ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলের কালিহাতী পাঠাগার

সুধীজনের দেয়া ৩শ’ বই নিয়ে যাত্রা শুরু, এখন পড়া হয় শুধু পত্রিকা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ জুন ২০১৭

সুধীজনের দেয়া ৩শ’ বই নিয়ে যাত্রা শুরু, এখন পড়া হয় শুধু পত্রিকা

ইফতেখারুল অনুপম ॥ উপজেলা সদরের অফিসার্স ক্লাবের সরকারী ভবন বিনা ভাড়ায় ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সুধীজনের দেয়া মাত্র ৩০০ বই নিয়ে পাঠাগারটি যাত্রা শুরু করে। নারীদের বসার পৃথক ব্যবস্থা ছাড়াই দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত পরবাসী হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা সাধারণ পাঠাগার। পাঠাগারটি জৌলুস হারিয়ে পত্রিকা পাঠে সীমাবদ্ধ থাকছে পাঠ কার্যক্রমে। বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার বই থাকলেও পাঠক নেই বললেই চলে। জানা গেছে, কালিহাতী উপজেলার মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী অধ্যক্ষ মানছুরুর রহমানের (প্রয়াত) উদ্যোগে বিগত ১৯৯২ সালের ৫ আগস্ট স্থানীয় ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় উপজেলা সদরে ‘কালিহাতী পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এলাকার সম্ভাবনাময় মানুষের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যও ছিল পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ। প্রথমে ‘কালিহাতী পাঠাগার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে এর নামকরণ করা হয় ‘কালিহাতী সাধারণ পাঠাগার’। প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যকরী কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (পদাধিকারবলে) শেখ ফজলে এলাহী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত মানছুরুর রহমান। পাঠাগারটি তিনতলা ভবনের নিচ তলায় অবস্থিত। এখানে তিনটি কক্ষ পড়ার, দুটিতে বই রাখার জন্য এবং একটি কক্ষকে অফিস রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি টয়লেট ও বাথরুম রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারটি মূলত পত্রিকা পাঠের জন্য বর্তমানে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন ৩৫-৪০ পাঠক এখানে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা পাঠ করে থাকেন। জাতীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ধনাঢ্য সদস্যরা কিনে সরবরাহ করে থাকেন। পাঠাগার কর্তৃপক্ষ প্রথম শ্রেণীর ৪-৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত রাখেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকাগুলো এখানে মাঝে মাঝে আসে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের বুলেটিনও পাওয়া যায়। পত্রিকা পড়ছিলেন নিয়মিত পাঠক কালিহাতীর হরিপুর গ্রামের গৌরহরি প-িত, বয়স ৭০। তিনি জানান, পত্রিকা পড়ার জন্যই তিনি সপ্তাহে ৫দিন পাঠাগারে আসেন। এখানকার পরিবেশে পত্রিকা পড়ে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কালিহাতী আরএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ হাসান, আফতাব হোসেন ইপতি, কালিহাতী কলেজের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম শফি, স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন, হাসিনা ফেরদৌসী, কলেজ শিক্ষক তাহমিনা হোসেন লাবনী, কালিহাতী আরএস পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারিয়া, মীম, তাহমিনার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, নারীদের পড়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকলে ভাল হয়। বিশেষ করে পৃথক পড়ার টেবিল ও পৃথক টয়লেট থাকা জরুরী। তারা আরও জানান, এখানে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ইন্টারনেট সংযোগের পাশাপাশি ৫-৬টি কম্পিউটার থাকলে পাঠাগারের পাঠক ও সদস্য সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে ইসলামী, ইতিহাস ও গল্প-উপন্যাসের বই আরও বাড়ানো দরকার। কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান সোহেল রানা জানান, বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য পাঠাগার খোলা থাকে। পাঠগারে বর্তমানে ৮ হাজারেরও বেশি বই আছে। পাঠাগারের সাধারণ সদস্য সংখ্যা ৩৫০, আর আজীবন সদস্য সংখ্যা ২৬০। প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার জন্য ৩৫-৪০ পাঠক আসে। বই পড়া ও নেয়ার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০-১২পাঠক আসেন। তাছাড়া প্রতিদিন ৮-১০ সদস্য বাড়িতে পড়ার জন্য বই নিতে আসেন। যারা বই পড়েন তারা সাধারণত গল্প-উপন্যাসই বেশি পড়েন। এখানে গবেষণা করার মতো রেফারেন্সমূলক তেমন বই নেই, তাছাড়া কেউ গবেষণার জন্য এখানে আসেন না। পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী বিকম জানান, পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান ও একজন পিয়ন খ-কালীন হিসেবে কাজ করছেন। সদস্যদের চাঁদা ও অনুদানের টাকা থেকে তাদের খুবই অল্প পরিমাণে বেতন দেয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন বিনামূল্যে ঘরটি ব্যবহার করতে দিচ্ছে। নিয়ম মেনে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ থেকে অনুদান দিচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, পাঠাগারের জমানো টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়। এখানকার বেশিরভাগ পাঠক মূলত পত্রিকা পাঠ করে থাকেন। পাঠকদের জন্য সর্বক্ষণিক বিদ্যুত ব্যবস্থা রাখায় তারা খুব খুশি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল থাকায় রাত ৮টা পর্যন্ত নারী পাঠকরা নিশ্চিন্তে পত্র-পত্রিকা ও বই পাঠ করতে পারেন। সদস্যরা বাড়িতে নিয়েও বই পড়তে পারে। পাঠাগারে একটি কম্পিউটার থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। পাঠকরা ৫-৬টি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগের জন্য দীর্ঘদিন যাবত দাবি করে আসছে। একই সঙ্গে সদস্যসহ স্থানীয় প্রায় সকলেরই দাবি পাঠাগারের একটি নিজস্ব ভবনের। কিন্তু অর্থাভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটারের বিষয়ে তিনি সরকারের এটুআই প্রকল্পের উর্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু নাসার উদ্দিন জানান, তিনি আসার পর পাঠাগারটি দেখে উৎফুল্ল হয়ে কিছুটা সংস্কার করেছেন। চেয়ার-টেবিল ও বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করেছেন। পাঠাগার পরিচালনার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি রয়েছে। কমিটিই রক্ষণাবেক্ষণ ও যাবতীয় খরচ বহন করে থাকে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের অনুদানেই মূলত পাঠাগারটি চলছে। এছাড়া স্থানীয় ধনাঢ্য ও শিক্ষানুরাগী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সময় অনুদান দিয়ে থাকেন। সদস্যদের মাসিক চাঁদা ১০ টাকা উল্লেখ করে তিনি জানান, ওই টাকা থেকে পত্রিকা ও বৈদ্যুতিক বিল পরিশোধ করা হয়। পাঠাগারটির নিজস্ব কোন ভবন নেই। এ ভবনটি মূলত অফিসার্স ক্লাবের। বিনা ভাড়ায় ভবনটি পাঠাগারকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। যেভাবে শুরু হয়েছিল এখনও সেভাবেই চলছে। তবে পৃথক একটি নিজস্ব ভবন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×