ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

এ্যাডাম স্মিথ ॥ আধুনিক অর্থনীতির জনক

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১১ জুন ২০১৭

এ্যাডাম স্মিথ ॥ আধুনিক অর্থনীতির জনক

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচার। বলা হয় তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল একটি বই। যা তিনি বয়ে বেড়াতেন তার হ্যান্ডব্যাগে। নাম ‘দ্য ওয়েলথ অব ন্যাশনস’, রচয়িতা এ্যাডাম স্মিথ। এ গ্রন্থটি তাকে দিয়েছে আধুনিক অর্থনীতির জনকের তকমা। এ্যাডাম স্মিথের জন্ম ৫ জুন ১৭২৩, ফিদো কাউন্টি, স্কটল্যান্ড। জন্মের দুই মাস পর মৃত্যু ঘটে পিতার । বার্ণ স্কুল অব ফ্রিক্যালডিতে অধ্যয়ন। বিষয় ছিল ল্যাটিন, গণিত, ইতিহাস এবং রাইটিং। চৌদ্দ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোতে ফ্রান্সিস হ্যাচিনসনের অধীনে নৈতিক দর্শন বিষয়ে পাঠ শুরু। সেখানে তার আগ্রহ জন্মে স্বাধীনতা, কার্যকারণ এবং বাকস্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে। অক্সফোর্ডের প্রথম দিকের বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যে তিনি একজন। সে সময় তার পরিচয় হয় ডেভিড হিউমের সঙ্গে। শিক্ষা জীবন শেষে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোতে। নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক রূপে। পরবর্তী জীবনে টিউটর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ব্যাপক ভ্রমণ করেন ইউরোপ। সে সময় সংস্পর্শে আসেন ইউরোপের নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদদের। গ্লাসগোতে অধ্যাপনার সময় প্রকাশিত হয় ‘দ্য থিউরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস’ ১৭৫৯-এ এবং ইউরোপজুড়ে আলোড়ন তোলে। ১৭৭৬ এ প্রকাশিত হয় তার অমর রচনা ‘এন ইনক্যুয়ারি ইনটু দ্য নেচার এ্যান্ড কজেস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশন্স’ যা গড়ে দেয় আধুনিক অর্থনীতির ভিত। আর তাকে দিয়েছে অমরত্ব¡। এই গ্রন্থে তিনি স্থাপন করেন ‘মুক্ত বাজার’ অর্থনীতির ভিত্তি। তিনি সামনে আনেন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার গুরুত্ব। ‘ওয়েলথ অব নেশন’-এ তিনি তুলে ধরেন ‘ডিভিশন অব লেবার’ তত্ত্ব। তিনিই প্রথম বলেন ব্যক্তিস্বার্থ আর প্রতিযোগিতার মাঝেই অর্থনৈতিক উন্নতি নিহিত। ২০০৫ এ তার ওয়েলথ অব নেশন সর্বকালের সেরা ১০০ স্কটিস গ্রন্থের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়। এ্যাডাম স্মিথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে হ্যাচিনসন ও ডেভিড হিউমের রচনা। হিউমের সঙ্গে রচনা প্রকাশিত হয় ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, অর্থনীতি এবং ধর্মের মতো বিষয়ে। থিউরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস প্রকাশিত হওয়ার পর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন এ্যাডাম স্মিথ। শুধু তার অধীনে শিক্ষালাভের জন্য ইউরোপের সেরা ছাত্ররা নিজেদের শিক্ষালয় ছেড়ে যোগ দেন গ্লাসগোতে। জুরিস প্রুডেন্স নিয়েও স্মিথের উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম রয়েছে। ১৭৬২তে অর্জন করেন ডক্টর অব ল। টিউটর হিসেবে ব্যাপক ভ্রমণ করেন ইউরোপ। মিলিত হন দার্শনিক ভলতেয়ারের সঙ্গে। পাশাপাশি মতবিনিময় করেন সে সময়ের নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদ বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, টারগোট, জিন ডি এলেমবার্ট, এন্ড্রু মরেলেট, হেলডেভিয়াস এবং ফ্রান্সিস কুইন্সের সঙ্গে। এই মতবিনিময় তার পরবর্তী কর্মে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে নিশ্চিত ভাবেই। এবং এও সত্যি তার কাজ ব্রিটিশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের অর্থনীতিতে প্রভাবিত করেছে। স্থায়ী রূপ দিয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক অর্থনীতি। স্মিথকে নিয়ে সমালোচনা যে নেই তা কিন্তু নয়। তার উল্লেখযোগ্য সমালোচকদের মধ্যে প্রথমেই নাম আসে আলফ্রেড মার্শালের। তার ভাষায় কেবল সম্পদ নয় মানুষও সমান গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতে। অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী জোসেফ ই. স্টিগলিজ তার ‘ইনভিজিবল হ্যান্ডস’-এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। অর্থনীতির বাইরেও বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এ্যাডাম স্মিথ। যার মধ্যে আছে ‘অ্যাসে অন ফিলোসোফিক্যাল সাবজেক্ট’ হিস্ট্রি অব এসট্রোনমি, এনসিয়েন্ট ফিজিক্স, মেটাফিজিক্স, লেকচার অন জুরিস প্রুডেন্স, লেকচার অন জাস্টিস, পুলিশ, রেভেনিউ ও অস্ত্রের মতো বিষয়। ব্যক্তি জবীনে ছিলেন খামখেয়ালি অন্তর্মুখী। অকৃতদার স্মিথের জীবনের কেন্দ্রে ছিলেন তার জননী। ফ্রান্স থেকে ফিরে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান মায়ের সঙ্গে। আত্মজীবনীকারদের ভাষায় সদা অন্য মনস্ক অনুভূতিহীন হাসি আর বিচিত্র কথাবার্তার অভ্যেস নিয়েই স্মিথ। প্রায়ই কথা বলতেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে। মাঝেমধ্যে কাল্পনিক অসুস্থতায় ভুগতেন। বই এবং খাতাপত্র উচুঁ করে সাজিয়ে রাখতেন লাইব্রেরিতে। অদ্ভুত ছিল তার চা পানের অভ্যাস। একবার ঘুমের ঘোরে হেঁটে ২৪ কিমি পথ পাড়ি দেন। নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না। তার ধারণা ছিল এতে তার বইয়ের বিক্রি কমে যাবে! তার অনুরোধে মৃত্যুর পর তার সমস্ত অপ্রকাশিত রচনা ধ্বংস করে ফেলা হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ ১৭ জুলাই ১৭৯০-এ ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। গত ৫ জুন সারা বিশ্বে পালিত হলো তার ২৯৪তম জন্মদিন।
×