ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আনু মাহ্মুদ

বাজেট ২০১৭-১৮ বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১১ জুন ২০১৭

বাজেট ২০১৭-১৮ বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জ

গতবারের মতো এবারের বাজেটকেও উচ্চাভিলাষী আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তির বাজেট ঘোষণা করায় ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কাজেই এটি একটি বাস্তবায়ন অযোগ্য বাজেট। দেখা যায়, প্রতি বছর অনেক বড় বাজেট দেয়া হয়। সন্দেহ নেই, এর মধ্যে ‘লোক দেখানো’ একটি প্রবণতা থাকে যে বৃত্ত-বলয় থেকে এবারও বের হতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। এ কথা সর্বজনবিদিত, উন্নয়ন বাজেটের বিশাল আকার থাকলেও বছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। এবারের বাজেটও এ ছক থেকে বের হতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের কয়েকটি দাবি ছিল। দুঃখজনক হলো, বাজেটে এসব দাবির কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে ভ্যাট ১৫ শতাংশ বহাল রাখা হয়েছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দেখা দেবে। বস্তুত ঘোষিত বাজেটকে এক ধরনের ‘মিশ্রণ’ হিসেবে অভিহিত করা চলে-যেমন কিছু উচ্চভিলাষ আছে, আছে সাহসী পদক্ষেপ, আবার একই সঙ্গে রয়েছে উদাসীনতাও। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে রাজস্ব আদায়, অর্থ ব্যয় ও ঘাটতি অর্থায়ন-এ তিনটি বিষয় জড়িত। এবার রাজস্ব আদায়ে গড়ে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এ কথা ঠিক, চলতি অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আদায় কিছুটা বাড়বে; তবে লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে বলেই মনে হয়। এছাড়া বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে বৈদেশিক অর্থায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অবশ্যই পাইপলাইনে জমে থাকা ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে এর হার ১৫-১৬ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত বাজেটের সামনে অন্তত চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলোÑ রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া রেমিটেন্সে ধস কর্মসংস্থান না হওয়া এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা। উল্লেখ্য, দেশের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেছে। এবারের বাজেটে বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূর হবে, এমন প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয়নি। বলা চলে এবারের বাজেট দেশের শিল্পোদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীকে হতাশ করেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা তাদের বিশ্লেষণেও এ হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে নতুন শিল্প যেমন গড়ে উঠবে না, তেমনি চলমান শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও সম্প্রসারিত হবে না। এর ফলে কর্মসংস্থানের পথ সঙ্কুচিত হবে, যা মোটেই কাম্য নয়। বিনিয়োগের মন্দাভাব কাটাতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বিনিয়োগ বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা দরকার, সেগুলো উপেক্ষিত হলে কীভাবে বাজেটের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। গত বছরের মূল বাজেটের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ও সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বড় এ বাজেটের জন্য অর্থ সংস্থান করতে ৩৪ শতাংশ বেশি রাজস্ব সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর থেকে এ বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সব পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতি কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। ভ্যাটের সবটাই বহন করতে হবে গরিব-মধ্যবিত্তসহ সাধারণ নাগরিককে। অথচ বিত্তবানের ওপর ধার্য প্রত্যক্ষ কর একই পর্যায়ে রাখা হয়েছে, কর রেয়াত অব্যাহত রাখা হয়েছে, অপ্রদর্শিত কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটেও। ভ্যাট বসানো হলেও সম্পূরক শুদ্ধ বহাল রাখা হয়েছে। করপোরেট করও কমানো হয়নি, এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। একদিকে সুদের ওপর ১০-১৫ শতাংশ হারে শুল্ক, অন্যদিকে ব্যাংকের আমানতের উপর আফগারি শুল্ক বাড়িয়ে কালো অর্থনীতিকেই উৎসাহিত করা হলো কিনা, সেটাই এখন আলোচিত হচ্ছে। এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ স্মরণকালের সর্বোচ্চ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ অনুন্নয়ন বাজেটের ২২ শতাংশ। পেনশন ব্যয় ধরলে অনুন্নয়ন ব্যয়ের ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থই ব্যয় হবে প্রশাসনের পেছনে। আর দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে অনুন্নয়ন বাজেটের ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় আবারও জনগণের করের টাকা ঢালা হচ্ছে। বিশাল বাজেটের এটাই রহস্য। বাজেট নিয়ে বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদরা যে যা-ই বলুন, সাধারণ মানুষ বাজেটেকে আতঙ্কের পরোয়ানা হিসেবেই দেখে। সাধারণ মানুষ মনে করে প্রতি বছর বাজেট আসে নতুন করে তাদের জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে। এবারে বাজেট সেই যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে তুলবে বৈকি। বাজেটে কোন পণ্যের দাম কমানোর কথা বলা হলেও এর কোন প্রভাব বাজারে পড়ে না। বরং বাজেটকে অজুহাত করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই বেড়ে যায়। জনগণের বেতন যদি বাড়ে চার পয়সা, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে সাত পয়সা। সরকারের মূল্যস্ফীতির তত্ত্বকথা জনগণ বোঝে না। তারা জীবনের বিড়ম্বনা দিয়ে বুঝে নেয় যে, একটা নতুন বাজেট মানেই তাদের জীবনে নতুন একটি ঝঞ্ঝাট, নতুন দুর্ভোগ। আর কৃষকসমাজ যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলশক্তি, তারা বঞ্চিত হন; লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগীরা। শ্রমিকরাও শ্রমের ন্যায্যমূল্য পান না। জনজীবনে অস্বস্তি এ মুহূর্তে বেশ স্পষ্ট। চালের দাম পৌঁছেছে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সীমায়। গ্যাসের বর্ধিতমূল্য গৃহস্থালির পাশাপাশি বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিবহন ও কারখানার উৎপাদন ব্যয়। আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ফলে বন্ধ হবে ব্যাংকে টাকা রেখে বাড়তি অর্থ পাওয়ার পথ। রেমিটেন্সপ্রবাহ নিম্নমুখী। জীবনযাপনের ব্যয় বাড়লেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো এবং ব্যক্তি বিনেযোগ বাড়াতে কর্পোরেট কর সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেই বাজেটে। বাজেট বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের দিক থেকে যতই আশাবাদ ব্যক্ত করা হোক না কেন, অভিজ্ঞ মহলে রয়েছে গভীর সংশয়। এর কারণ অনেক। এক. দুর্নীতির ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বরাদ্দ যতটা কাজে লাগবে, তার চেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজদের পকেটস্থ হওয়ার আশঙ্কা। দুই. সুশাসনের অভাব-যতই উচ্চাভিলাষী স্বপ্নবিলাসী, আর লক্ষ্যবিলাসী বাজেট হোক না কেন, দেশে যদি গণতন্ত্র ও সুশাসন না থাকে, তবে বাজেটের সফল বাস্তবায়ন কোনোভাবেই প্রত্যাশা করা যায় না। এনবিআরের দক্ষ জনবলেরও অভাব আছে। গত অর্থবছর এনবিআরকে যে টার্গেট দেয়া হয়েছিল, সেটাও কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বরং এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই এতবড় বাজেট বাস্তবায়নে যেখানে সম্পদ আহরণে রাজস্ব বোর্ডের ওপরেই নির্ভর করতে হবে সরকারকে, সেখানে এনবিআর কতটুকু সামর্থ্য রাখে এই অর্থ সংগ্রহে, সেটাও ভাবনার বিষয়।
×