ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীরাই খাচ্ছেন চিনির মিষ্টি, ঈদের আগে দাম আরও বাড়তে পারে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৩ জুন ২০১৭

ব্যবসায়ীরাই খাচ্ছেন চিনির মিষ্টি, ঈদের আগে দাম আরও বাড়তে পারে

এম শাহজাহান ॥ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনিতে ১৩ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। পাইকারি বাজারখ্যাত রাজধানীর মৌলভীবাজারে বর্তমান প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ টাকায়। এই চিনি ভোক্তাকে খুচরা বাজার থেকে ৭২-৭৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও মিল সংস্কারের নামে উৎপাদন বন্ধ রেখে এবার রমজানে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মিল মালিকদের অতি মুনাফায় কষ্ট বেড়েছে সাধারণ ভোক্তাদের। ঈদ সামনে রেখে আরেক দফা চিনির দাম বাড়ানোর অপকৌশল নেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা ছিল, খুচরা পর্যায়ে ৬০ টাকার নিচে থাকবে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম। কিন্তু চিনি নিয়ে মিল মালিক, পাইকার এবং খুচরা পর্যায়ে যে ‘খেলা’ চলছে তাতে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের পকেট ফাঁকা করে চিনির ‘মিষ্টি’ খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাই। ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে চাল, চিনি এবং ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্য ভ্যাটমুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু তারপর বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। জানা গেছে, রোজার শুরুতে প্রতি কেজি চিনি ৭৫-৭৮ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম কিছুটা কমে ৭২-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে পাইকারি বাজারের তুলনায় এই দামও অনেক বেশি। খুচরা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে দুর্বল বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। আর এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ পর্যায়ে কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, শুধু রমজান মাসে অতিরিক্ত আড়াই লাখ টন চিনির প্রয়োজন হয়। এ সময় ক্রেতাকে চিনির দাম গড়ে ১৩-১৫ টাকা বেশি দিতে হলে তাদের পকেট থেকে ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে বিপুল অঙ্কের টাকা। যেন দেখার কেউ নেই। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা খোলা চিনি ৭২-৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে প্যাকেটজাত চিনি পেতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৭৫ টাকা। অথচ চিনির এ মূল্যবৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ নেই। ইন্টারন্যাশনাল সুগার অর্গানাইজেশনের (আইএসও) তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি মাসে সাদা চিনির টনপ্রতি দর ৫৩০ ডলারের বেশি ছিল। সর্বশেষ মে মাস শেষে সেই দর ৪৩২ ডলারে নেমেছে। অন্যদিকে জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে এসেছে ১৭ লাখ টন চিনি, যা মোট চাহিদার চেয়েও ৩ লাখ টন বেশি। এদিকে, ঈদের আগে চিনির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে কোথায় ঠেকবে দাম সেই আশঙ্কায় রয়েছেন সাধারণ ভোক্তারা। কারণ চিনি নিয়ে ভোক্তাদের তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। টিসিবির তথ্যমতে, গত এক মাসে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে ১২-১৫ দাম বাড়ায় এখন ভোক্তাকে খরচ করতে ৭২-৭৫ টাকা পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, চিনির দাম নিয়ে আসলেই আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। দেশীয় মিল মালিকদের কারণে চিনির দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমতির দিকে রয়েছে। আর দেশে চিনির দাম বাড়ছে। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে চিনির বাজার জিম্মি হয়ে পড়ছে। এদিকে, এপ্রিল মাসে পাইকারি বাজারে চিনির বস্তা (৫০ কেজি) ছিল ২ হাজার ৯০০ টাকা। ওই মাসের শেষদিকে শীর্ষস্থানীয় চিনি উৎপাদনকারী মেঘনা গ্রুপের চিনির মিল সংস্কারের জন্য সপ্তাহ খানেক বন্ধ ছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রাজধানীর মৌলভীবাজারে যখন চিনির সরবরাহ কমে যাওয়ার আভাস পাওয়া যায়, তখনই সরবরাহ আদেশ (এসও) হাতবদল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এবার যখন মেঘনা গ্রুপের মিল বন্ধ হয়ে বাজারে সরবরাহে টান পড়ল, তখনই পাইকারি বাজারে দাম বাড়তে শুরু করল। রমজান আসলেই মিলগুলো সংস্কারের নামে চিনি উৎপাদন বন্ধ রাখা এক ধরনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মূলত, চিনির কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়ানোর জন্যই এ ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করা হয়। মেঘনা গ্রুপের পাশাপাশি এস আলম, টিকে গ্রুপ, ইগলু এবং সিটি গ্রুপ দেশে চিনি বাজারজাত করে থাকে। র’ সুগার আমদানি করে এসব প্রতিষ্ঠান মিলে সাদা চিনি উৎপাদন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র দাবি করেছে, দাম বাড়ার জন্য মিল মালিকরাই দায়ী। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের কারসাজি বন্ধে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রোজার আগমুহূর্তে কোনভাবেই মিল সংস্কারের কাজ শুরু করা যাবে না। বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। ঈদের আগে চাহিদার বেশিরভাগ চিনি আমদানি করেছেন মাত্র দেশের ভোগ্যপণ্যের শীর্ষ চার ব্যবসায়ী। পরিশোধন কারখানারও মালিক তারা। তাই উৎপাদন বন্ধ রেখে বাজার অস্থির করার সুযোগও পাচ্ছেন এসব ব্যবসায়ীরা। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্রো জনকণ্ঠকে বলেন, সরবরাহ পরিস্থিতি এখন কিছুটা ভাল হলেও ঈদের আগে মিল মালিকরা কি ধরনের আচরণ করে সেটাই দেখার বিষয়। তাদের কারসাজি বন্ধ না হলে ওই সময় চিনির বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন চিনির দাম কমে গেছে। এটাই ভরসা। তিনি বলেন, তদারকির অভাবে উৎপাদকরা বাজার নিয়ে খেলতে পারছে। আর সুযোগ নিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ টাকা তাহলে এই চিনি কেন খুচরা বাজারে ৭৫ টাকায় বিক্রি হবে?
×