ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন শেষ পর্যায়ে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ জুন ২০১৭

তৃণমূলে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন শেষ পর্যায়ে

শরীফুল ইসলাম ॥ সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখনও যেসব ইউনিট কমিটি হয়নি তা দ্রুত শেষ করতে কেন্দ্র থেকে কমিটি করে দেয়া হচ্ছে। আসন্ন ঈদের পর তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কর্মকা- চাঙ্গা করতে কেন্দ্র থেকে ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচী প্রণয়ন করা হবে। এর পর সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের আন্দোলন ও নির্বাচনমুখী করা হবে। জানা যায়, বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৭টি জেলার কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হয়েছে। বাকি জেলাসমূহের কমিটি পুনর্গঠনও শীঘ্রই শেষ হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজও শেষ পর্যায়ে। যেসব ইউনিট কমিটি এখনও হয়নি সেগুলো দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। সূত্র মতে, সারাদেশের সকল পর্যায়ের কমিটির নেতাদের কাছে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় কর্মকা-ে অধিকতর সক্রিয় হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর স্থানীয়ভাবে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে গিয়ে গ্রুপিং-কোন্দলে জড়ালে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। গতবছর ১৯ জানুয়ারি জাতীয় কাউন্সিলের পর পরই বিএনপি হাইকমান্ড দ্রুত সারাদেশের জেলা-উপজেলাসহ সকল ইউনিট কমিটি গঠনের তাগিদ দেয়। তবে কিছু এলাকায় সম্মেলন করে কমিটি করা সম্ভব হলেও অধিকাংশ এলাকায়ই কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে নেতাকর্মীরা। এর পর একে একে কেন্দ্র থেকে কমিটি করে দেয়া শুরু হয়। এখনও কিছু ইউনিট কমিটি গঠন হয়নি। তবে এগুলো দ্রুতই কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। জানা যায়, তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর কাজ শেষ করে বিএনপি প্রথমেই জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে চায়। তারপর আস্তে আস্তে জনমত তৈরি করে সরকার বিরোধী আন্দোলন করার প্রস্তুতি নেবে। তবে আন্দোলন শুরুর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে জনসভা করবে। কোথায় কোথায় জনসভা করা যায় সে ব্যাপারে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের খোঁজখবর নিয়ে জানাতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির একজন নির্বাহী কমিটির সদস্য জানান, পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচী শুরুর আগেই বিএনপির পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি গঠনের পাশাপাশি সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি এবং সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা হবে। এ ছাড়া আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ঢাকা মহানগর বিএনপির সকল ইউনিটেও কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। রাজধনীতে আন্দোলনের দায়িত্ব পালনের জন্য শতাধিক নেতাকে নিয়ে একটি বিশেষ টিম গঠনের কথাও বিএনপি হাইকমান্ড চিন্তা করছে। উল্লেখ্য, ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট কেন্দ্র থেকে চিঠি দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিএনপির ৭৫ সাংগঠনিক জেলা ও প্রতিটি জেলার বিভিন্ন ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন করতে বলা হয়। এর মাসখানেক পর ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার আগে গুলশান কার্যালয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বৈঠককালে তিনি বার বার দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সবাই মিলে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজে সহযোগিতা করবেন। তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ হলেই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করা হবে। সিনিয়র নেতারাও তখন খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি দেশে ফেরার আগেই ৭৫ সাংগঠনিক জেলা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে। খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে গিয়ে ছেলে তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ২ মাস অবস্থান করে ২০১৫ সালের ২১ নবেম্বর দেশে ফেরার পরও তৃণমূলে কমিটি করতে না পারায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা তোপের মুখে পড়েন। দলীয় কোন্দলসহ বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি জানতে পেরে এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া যেসব এলাকায় কমিটি পুনর্গঠন হয়নি সেসব এলাকা থেকে মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে দল পুনর্গঠন কাজ স্থগিত রেখেই গতবছর ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করা হয়। এর আগে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় কাউন্সিলের আগে ৬ মাস চেষ্টা করেও সারাদেশের সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন করতে পারেনি বিএনপি। পরে কেন্দ্র থেকে কাউন্সিলর ঠিক করে তাদের নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করা হয়। ৫ম কাউন্সিলের পরও তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের জন্য দফায় দফায় চেষ্টা করেও বিএনপি হাইকমান্ড ব্যার্থ হয়। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালের শেষ দিকে দল পুনর্গঠনের কাজ স্থগিত রেখে সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালনের পর নাশকতার মামলায় জড়িয়ে জেলা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অনেকেই পেরেশানির মধ্যে পড়েন। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠন করতে খালেদা জিয়া জাতীয় কাউন্সিলের আগে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে দেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় তিনি কাউন্সিলের পর তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করার কৌশল নেন। সূত্রমতে, বিএনপির থিকট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা চান যে কোন পদ্ধতিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক না কেন বিএনপি যেন সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেও জানা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো আর কোন বড় ভুল তারা করবেন না। ইতোমধ্যেই দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে এ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান তারা আগেভাগেই নিজেদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। গতবছর ১৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপি যে বিশাল আকৃতির জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেছে তা পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে। দেশে ৩০০টি সংসদীয় আসন থাকলেও বিএনপির নির্বাহী কমিটি করা হয়েছে ৫৯১ সদস্যের। আর এ কমিটির ভেতর থেকেই দলের অধিকাংশ প্রার্থী দেয়া হবে। মামলাসহ অন্য কারণে যদি দলের অনেক নেতা নির্বাচনে অযোগ্য হয় তাহলেও যাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্য থেকে অধিকাংশ প্রার্থী দেয়া যায় সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাইরেও পুনর্গঠনের পর জেলা-উপজেলার শীর্ষ পদে যারা আসবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের মধ্য থেকেই কিছু প্রার্থী দেয়া হবে। আর এ জন্যই নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বিএনপি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বস্তরে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। জাতীয় কাউন্সিলের পর নির্বাহী কমিটি গঠনের পর পরই তৃণমূলে দল গোছানোর কাজ জোরদার করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তৃণমূলে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। যেসব ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন এখনও শেষ হয়নি সেগুলোর কমিটি দ্রুতই ঘোষণা করা হবে। এর পর সর্বস্তরে বিএনপির কর্মকা- চাঙ্গা করতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। এভাবে আস্তে আস্তে দলকে আন্দোলন ও নির্বাচনমুখী করা হবে।
×