ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জারি হয়নি রেড নোটিস ॥ পুলিশ তাদের সন্ধান চালাচ্ছে

হিজরতের নামে নিখোঁজ ৫০ জঙ্গীর নাম নেই ইন্টারপোলে

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১২ জুন ২০১৭

হিজরতের নামে নিখোঁজ ৫০ জঙ্গীর নাম নেই ইন্টারপোলে

শংকর কুমার দে ॥ দেশে গত এক বছর ধরে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত পুলিশের সন্দেহভাজন নিখোঁজ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নাম আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থার (ইন্টারপোল) রেড নোটিসে নেই। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় বাংলাদেশের মোট ৮১ জনের নাম আছে। এই তালিকায় যাদের নাম আছে তার মধ্যে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পলাতক পুরানো মামলার আসামি জঙ্গীদের নাম রয়েছে। তবে গত বছর হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর নব্য জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর পলাতক সদস্য রয়েছে যারা জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত হয়ে বিদেশে চলে গেছে এমন সন্দেহভাজন নিখোঁজদের কারও ইন্টারপোলের রেড নোটিসভুক্ত হয়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশী তদন্তে নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বলা হয়েছিল, সন্দেহভাজন জঙ্গী যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের মাধ্যমে এদের খোঁজ করা হবে। কিন্তু নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রায় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামের তালিকা ইন্টারপোলের রেড নোটিসে স্থান পায়নি। এই নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় আছে, কি করছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছেও কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে নিখোঁজদের সন্ধান করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। জঙ্গী তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর কয়েকটি অভিযানে নব্য জেএমবির সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীসহ প্রথম সারির সন্ত্রাসবাদী নেতারা নিহত হলেও নিষ্ক্রিয় করা যায়নি সংগঠনটিকে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের জঙ্গী সংগঠনটি একযোগে বোমা হামলা চালানোর ঘটনায় এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও ঐ সব ঘটনায় দায়ের করা সব মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে বিচার শেষ হয়নি। বরং আগের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে নিষিদ্ধ এই জঙ্গী সংগঠনের সন্ত্রাসী ও পৈশাচিক কার্যক্রম। নব্য জেএমবির ব্যানারে নতুন নেতৃত্বের হাতে নতুন করে সংগঠিত হয়েছে জঙ্গীরা। নব্যধারার জেএমবিই গুলশান ও শোলাকিয়ায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে দায়ের করা হয় ১৬১ মামলা। এক যুগ পার হয়ে গেলেও এখনও ত্রিশটিরও বেশি মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। পলাতক অনেক জঙ্গীকে গ্রেফতার করাও সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে তারা নতুন করে সংগঠিত হয়ে গত কয়েক বছরে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন কৌশলে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাচ্ছে জঙ্গীরা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছেন এমন অন্তত অর্ধ শতাধিক এখনও নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে গত তিন বছরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে দেশ ছেড়েছেন অন্তত ৩৫। হিজরতের নামে বাড়িঘর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন যাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন সিরিয়া বা ইরাক বা ভিন্ন দেশে চলে গেছে। এদের মধ্যে আবার বিভিন্ন সময়ে ৪ জন ইরাক বা সিরিয়ায় নিহত হয়েছে বলে মৃত্যুসংবাদসহ তাদের ছবি প্রকাশও করেছে আইএস। এছাড়া মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার পর নিখোঁজ, যাদের বিরুদ্ধে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। আরও কয়েকজন দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া গেছে, তারা ঠিক কোন দেশে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তদন্ত করছে পুলিশ। অথচ এক বছর থেকে তিন বছর ধরে হিজরতের নামে নিখোঁজ হয়ে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত সন্দেহভাজন হলেও তাদের কারও নাম ইন্টারপোলের তালিকায় নেই। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর ১৮ দিনের মাথায় র‌্যাব ২৬২ জনের নিখোঁজ তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় অবশ্য ত্রুটি থাকার খবর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর ওই বছরের ২৫ জুলাই দ্বিতীয় দফা ও ৯ আগস্ট তৃতীয় দফা সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। সর্বশেষ তালিকায় ৭০ জনের নাম ছিল। যাদের মধ্যে সাগরপথে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তি এবং পরিবারের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নামও ছিল। সর্বশেষ নিখোঁজ তালিকার ৭০ জনের মধ্যে ২৫ জনের বিরুদ্ধে জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাদের মধ্যে দুই জন গত বছরের ২৭ আগস্ট জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হন। তারা হলেন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী ও তার সহযোগী তাওসিফ হোসেন। র‌্যাবের তালিকার ১৭ জন এখন দেশের বাইরে রয়েছে বলে জানা গেছে। র‌্যাবের তালিকায় থাকা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে বাড়ি ছাড়ার যে তথ্য রয়েছে তাতে ঢাকার লালবাগের সাদমান হোসেন পাপন, ঢাকা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আকরাম হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র মোঃ শরিফুল ইসলাম, মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট এবং সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ি গ্রামের কলেজছাত্র তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও নকতিপাড়া গ্রামের হোসেন আহমদ। এদের মধ্যে বাশারুজ্জামান নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার স্ত্রী শায়লা আফরিন গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আজিমপুরে এক জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী আছে। এছাড়া আরও যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের মধ্যে ব্যান্ডশিল্পী জুবায়েদুর রহিম, গোপালগঞ্জের সায়মা আক্তার (মুক্তা), ঢাকার পান্থপথের আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাব্বিরুল হক চৌধুরী (কনিক), দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার বলভপুরের আবদুস সামাদ ও আবদুল বারিক, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের রুবেল ও ইমরানুল ইসলাম, চন্দনাইশের জসিম, চিটাগাং গ্রামার স্কুলের ছাত্র সাঈদ আনোয়ার খান। এদের মধ্যে অনেকেই দেশের ভেতরেই আছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজন পরে ফিরে এসেছে। তারা দেশের ভেতরে ছিল। পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য ও অভিমান করে তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছে। আরও যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছে তারাও ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ইন্টারপোলে এই তালিকা দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। তবে প্রয়োজন হলে তালিকা দেয়া হবে। বর্তমানে আহমেদ শাহেদ, মোস্তাক আহমেদ, আশিক, মঈন ও শাহানুর আক্তার হ্যাপীর নাম রয়েছে, যারা বিভিন্ন সময়ে দেশেই নিখোঁজ হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টারপোল ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, ইন্টারপোলের রেড নোটিসে হালনাগাদ তালিকাধারীদের নাম ও পরিচিতি রয়েছে। তবে কয়েকজন নিখোঁজ ব্যক্তির নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় রয়েছে, যারা কেউ জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত আছে কিনা সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের ইন্টারপোল ডেস্ক সূত্রে জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়, তারা সবাই শীর্ষ অপরাধী ও পলাতক। এদের অবস্থান ও গ্রেফতারে ইন্টারপোল চেষ্টা চালায়। সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের পর নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। প্রায় অর্ধশত নিখোঁজ ব্যক্তি যারা রয়েছে তাদের কারও নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসে নেই। তবে ইন্টারপোলের রেড নোটিসে যাদের নাম আছে তাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত আসামি, প্রায় অর্ধযুগের আগের জঙ্গী হামলার মামলার আসামি রয়েছে। কিন্তু নব্য জেএমবি নামে জঙ্গী সংগঠনটির অস্তিত্ব প্রকাশ করে গুলশান হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলার পর যারা জঙ্গী তৎপরতার সন্দেহে নিখোঁজ রয়েছে তাদের কারও নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসে নেই।
×