ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন গাজী শাহাবুদ্দিন

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১০ জুন ২০১৭

চলে গেলেন গাজী শাহাবুদ্দিন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এইটুকুন বয়সে বিরাট স্বপ্ন দেখা। সফল বাস্তবায়ন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ। বাতিঘর হয়ে ওঠা। আর তার পর নীরবে নিভৃতে চলে যাওয়া। চিরপ্রস্থান। নতুন যুগের সূচনা করা ‘সচিত্র সন্ধানী’র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন ছেড়ে গেছেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার প্রিয় অঙ্গন। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগ ভোগের পর শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি স্ত্রী এক পুত্র এক কন্যাসহ আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। শেষ মুহূর্তে পিতার পাশেই ছিলেন পুত্র গাজী শুভ্র। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, অনেক দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তার বাবা। শুক্রবার দুপুরের পর অবস্থার হঠাৎ অবনতি হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার প্রস্তুতি চলে। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। তার আগেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি। তারাবি নামাজের পর পল্টন জামে মসজিদে জানাজা শেষে রাতেই বনানী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। এর আগে হঠাৎ মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বন্ধু সুহৃদ ও স্বজনেরা শেষবারের মতো প্রিয় মুখটি দেখতে গাজী ভবনে ছুটে যান। বাল্য বন্ধু আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই এ সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। গাজী শাহাবুদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এক শোক বার্তায় মন্ত্রী বলেন, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের একজন অভিভাবককে আমরা হারালাম। পঞ্চাশের দশকে ‘সচিত্র সন্ধানী’র মতো একটি কাগজ বের করা ও পাঠকের কাছে প্রিয় করে তোলা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি সেখানে শতভাগ সফল হয়েছেন। তার অবদান জাতি চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী। গাজী শাহাবুদ্দিন ১৯৩৯ সালের ১১ ফেব্রুয়রি জন্ম গ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই পত্রপত্রিকা পড়ার নেশা ছিল। সেই নেশা থেকেই ‘সচিত্র সন্ধানী’র আত্মপ্রকাশ। জানা যায়, নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ‘সচিত্র সন্ধানী’ বের করার উদ্যোগ নেন গাজী শাহাবুদ্দিন। তখন কলকাতা থেকে বিভিন্ন পত্রিকা আসত বাসায়। সবগুলোর মুগ্ধ পাঠক ছিলেন তিনি। বুক স্টলের সামনে দাঁড়িয়েও পত্রিকা পড়তেন। তবে বিশেষ ভাল লাগতো ‘সচিত্র ভারত।’ খুব আকর্ষণীয় মনে হতো তার কাছে। পত্রিকাটি নিয়মিত পড়তেন তিনি। পড়তে পড়তেই এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন বুকে বাসা বাঁধে। এইটুকুন বয়সেই শুরু হয়ে যায় স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। বন্ধু প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ, হুমায়ূন খান, রহিম চৌধুরী, শরফুদ্দিন আহমদসহ ছয়-সাত জনকে সঙ্গে নিয়ে কাজে নেমে পড়েন গাজী শাহাবুদ্দিন। নিজের মামার একটি প্রেস ছিল। করিম প্রিন্টিং নাম। সেখানে গিয়ে ছাপার কাজ সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ছাপার খরচ, কাগজের দামসহ বিভিন্ন খরচের হিসাব হাতে আসার পর তিনি বুঝতে পারেন, অনেক টাকার ব্যাপার। এত টাকা কোথা থেকে আসবে? তবুও তিনি পিছু হটতে নারাজ। নিজেদের বাসার দুটি কক্ষ নিয়ে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু করে দেন। কাজ ভাগাভাগি করে নেন বন্ধুরা। কেউ এডিটোরিয়াল বোর্ডে কাজ করেন। ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন কেউ। তবে মূল দায়িত্ব নিতে হয় গাজী শাহাবুদ্দিনকেই। নানা রকম তৎপরতা চালাতে হয় তাকে। অর্থ কড়ি সংগ্রহ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বন্ধুরা মিলে আত্মীয় সুহৃদদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। কিন্তু দিন শেষে যা পাওয়া হয় তা অতি সামান্য। এ অবস্থায় বিকল্প উদ্যোগের কথা ভাবতে হয়। তখন অর্থ সংগ্রহের জন্য সিনেমা হল ভাড়া নিয়ে সিনেমা দেখানোর প্রচলন ছিল। এক সিনেমা ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হল ভাড়া নেন তারা। ঘোড়ার গাড়িতে বসে একেকজন একেকদিন মাইকিং করেন। এমন আরও বহু বিচিত্র ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে যেতে হয় গাজী শাহাবুদ্দিনকে। ১৯৫৬ সালের ২৩ জুন প্রকাশিত হয় সচিত্র সন্ধানীর প্রথম সংখ্যা। ডিমাই ওয়ান সিক্সটিন সাইজ পত্রিকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা আনুমানিক ৩২ থেকে ৪৮। এক হাজার কপি ছাপা হয়। এবং সকাল ১০টার মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায় সব কপি। এই সাফল্যের ওপর ভর করে পত্রিকাটি নিয়মিত করার চিন্তা করেন সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন। কিন্তু কাজ যত বাড়ছিল লেখাপড়ার সময় ততো কমে আসছিল। এমনকি পরীক্ষার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে সোজা প্রেসে চলে যেতেন। পরদিন বাসায় ফিরে বলতেন, বন্ধুর বাসায় পড়তে গিয়েছিলাম। নটর ডেম কলেজে খুব কড়াকড়ি। সময় বের করা যায় না। এ জন্য সেখান থেকে বের হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন তিনি। এভাবে পত্রিকার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। পঞ্চাশের দশকে প্রকাশনার শুরু। শুরুতে সচিত্র সন্ধানী ছিল কিছুটা রম্য ও কিছুটা কার্টুননির্ভর পত্রিকা। তারপর ধীরে ধীরে এই পত্রিকা বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতির দর্পণ হয়ে ওঠে। সচিত্র সন্ধানীর দীর্ঘ পথ চলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জহির রায়হান, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, মফিদুল হক, সুশান্ত মজুমদার, শিহাব সরকারসহ শত শত শিল্পী ও সাহিত্যিক। সকলের কেন্দ্রে ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন। একাত্তরে তিনি জহির রায়হান, আলমগীর কবির, কাইয়ুম চৌধুরী, শফিক রেহমান ও সৈয়দ শামসুল হককে সঙ্গে নিয়ে ‘এক্সপ্রেস’ নামে আরেকটি সাপ্তাহিক বের করেন। সেটিও খুব পাঠকনন্দিত হয়। বন্ধুবৎসল মানবিক মানুষটি আশপাশের মানুষের দুঃসময়ে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভাবনাময় তরুণ শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের উৎসাহ দিয়েছেন। নানারকম সহায়তা দিয়েছেন। আগলে রেখেছেন। সাগরময় ঘোষ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের ঢাকার বাড়িটি ছিল গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের বাড়ি। কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরী থেকে তরুণ লেখক সমরেশ মজুমদার- সবার তখন ঢাকার ঠিকানা ছিল গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ। এভাবে বাতিঘর হয়ে ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন। তার মৃত্যুতে বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।
×