়ার ড্রেসারে যান চুলে কলপ করতে। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা, অর্কিড প্লাজা রাজধানীর ব্যস্ততম মার্কেটগুলোর একটি। নিউটন সেলুন থেকে বের হয়ে সিঁড়ির সামনে আসামাত্রই শুরু হয় চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ। চার-পাঁচজন অস্ত্রধারীর নিশানায় পরিণত হয়ে লুটিয়ে পড়েন নিউটন। কিন্তু গুলি করা বন্ধ করেনি ঘাতকরা। একটি-দুটি নয়, প্রায় ২২টি গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় নিউটনের শরীর। এরপর নিউটনের মাইক্রোবাসকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে উধাও হয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। মাত্র দেড় মিনিটে শেষ হয় দুর্ধর্ষ ওই কিলিং মিশন। এ ঘটনা দেশজুড়ে ভীষণ আলোড়ন তোলে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিয়ে আরেকটি গুজব ছিল তার আত্মহত্যা। এটি জানা যায় তার একসময়কার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রামপুরার সন্ত্রাসী শাহজাদার কাছ থেকে। ২০১০ সালে শাহজাদাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেরার মুখে সে জানায়, ২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিজ মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে জাহাঙ্গীর। পরে তাকে গুলশানের কড়াইলের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সংবাদ আবার সে জেনেছে আরেক সন্ত্রাসী লম্বা শামীমের কাছ থেকে, যে কালা জাহাঙ্গীরের দাফনের সময় উপস্থিত ছিল। তবে এ সংবাদটি ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই মনে করে পুলিশ। পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই অনেক সময় সন্ত্রাসীরা মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে।
×