ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভারি বর্ষণ ও ঝড়োহাওয়া

চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে ৩ লাইটার জাহাজ ডুবেছে, তলিয়ে গেছে বহু এলাকা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৩ জুন ২০১৭

চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে ৩ লাইটার জাহাজ ডুবেছে, তলিয়ে গেছে বহু এলাকা

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য এবং গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে ফের প্রবল বর্ষণ চট্টগ্রামে। সমুদ্র বন্দরগুলোর জন্য মহাবিপদ সঙ্কেত জারি না হলেও এবারের বর্ষণে ব্যাপক ভোগান্তি হয়েছে। ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ডুবে গেছে ক্লিংকারবোঝাই তিনটি লাইটার জাহাজ। তীরে এসে আছড়ে পড়েছে গমবোঝাই আরও দুটি। এছাড়া জোয়ারের পানি ও বৃষ্টির পানি মিলে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের হালিশহর, আগ্রাবাদ এবং বরাবরের মতো নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রবিবার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু সড়কগুলো। সোমবার পুরোদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। শুধু জনভোগান্তিই নয়, ঝড়ো হাওয়ায় ব্যাহত হয় বন্দর বহির্নোঙ্গরে পণ্য ওঠানামা এবং অভ্যন্তরীণ জলপথ পণ্য পরিবহন। প্রচ- বাতাসের তোড়ে ডুবেছে সিমেন্ট ক্লিংকারবোঝাই তিনটি লাইটার জাহাজ। তীরে আছড়ে পড়ে গমবোঝাই একটি জাহাজ। সৃষ্ট স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে আরও দুয়েকদিন এমন অবস্থা বিরাজ করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর। সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া দফতর জানায়, সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৮০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সাগরে এ মুহূর্তে গভীর নিম্নচাপ নেই। তবে স্থল নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা বরণ করে নিচ্ছে বর্ষা মৌসুমকে। বর্ষার প্রারম্ভে সাধারণত বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয় না। লঘুচাপ এবং স্থল নিম্নচাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এগিয়ে আসে বর্ষা ঋতু। বরাবরের মতো এবারও তাই হচ্ছে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া দফতরের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সৈয়দা মিমি জনকণ্ঠকে জানান, বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য রয়েছে। এছাড়া রয়েছে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা। সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাগরে বাতাসের তীব্রতা থাকায় মাছ ধরার নৌকা এবং ছোট-খাটো নৌযানগুলোর জন্য উপকূলের কাছাকাছি থেকে নিরাপদে চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে। তিনি জানান, আগামী আরও দুয়েকদিন এ অবস্থা বিরাজ করবে। এরপর আবহাওয়ার উন্নতি ঘটবে। তবে এরই মধ্যে চলে এসেছে বর্ষা। স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে রবিবার রাত ৯টার পর থেকে চট্টগ্রামে বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১টার পর শুরু হয় বর্ষণ, যা থেমে থেমে সারারাত অব্যাহত ছিল। সকালে কিছুক্ষণের জন্য তীব্রতা কমে এলেও ফের শুরু হয় বৃষ্টিপাত। এ অবস্থা ছিল সারাদিন। বৃষ্টিতে নিচু এলাকাগুলোর সড়ক এবং সংলগ্ন বাসা-বাড়ির নিচতলা ডুবে যায়। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ে। এতে পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। নিচু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে হাঁটু থেকে বুক পর্যন্ত। সেখানে বসবাসকারী জনসাধারণকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ার থাকায় পানি নিষ্কাশিত হতে পারেনি। ফলে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং ছোটপুল এলাকা চলে যায় পানির নিচে। সেখানে চলাচলের জন্য একমাত্র ভরসা রিক্সা এবং রিক্সা ভ্যান। সাধারণ মানুষকে পরিশোধ করতে হয় সাধারণ ভাড়ার চেয়ে অন্তত ৫ গুণ বেশি। চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় মোরার আগেও একবার এমন থৈ থৈ অবস্থা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়সহ এ বছর এনিয়ে তিনবার জলাবদ্ধতার কবলে পড়ল চট্টগ্রাম নগরী। আগ্রাবাদ, ছোটপুল ছাড়াও হালিশহর, বাকলিয়া, চকবাজার, মুরাদপুর, শুলকবহর, চাক্তাই, সাগরিকা, কাপাসগোলাসহ নি¤œাঞ্চল পানিতে সয়লাব হয়ে পড়ে। সড়কে যানবাহন চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। বাসাবাড়ি এবং নিজ নিজ অফিস এবং প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে আগ্রাবাদ এলাকায়। সেখানে মহেশখালে নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এ অবস্থা বলে অভিযোগ এলাকাবাসী। ভুক্তভোগী মানুষের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বাঁধটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। সিটি কর্পোরেশনের অনুরোধেই বাঁধটি নির্মাণ করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেলে বন্দর কর্তৃপক্ষ বাঁধটি অপসারণ করবে। ডুবেছে ৩ লাইটার জাহাজ সোমবার প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙ্গরে ডুবেছে তিনটি লাইটার জাহাজ। এগুলো মাদার ভেসেল থেকে সিমেন্ট ক্লিংকার লাইটারিং কাজে ব্যস্ত ছিল। তিন জাহাজের মধ্যে যে দুটি জাহাজের নাম জানা গেছে সেগুলো হচ্ছেÑ এমভি মার্কেন্টাইল-৭ এবং এমভি অলিম্পিক-২। চট্টগ্রাম বন্দর লাইটারেজ ঠিকাদার সমিতির সভাপতি শফিক আহমেদ জানান, বাতাসের গতিবেগ এতটাই বেশি যে বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেলের পাশাপাশি লাইটার জাহাজ রাখা যাচ্ছে না। এর ফলে পণ্য লাইটারিংও বন্ধ হয়ে আছে। সাগর উত্তাল থাকায় অভ্যরন্তীণ জলপথে পণ্য পরিবহনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত রয়েছে। ডুবে যাওয়া ক্লিংকারবোঝাই জাহাজের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপিত হয়নি। তবে ডুবে যাওয়া জাহাজের কারণে বন্দরে জাহাজ চলাচলে কোন বিপর্যয় সৃষ্টি হয়নি বলে জানিয়েছে বন্দর সূত্র। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সবকটি জাহাজকে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের নির্দেশনা প্রদান করেছে। বড় জাহাজ ছাড়া ছোট বা মাঝারি ধরনের জাহাজগুলো থেকে পণ্য খালাস সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে, পতেঙ্গা বেড়িবাঁধে এসে আছড়ে পড়ে গমবোঝাই একটি লাইটার জাহাজ। এমভি অনন্যা-২ নামের এ জাহাজটি তীর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে নোঙ্গর করা ছিল। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা বাতাসের তোড়ে এ জাহাজ তীরে এসে পড়ে। জাহাজটিতে মোট ১৪ জন নাবিক ছিলেন। কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তারা। পরে বিশেষ ব্যবস্থায় তারা নিরাপদে নেমে আসেন। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় এমন চিত্র দেখা যায়নি ঘূর্ণিঝড় মোরার সময়ও। বাতাসের গতিবেগ অনেকটা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। পানি ফুলে উঠেছে বেড়িবাঁধের একেবারে ওপরের পাথরগুলো পর্যন্ত। সাগরতীরে ৫ শতাধিক দোকানের সবগুলোই বন্ধ হয়ে যায়। কোন কোন দোকান ক্ষতিগ্রস্তও হয়। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ভেসে গেছে। সেখানকার অধিবাসীরা জানান, ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় মোরার সময়ও এত বাতাস এবং এত উচ্চতার ঢেউ তারা দেখেননি। দুর্গতি থেকে মুক্তি আগামী বছর? চট্টগ্রাম নগরীর জন্য এখন অভিশাপ হিসেবে দাঁড়িয়েছে মহেশখাল এবং ছোট-বড় প্রায় সকল খালের ওপর অবৈধ দখলদারিত্ব। এমনিতেই দিনে দুবার জোয়ার হয়ে থাকে। বর্ষণের সময় যদি সে জোয়ার থাকে তাহলে চিত্রটি হয় থৈ থৈ। প্রতিবারই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের অঙ্গীকার থাকে নগরীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করা। কিন্তু মেয়র যায়, মেয়র আসেÑঅবস্থার উন্নতি হয় না। তবে এবার একটি স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে তা বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিী। চসিক মেয়র আ জ ম নাছির সোমবার পরিদর্শন করেন নগরীর আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ব্যাপারীপাড়া এলাকায়। তার সঙ্গে ছিলেন কাউন্সিলরবৃন্দ। চট্টগ্রাম নগরীর এটিই সবচেয়ে জলাবদ্ধ এলাকা। অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ধারণা নেয়ার জন্য করে তিনি সেখানে যান বৃষ্টিপাত চলাকালে। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, মহেশখাল খনন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, দুই পাড়ে সড়ক নির্মাণ এবং এক্সেস রোড উঁচু করে পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই সম্পন্ন করা গেলে এ অবস্থা থাকবে না। এ জলাবদ্ধতার নেপথ্যে মহেশখালে বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্মাণ করা বাঁধের প্রতি অনেকের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনস্বার্থেই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল, যদিও এক পাশের অধিবাসীরা সুফল পেলেও আরেক পাশের মানুষ তা পাননি। তাছাড়া এবার বৃষ্টিপাতও হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নাগরিকদের দায়িত্বশীলতার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন মেয়র। তিনি বলেন, নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কর্পোরেশন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সাধারণ মানুষেরও উচিত যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে খাল এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত না করা।
×