ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

পাতালে হাসপাতালে

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ জুন ২০১৭

পাতালে হাসপাতালে

অসুস্থতার কারণে ঢাকা মহানগরীর বেশ কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে যেতে হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রের নানা দিগদিগন্ত অবলোকন করার সুযোগ হয়েছে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীর আধিক্য এবং করুণ অবস্থার বিপরীতে বেসরকারী হাসপাতালগুলোর সুনসান ও পরিচ্ছন্ন আবহ স্পষ্ট করে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থাটা কেমন। দেশে উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বলেই বিত্তবানরা বিদেশে যেতে পছন্দ করেন। উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে দেশেই পরিষেবা নেয়া যেত। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনেকের আস্থা নেই। হয়তো তারা মনে করেন, এতে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই মনোভাব অনেকদিনেরই। অনেকের কাছে আবার দেশে চিকিৎসা মানেই বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায় ভবিতব্য। সংবিধান অনুযায়ী চিকিৎসা সুবিধা ও সেবা প্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। এই ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সর্বাধিক। কিন্তু সুষ্ঠু স্বাস্থ্য পরিষেবা যে দেশে গড়ে উঠছে না, তার কার্যকারণ নির্ণয় করে এর সুরাহা অত্যন্ত কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়ে আসছে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত তথা নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে ভিড় জমান। আর এখানে পদে পদে যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাতে অসুখের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পথই প্রসারিত হয়। মেশিন আছে, কিন্তু অকেজো। আবার দামী মেশিন রয়েছে, অথচ তা ব্যবহারের জন্য যোগ্য লোক নেইÑ এমন অবস্থা সরকারী হাসপাতালগুলোতে দৃশ্যমান। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্যপট এতই করুণ যে, সুস্থ মানুষও হয়ে যেতে পারে অসুস্থ। হাসপাতালের করিডরে মেঝেতে বাড়ি থেকে আনা তোশক-বালিশ বিছিয়ে রোগীরা শুয়ে আছে। রোগীর সঙ্গে আছে স্বজনরা। পা ফেলার জায়গা নেই। কোন কোন রোগীর আহাজারি অন্য রোগীদের হৃদকম্পন ঘটাতে বাধ্য। নোংরা, ময়লা অবস্থায় শুয়ে থাকা রোগীদের নার্স ও চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান সেবা দিতে। শরণার্থী শিবিরের মতো অবস্থা যখন, তখন প্রতিটি রোগীর জন্য আলো-বাতাস ও পরিচ্ছন্ন খাবারের ব্যবস্থা করা দুরূহ প্রায়। রোগীদের শয্যা মাড়িয়ে চিকিৎসকদের কক্ষে যেতে হয়। সেই কক্ষের পরিসর জেলখানার কনডেম সেলের মতো যেন। নড়াচড়ার স্থান তেমন নেই। এরই মধ্যে বসে রোগীদের কাগজপত্র পর্যালোচনা করছেন চিকিৎসকরা। নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। যত আন্তরিকতা নিয়েই তারা রোগী দেখুন না কেন, হাসপাতালের পরিবেশ যদি সুস্থতার সহায়ক না হয় তবে তো বিপদ প্রতি পদে পদে। আমার তো মনে হয়েছিল, হাসপাতালের করিডরজুড়ে নানা রোগের ব্যাকটেরিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোগীর সঙ্গে যেসব ‘এ্যাটেন্ডেন্ট’ রয়েছেন, তারাও রোগীর পরিচর্যা করতে করতে অসুস্থ প্রায় যেন। ক’জনের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমনটাই ধারণা হলো। এই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসকও রয়েছেন। কিন্তু একজন চিকিৎসকের পক্ষে দিনে কতজন রোগী দেখা এবং ‘অপারেশন’ করা সম্ভব, তা ভাবিত করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের যে পরিমাণ ভিড়, তাতে কর্মরত চিকিৎসকরা কতটা কুলিয়ে উঠতে পারেন, তা তারাই ভাল জানেন। বিদেশে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরাও এই হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। একজন রোগীকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা কতটা সম্ভব, সে নিয়ে ভেবেছি। নিজে রোগী হওয়ার পর অভিজ্ঞতার পরিধি বেড়েছে। মনে হয়েছে, আমরা এক বন্ধ্যা সমাজে বাস করছি। এখানে চিকিৎসকের যে অগাধ কর্মক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা তার যথাযথ ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। অথচ এর সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়েই একজন চিকিৎসক কর্মবীর হিসেবে সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে যথার্থ দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, হতে পারেন দৃষ্টান্ত। কিন্তু সেসব শুধুই ভাবনার মধ্যেই ঘুরপাক খায়। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের দৃশ্যপট দেখলে যে কারই মনে হতে পারে এসব আবর্জনার স্তূপ, দুর্গন্ধ, হোটেল, রেস্তরাঁ রোগ ছড়াতে যেমন পারঙ্গম, তেমনি সুস্থ মানুষও এই পথে চলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন অনায়াসে। এই হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সারওয়ার ইবনে সালাম বসেন একটি ঘুপচি কক্ষে। এই স্বল্প পরিসর স্থানে বসেই তাকে রোগীর সঙ্গে কথাবার্তা ও চিকিৎসাসেবাও দিতে হয়। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ডাঃ সারওয়ার তার পেশার প্রতি ভীষণভাবে নিবেদিত। প্রতিটা রোগীর শারীরিক অবস্থা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেমন জেনে নেন, তেমনি খুবই সযতেœ চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন। অনেক যতœআত্তি করে তিনি আমাকেও পর্যবেক্ষণ করেছেন। কোন সমস্যা হলে যেন ফোনালাপ করা হয়, সে কথাও বলতে ভুলেন না। ব্যবহারে, আচরণে এমনই মুগ্ধতায় আবিষ্ট করেন যেন অর্ধেক রোগই সেরে যায়। একই কলেজের নাক, কান, গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম মুন্নার কাছেও যেতে হয়েছিল। দক্ষতার সঙ্গে রোগীদের খোঁজখবর নেয়া শুধু নয়, নিজে সঙ্গে করে অন্য চিকিৎসকদের কাছেও রোগীদের নিয়ে যেতে কসুর করেন না। এমন নিষ্ঠাবান চিকিৎসক আমাদের সমাজেই রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সাধ্য না থাকলেও সুচিকিৎসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখেছি। ডাঃ মুন্না যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সেই আশির দশকের শেষে তখনই পরিচয় সাংবাদিকতার সুবাদে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদে জিএস এবং ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করলেও পড়াশোনায় ছিলেন মনোযোগী। তাই প্রথম শ্রেণীও পেয়েছেন। বৃত্তি পেয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষাও নিয়েছেন। কিন্তু কর্মস্থান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও তার সেই শিক্ষাকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট। রোগীর সঙ্গে ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, সুপরামর্শ দিতে হয়, সেসবই তার জানা। রোগী মুগ্ধ হতে বাধ্য। চিকিৎসকরা কসাই বলে কতিপয় মানুষের যে ধারণা তা উল্টে যাবে এই হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকের সান্নিধ্যে গেলে। কিন্তু হাসপাতালের বড় সমস্যা অনেক মেশিন কাজ করে না, মেরামতও হয় না। নতুন মেশিন আনা হলেও দক্ষ জনবলের অভাবে তার ব্যবহার হয় না। এমন পরিস্থিতিতে এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষায় পিজি হাসপাতাল বা বেসরকারী হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। বিশিষ্ট চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্তের মতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রতিবছর আট থেকে দশ হাজার করে চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। সরকার কোন অবস্থাতেই এত চিকিৎসকের চাকরি দিতে পারে না, দেয়া সম্ভবও নয় এবং দেয়ার কোন সুযোগও নেই। দেশের চাহিদার তুলনায় কী পরিমাণ চিকিৎসক দরকার তা নির্ণয় করা হয় না। ফলে অনেক চিকিৎসক দীর্ঘ সময় বেকার থাকেন। আমরা দেখে আসছি, একজন চিকিৎসক তৈরি করতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সরকারী মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ও কম নয়। বেসরকারী কলেজগুলোতে এই হার কয়েকগুণ বেশি। বিত্তবান ছাড়া গরিব মেধাবী ছাত্রের পক্ষে পড়াশোনা অত্যন্ত কঠিন। দেশের মফস্বল পর্যায়ে চিকিৎসকের হাল খুব সুবিধের নয়। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, জনবল, আবাসিক ভবন, আর্থিক বরাদ্দ, রোগ নির্ণয়ের উপকরণ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও এ্যাম্বুলেন্সের অভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারছে না। কোন কোন হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে অপারেশন হয় না। এছাড়া রয়েছে ওষুধ স্বল্পতা, রোগীদের নিম্নমানের খাবার, স্টাফদের দুর্ব্যবহার, দালালদের দৌরাত্ম্য, নোংরা অপরিষ্কার টয়লেটসহ নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে সরকারী এসব হাসপাতাল চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অথচ গ্রামীণ জনমানুষের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতালগুলো। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি হাসপাতালগুলোর হাল-হকিকত কেমন তা সংবাদপত্রে প্রায়ই ছাপা হয়। খোদ ঢাকা শহরের মতো মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। জরুরী বিভাগ চলে ওয়ার্ডবয় আর মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট দিয়ে। রাতে নার্স পাওয়া যায় না। আয়া এবং ওয়ার্ডবয়রা তাদের কাজ করে থাকেন। সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও দামী ওষুধ হাসপাতাল থেকে রোগীদের দেয়া হয় না। এ্যাম্বুলেন্সের ঘাটতি যেখানে খোদ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, সেখানে অন্যান্য স্থানের সরকারী হাসপাতালের অবস্থা অনুমেয়। বেসরকারী পর্যায়ে ব্যবহৃত এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে হয় অধিক দামে। উপজেলা পর্যায়ে গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক ব্যবসা তাই রমরমা। চিকিৎসা সুবিধা যা-ই থাক না কেন, এসবের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এসব হাসপাতালে ভুয়া চিকিৎসকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। হাজারে হাজারে ভুয়া চিকিৎসকের কবলে পড়ে অসুখ সারানো দূরে থাক, রোগীকে হতে হয় সর্বস্বান্ত। দেশের বিপুল জনসংখ্যার সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার কাজটি অতিমন্থর। সরকারী স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যেটুকু রয়েছে, সাধারণের ভরসা শুধু সেটুকুই। তার অতিরিক্ত বা তার চেয়ে উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজন পড়লে দিশেহারা দশা হয় রাজধানীসহ মফস্বলের অধিকাংশ মানুষের। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। অথচ এই খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ ছিল অত্যাবশ্যক। তাই মানুষ বিদেশ যাচ্ছে সুচিকিৎসার জন্য। এতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্য দেখে মনে এসেছিল সেই ১৯৭৮ সালে বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের লেখা পাতালে হাসপাতালে গল্পটি। বরেন্দ্র অঞ্চলের একজন অসুস্থ নারীর হাসপাতালে চিকিৎসার সেই করুণ কাহিনী মনে আসে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সেই অবস্থা থেকে খুব বেশি উত্তরণ ঘটেছে বলা যাবে না। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল বলা হলেও সুস্বাস্থ্য রক্ষা অতীব কঠিন আজ।
×