ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঘটকদের দিন শেষ-এবার বিয়ে দেবে উপগ্রহ নেট ঘটক

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ জুন ২০১৭

ঘটকদের দিন শেষ-এবার বিয়ে দেবে উপগ্রহ নেট ঘটক

সমুদ্র হক ॥ প্রণয়ের বিয়ে দূর অতীতেও ছিল। এখনও আছে। চিরন্তন থাকবে। উভয় পরিবারে সম্মতিতে ছেলে-মেয়ের বিয়েও নিকট অতীতের। কমে গেলেও তা চলমান। ঘটকালির বিয়ে বাঙালীর ঐতিহ্য। তবে বর্তমানের বিয়েগুলোতে ঘটকালির খুব একটা প্রয়োজন হচ্ছে না। ছেলে মেয়েদের ভাললাগা থেকে গড়ে ওঠা বেশিরভাগ প্রণয় পরিণয় অবধি পৌঁছুচ্ছে। এগিয়ে চলার পৃথিবীতে ঘটকালি এবং ছেলেমেয়েদের প্রণয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ঢুকে পড়েছে আকাশ উপগ্রহের নেট (ইন্টারনেট) ঘটকালি। দিনে দিনে সমাজ জীবনে বিয়ের এই আকাশ সংস্কৃতি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে তরুণ তরুণীদের পাত্রপাত্রী খুঁজে পাওয়ার জন্য ‘মানুষ ঘটকের’ দরকার নেই। উপগ্রহের বিশেষ ওয়েবসাইট আকাশ দিয়ে উড়ে এসে ঘরের ভেতরে টেবিলে (ডেস্কটপ) এবং কোলের মধ্যে (ল্যাপটপ) পৌঁছে গেছে। যেখানে তরুণ তরুণী তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে পাত্রপাত্রী পছন্দের পর সরাসরি যোগাযোগ করে বিয়ের আয়োজন করতে পারে। কেউ এই বিয়ের নাম দিয়েছে উপগ্রহের নেট ঘটকালির বিয়ে। এই বিয়ের পূর্বের অধ্যায় ছিল সেল ফোনে বিয়ে। পাত্রপাত্রী দেশ বিদেশের যেখানেই থাক বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজনে কাজী সাহেবের সামনে সেল ফোনে কবুল পাঠ করলেই বিয়ে হয়ে যেত। তার আপডেট : সেল ফোনে বা ল্যাপটপে স্কাইপি বা ভাইবারে উভয় প্রান্তে চলমান দৃশ্যে বিয়ের অনুষ্ঠান। তবে এগুলো ছিল বিয়ের পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পরে। বর্তমানে পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পালা শুরু হয়েছে আকাশের উপগ্রহ নেট ঘটকের মাধ্যমে। উপগ্রহের এই ঘটকের ফি দিতে হয় ইন্টারনেটের মেগাবাইট হিসাবে। মজার বিষয়, এই মাধ্যমে লক্ষ পাত্রপাত্রী দেখলেও কেউ ত্যক্ত বিরক্ত হয় না। পাত্রপাত্রী দেখে কোন গিফট দিতে হয় না। দেখার সময়ই পাত্রপাত্রীর খবরা খবর সবই পাওয়া যায়। পছন্দের পর নিজেরা যোগাযোগ করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিতে পারে। কেউ চাইলে বিয়ের আগে ভাব করে বা প্রণয়ে একে অপরকে চেনার ও জানার সুযোগ নিতে পারে। তবে তা লাইভে হবে না। সব কিছুরই মাধ্যম থাকবে ওয়েবসাইট, ওয়েব ক্যাম। আকাশ ঘটক বা উপগ্রহের নেট ঘটক স্কাইপি ভাইবার ইমো ইত্যাদি দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করছে। পরবর্তী কাজগুলো পাত্রপাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের সারতে হবে। এই বিয়েতেও সামান্য শঙ্কা আছে। মানুষ সৃষ্ট ঘটকালিতে যেমন পাত্রপাত্রীর পরিচয়কে অনেকটা বাড়িয়ে বলা হয় নেট ঘটকালিতেও ভুল তথ্য উপস্থাপিত করলে তা চেক কাউন্টার চেকের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হয়। তবে সাধারণত ভুল তথ্য দিলে অনেক সময় নেট তা বুঝতে পেরে ব্লক করে দেয়। বর্তমানে উপগ্রহের গুগল সার্ভিসে ম্যাট্রিমনি নামের একটি ওয়েবসাইটের কয়েকটি অংশে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (বর্তমান নাম বাংলা) নাগরিক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে বসবাসরত বাংলাভাষী (বাঙালী) তরুণ তরুণীরা একটি ফর্মে বায়োডাটা লিপিবদ্ধ করছেন। কার কি পছন্দ অপছন্দ, বিয়ের পর চাকরি করতে চায় কিনা, বিদেশে থাকতে চায় কি না ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকছে। নিজেদের গোপনীয় কিছু থাকলে তাও বিশেষ ব্যবস্থায় হাইড করা থাকে। জানতে চাইলে গুগলের কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পাতায় গিয়ে জানা যায়। যারা ডিভোর্সি নারী পুরুষ তারাও এই ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করে পাত্রপাত্রী সন্ধান করতে পারে। এসব সাইটে পাত্রপাত্রীর ছবি দেখে ও জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করে পরিচিতি জেনে পছন্দের পর রিকোয়েস্ট পাঠালে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগের সূত্রপাত হয়। তারপর ফোনে ও স্কাইপি বা ভাইবারে ভিডিও যোগাযোগ করতে হয়। অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একইভাবে ভিডিও কনফারেন্স করে সার্বিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। এই আনুষ্ঠিকতাতেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অনেক সময় বর ও কনে আলাদা স্থানে থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন কবুল পাঠ ইত্যাদি কার্য সম্পন্নের পর বর-কনের বাড়িতে নিমন্ত্রণের পালা সারা হয়। তবে স্বাক্ষরের কাজটি প্রাথমিকভাবে সারা হয় স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে। পরে উভয় পক্ষের সুবিধাজনক সময়ে হার্ড কপিতে বর-কনের স্বাক্ষর নেয়া হয়। ভিডিও দৃশ্যে এই বিয়েতে সাক্ষ্য প্রমাণ যথেষ্ট থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে স্যাটেলাইট নেটের ঘটকালিতে বিয়ে শুরু হয়েছে। এক সময়ের ঢাকার অধিক পরিচিত পাখি ভাই ঘটকের যে পরিচিতি ছিল নেট ঘটক তার চেয়ে শতগুণে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এই ঘটকের একটি নাম ‘ম্যাট্রিমনি’। নেটে সার্চ ইঞ্জিন গুগল দিয়ে ম্যাট্রিমনিতে গিয়ে দেখা যাবে লাখো পাত্রপাত্রী স্বয়ংবর সভার মতো অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্য থেকেই জুুটি বেঁধে নিচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। কয়েক তরুণ তরুণীর কথা এ রকম : নেট ঘটকের তালিকা থেকে বর-কনে বের করা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা কঠিন এবং খরচ বেশি মনে হতে পারে। এর কোনটিই ঠিক নয়। নিকট ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থাই টিকে যাবে। বিয়ের আগে একে অপরকে জানার সুযোগ করে দেবে। তবে প্রবীণ ও মধ্যবয়সীরা নেট ঘটকালির বিষয়টি এখনও সহজভাবে নিতে পারছেন না। এইসব কথা শুনে তারা ফোড়ন কেটে বলেন ‘কলি! ঘোর কলি। কলির জমানায় আরও কত কী যে দেখতে হবে’। নিকট অতীতে গ্রাম বাংলার ঘটকের পরিচিত পোশাক ছিল পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে একটা ছাতা। পকেটে নোটবুক। সেই নোটবুককে পাত্রপাত্রীর ডাইরেক্টরি বলা হতো। পাত্রপাত্রীর নাম ঠিকানাসহ কয়েক পুরুষের পরিচিতি থাকত। এই ঘটক একবার যে বাড়িতে প্রবেশ করেছে সেখান থেকে সরানো কঠিন হতো। লেগে থাকত জোঁকের মতো। কনে দেখার পালায় মেয়ে ও তার পরিবারকে কী যে অমানবিক নাজেহাল করা হতো (কোথাও এখনও হয়) তা দেখে শিউরে উঠতে হয়। কোনভাবে পাত্রপাত্রী জুটিয়ে দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিতে পারলেই ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের’ মতো অবস্থা হতো। সকালে কথা বিকেলে বিয়ে। এভাবে বিয়ে পড়িয়ে ঘটক অভিজ্ঞ ঘটকের নাম লেখাতে পারত। কদর বাড়ত। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ঘটক বিদায় করতে কিছু উপঢৌকন দিতে হতো। বর্তমানের বিয়েতে এত লম্বা প্রক্রিয়া নেই। বাঙালীর ঐতিহ্যের ওপর এখন বসেছে আকাশের স্যাটেলাইট নেট ঘটক। এই ঘটক সেদিনের জোঁকের মতো নয়। ইচ্ছে হলো নেট ঘটককে বিদায় দেয়া যায়। তাবে সাধারণত তা কেউ দেয় না। আকাশের নেট ঘটক বলে কথা। বর্তমান প্রজন্মের তরুণ তরুণীদের মধ্যে নিজেদের পছন্দের বিয়ে ও প্রণয়ের বিয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর মধ্যেই আকাশ দিয়ে উড়ে এসে ঘরে ঢুকে পড়েছে নেট ঘটক।
×