ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রুশনারার হ্যাটট্রিক, টিউলিপ ও রূপার দ্বিতীয় দফা জয়

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১০ জুন ২০১৭

রুশনারার হ্যাটট্রিক, টিউলিপ ও রূপার দ্বিতীয় দফা জয়

সালাম মশরুর, সিলেট থেকে ॥ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও বিজয় মুকুট মাথায় পরে ব্রিটিশ পার্লমেন্টে জায়গা করে নিলেন বাংলাদেশের তিন অগ্নিকন্যা বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও ড. রূপা হক। তিন কন্যাই লেবার পার্টির প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রথম বাঙালী এমপি রুশনারা আলী টানা ততৃীয়বার জয়ী হয়ে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন। দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক। এবারের নির্বাচনে প্রত্যেকেই বিগত নির্বাচনের চাইতে অধিক সংখ্যক ভোট লাভ করেছেন। তাদের বিজয়ে ব্রিটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে স্যোশাল মিডিয়ায় অভিনন্দন বার্তা দিচ্ছেন সর্বস্তরের কমিউনিটির মানুষ। ৩৫ বছর বয়সী টিউলিপ প্রার্থী হন লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে। ২০১৫ সালে নিজের প্রথম নির্বাচনে রক্ষণশীলদের শক্তিশালী প্রার্থীকে ১ হাজার ১৩৮ ভোটে হারিয়েছিলেন টিউলিপ। পরে তিনি বিরোধী দলনেতা জেরমি করবিনের ছায়া মন্ত্রিসভারও সদস্য হয়েছিলেন। টিউলিপ গতবার পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট; তার প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল দলের প্রার্থী পান ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ এবার ভোট বাড়িয়ে পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৪৬৪টি; অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট কমে হয়েছে ১৮ হাজার ৯০৪টি। এবার যুক্তরাজ্যে ভোটারদের সংখ্যা বেড়েছিল, যাদের অধিকাংশই তরুণ; এতে স্পষ্ট তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। জয়ের পর টিউলিপ বলেন, আমি ওয়েস্টমিনস্টারে হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্নের হয়ে সরব হব, হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্নে ওয়েস্টমিনস্টারের হয়ে নয়। বাংলাদেশী কমিউনিটির সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, কনজারভেটিভ যে জনবান্ধবহীন মেনিফিস্ট দিয়েছে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি নিজের নির্বাচনী আসনের জন্য অতীতের মতো কাজ করে যাবেন বলে জানান। আগাম নির্বাচনে এই জয়ের পর ব্রেক্সিট নিয়ে দর কষাকষির দিকেও নজর রাখবেন বলে জানান এই পার্লামেন্ট সদস্য। টিউলিপের জয়ের শেখ রেহানা বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন হঠাৎ করে চাপ সৃষ্টি করলেও রাজনৈতিক পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে টিউলিপ এটিকে সামলে বিজয় নিয়ে এসেছে, এ বিজয় সমগ্র বাংলাদেশের। শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গবর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী রয়েছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেন টিউলিপ, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালী নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন টিউলিপ। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় পার্টির সদস্যদের ভোটে টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকেট পান। বেথনালগ্রীন বো আসন থেকে রুশনারা আলী ৩৫ হাজার ৫৯৩ ভোটের ব্যবধানে বড় জয় পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। রুশনারা ৪২ হাজার ৯৬৯ ভোট পেয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির চার্লট চিরিকো পেয়েছেন ৭ হাজার ৫৭৬ ভোট। আর তৃতীয় হয়েছেন অপর বাংলাদেশী প্রাথী আজমল মাসরুর। তিনি পেয়েছেন ৩৮৮৮ ভোট। ২০১০ সালের নির্বাচনে প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী হিসেবে রুশনারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি প্রায় ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে ২৪ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হন। পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশী অধ্যুষিত বেথনাল গ্রীন এ্যান্ড বো আসনটি লেবার দলের নিরাপদ আসন। রুশনারার জন্মস্থান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায়। সাত বছর বয়সে তিনি মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যান। বিজয় ঘোষণার পর রুশনারা আলী এক প্রতিক্রিয়া বলেন, তিনি ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবেন। এছাড়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস রক্ষা, জব কাট থেকে তরুণদের রক্ষায় কাজ করবেন। রুশনারা আলী বিগত ৭ বছর বিভিন্নভাবে আলোচনায় ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে মূলধারার সংবাদপত্র ও কমিউনিটিতে। শ্যাডো মিনিস্টার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পদত্যাগ করে সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলেন, রোহিঙ্গা ও লেবাননে সিরিয়া রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শন করে তিনি এর দুর্দশা লাঘবে মূলধারার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এছাড়া ব্রিটিশ মূলধারা সংবাদপত্র তাকে ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলেও আখ্যায়িত করেন। গত ৭ বছর তিনি কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে সরব ছিলেন। এসবকে পুঁজি করেই তিনি হ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়লেন ৮ জুন নির্বাচনে। রূপা হক লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন আসনে দ্বিতীয় মেয়াদে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে লেবার দলীয় প্রার্থী রূপা হকের প্রাপ্ত ভোট ৩৩ হাজার ৩৭। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী জয় মোরিসি পেয়েছেন ১৯ হাজার ২৩০ ভোট। গতবার ২৭৪ ভোটে জয় পাওয়া রূপা এবার জিতেছেন ১৩ হাজার ৮০৭ ভোটের ব্যবধানে। রূপা হকের প্রাপ্ত ভোট ৩৩ হাজার ৩৭। বিশাল ভোটের ব্যবধান তৈরি করে রূপার এই বিজয় তার দক্ষতাও বিগত দিনের কর্মতৎপরতার ফসল হিসেবেই দেখছেন সবাই। লন্ডনের মধ্যে রূপার আসনটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন আসনে রূপা গতবার মাত্র ২৭৪ ভোটের ব্যবধানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। এ আসনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী জয় মোরিসের বিজয় ঠেকাতে এবার পরিবেশবাদী গ্রীন পার্টি কোন প্রার্থী দেয়নি। তারা লেবার প্রার্থী রূপাকেই সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে ডানপন্থী ইউকে ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি (ইউকিপ) কনজারভেটিভ প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে এ আসনে কোন প্রার্থী দেয়নি। মাত্র তিনজন প্রার্থী এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অপর প্রার্থী হলেনÑ লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলের জন বল। কিংসটন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রূপা লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশে তার আদিবাড়ি পাবনায়। রূপা হক বিজয়ের পর বলেন, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে রক্ষা করা, শিক্ষা খাতকে আরও উন্নত করার জন্য তিনি নিয়মিত কাজ করে যাবেন। গত মেয়াদে ব্রিটিশ বাংলাদেশী ৩ কন্যা পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে কমিউনিটির বিভিন্ন ইস্যুতে সরব থাকায় মূলধারা মিডিয়াতে বেশ আলোচিত ছিলেন। নিজের নির্বাচনী আসনের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সামনের সারিতে থাকায় তাদের এই ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নির্বাচনে মোট ১৪ জন বাঙালী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, এর মধ্যে আটজনই লেবার পার্টির হয়ে, বাকিদের চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও ফ্রেন্ডস পার্টির হয়ে লড়েন একজন করে।
×