ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনু ইসলাম

কবিতার শক্তি ॥ পাঠ পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ৯ জুন ২০১৭

কবিতার শক্তি ॥ পাঠ পর্যালোচনা

গদ্য সাহিত্যে প্রবন্ধের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। প্রবন্ধকে ‘ড়িৎশ ড়ভ ঢ়ৎড়ংব ধৎঃ’ বলা হয়। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে যখন তীব্র খরা, এমন সময় ব্যতিক্রমী একটি প্রবন্ধগ্রন্থ হাতে পেলে ভিন্ন আনন্দযোগ তৈরি হয়, যা স্বীকার না করে পারা যায় না। সম্প্রতি প্রকাশিত বীরেন মুখার্জীর ‘কবিতার শক্তি’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি হাতে পেয়ে এই মুখবন্ধ। ‘কবিতার শক্তি’ গ্রন্থের প্রবেশকে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন, প্রত্যেকটি নিবন্ধ দীর্ঘদিনের সাহিত্যপাঠ থেকে আহরিত উপলব্ধি ও নানামাত্রিক আত্মজিজ্ঞাসার আলোকে লিখিত। পাশাপাশি এসব নিবন্ধ সমালোচনা সাহিত্যে নতুনমাত্রা যুক্ত করবে বলেও তিনি আশাবাদী। দীর্ঘদিনের সাহিত্যপাঠ থেকে আহরিত উপলব্ধি কিংবা আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে একজন লেখক কতটা আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠলে এমন কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন, তা গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলো পাঠ শেষে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ‘কবিতার শক্তি’ গ্রন্থটিতে ১৬টি প্রবন্ধ সূচিভুক্ত হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটি ‘কবিতার শক্তি, কবিতায় সম্মোহন’ শিরোনামে। প্রবন্ধে, সত্যিকার অর্থে কবিতা যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা মানুষের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে কিংবা পাঠকের বোধকে জাগ্রত করতে পারে- সেই দিকটি যথার্থভাবে, নানা আঙ্গিকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন লেখক। একটি কবিতা পাঠকের কাছে ভালো লাগলে পাঠক যেমন বার বার সে কবিতাটি পাঠে আনন্দ খুঁজে পান, তেমনি একজন কবিও সেই উৎকৃষ্টমানের কবিতা বা মহৎ কবিতার অন্তর্বয়ানের উপলব্ধি পাঠে বার বার নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন কিছু সৃষ্টির অনুপ্রেরণা অনুধাবন করার সুযোগ খুঁজে পান। অর্থাৎ একটি ভালো কবিতা বার বার পাঠের ভেতর দিয়ে যে বোধ জাগ্রত হয় কিংবা যে চিন্তার উন্মেষ ঘটে তার ভেতর দিয়ে কবিতা যে একটি বৃহৎ শক্তির কাজ করে এবং পাঠকের চিত্তকে বার বার পাঠে আমন্ত্রণ জানানোর শক্তি রাখে- সেই দিকটিই মূলত কবিতার সম্মোহন হিসেবে প্রবন্ধে আলোচিত। এটা ঠিক যে, একটি মহৎ কবিতা বা উৎকৃষ্ট কবিতা পাঠক বার বার পড়েন। যেখানে অন্যান্য শাখায় প্রয়োজন ছাড়া দ্বিতীয়বার পাঠের সুযোগ কম থাকে। কবিতা জীবনের অংশ। জীবনদর্শন এর ভেতর দিয়ে একটি মহৎ কবিতা সৃষ্টি হয় বলেই পাঠক বার বার সেই মহৎ কবিতার দিকে ছুটে যান। উপলব্ধির জায়গায় নিজেকে বিচরণ করার প্রয়াসও পেয়ে যান। প্রবন্ধটিতে বীরেন মুখার্জী কবিতাকে নির্দিষ্ট কোন সময়ের কবিদের কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রবীণ-তরুণ এমনকি বিদেশী কবিদের কবিতার উদাহরণের মধ্যে দিয়ে তিনি কবিতার নানামাত্রিক শক্তি ও পাঠককে ধরে রাখা কিংবা চিন্তার উন্মেষ ঘটানোর প্রয়োজন বোধ থেকেই উদাহরণ টেনেছেন। বার বারই পাঠযোগ্য কিংবা মহৎ কবিতার শক্তির ওপর জোর দিয়েছেন। সরল শব্দসমাহারে গভীর কাব্যদ্যোতনা সৃষ্টিকারী কবিতাও যে নতুন নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়ে মহৎ কবিতা হয়ে উঠতে পারে, প্রবন্ধটিতে সেই ইঙ্গিত রয়েছে। ভালো কবিতা বুঝতে পাঠক এবং নতুন লেখকদের সহায়ক হতে পারে এ প্রবন্ধটি। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যদর্শন নিয়ে। মূলত রেনেসাঁ সময়ের আধুনিকতার ভেতর দিয়ে মাইকেল যে জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন, তা তার সাহিত্যে কতটুকু প্রতিফলিত তার তুলনামূলক চিত্র রয়েছে প্রবন্ধটিতে। মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে, ধর্মীয়চিন্তার বিপরীতে মানবচিন্তার বিস্তার ঘটে, মানবদর্শন হয়ে ওঠে তখনকার সাহিত্যের অন্যতম উপাদান। মাইকেলও ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। যার প্রতিফলন মাইকেল এর সনেটগুলোতে রয়েছে। যেখানে তিনি পৌরাণিক উপাখ্যান রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে মহাকাব্য রচনা করেন। সেখানে মাইকেল ঐশ^রিক ক্ষমতা বড় না করে মানবিক গুণাবলী ও সৌন্দর্যচেতনাকে বড় করে দেখার সুযোগ তৈরি করেছেন। এছাড়া তিনি ব্যাপকভাবে প্রাচীন মিথের বির্নিমাণ করেন তার কবিতার ভেতর দিয়ে এর প্রমাণও মিলে তার বেশ কিছু কবিতাতে। বীরেন মুখার্জী মাইকেলকে ব্যক্তিসচেতন, অনুভূতিঋদ্ধ, সৌন্দর্যসচেতন কবি হিসেবেও শনাক্ত করেছেন নিজস্ব পাঠ অভিজ্ঞতার আলোকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সম্পাদকসত্তা প্রবন্ধটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ যে শুধুমাত্র একজন কবি, উপন্যাসিক বা গল্পকারই নয়, একজন সুসম্পাদক ছিলেন তারই যথার্থ প্রমাণ তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার পান এবং গ্রহণ করেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে- সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাধনা’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতী’, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’, কেদারনাথ দাশগুপ্তের ‘ভা-ার’ ও অক্ষয় কুমারের সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধনী’। এসব পত্রিকায় দায়িত্ব পালনের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচরণ সম্বলিত সম্পাদকীয়র মাধ্যমে সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে সম্পাদক হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত এই সাহসী এবং বলিষ্ঠ সম্পাদনার জন্যেই রবীন্দ্রনাথ সাধারণের মাঝে খুব দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিলেন বাঙালীর জাতীয় জীবন গঠনের অধ্যায়রূপে। অন্যথায় শুধুমাত্র অন্যসব সাহিত্যিকদের মতো তিনি হয়তো একজন কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে বেঁচে থাকতেন বাঙালী নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণীর কাছে। প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ অনন্য এবং ব্যতিক্রমী। তথ্যবহুল ও যুক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধটি পাঠকের রবীন্দ্রবিষয়ক আগ্রহের অনেকটাই পূরণ করবে। রবীন্দ্রনাথের মতো কাজী নজরুল ইসলামও সম্পাদনা ও সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল ছিলেন। তিনি ‘নবযুগ’, ‘সেবক’, ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে নিজের সম্পাদনা ও লেখনীর মধ্যে দিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মানুষের মনে বৈপ্লবিক চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি স্বরাজ পার্টির মুখপত্র ‘লাঙল’, ও ‘গণবাণী’ পত্রিকাতেও সাংবাদিকতার মাধ্যমে ব্রিটিশ রোষের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকতার মধ্যদিয়ে নজরুল রাজনীতি ও সাহিত্যাঙ্গনের বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণের মধ্যে যে চেতনা ও নব জাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন তা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী। পঞ্চাশ দশকের অন্যতম কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে বীরেন মুখার্জী ‘প্রেম-বিরহবিষয়ক ডিসকোর্স’ লিখেছেন। প্রেম কিংবা বিরহকে তিনি যে দার্শনিক চিন্তা দিয়ে বির্নিমাণ করার চেষ্টা করেছেন সেই দিকটিই যে বিনয়ের কবিতার অন্তর্নিহিত ব্যাপার, বীরেন মুখার্জীর পর্যালোচনায় এমনটিই উঠে এসেছে। বিনয় মজুমদার মূলত তার কবিতার ভেতর দিয়ে গাণিতিক সম্পর্ককে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছেন এবং সেটা প্রেম কিংবা বিরহ প্রধান কবিতার ভাবধারার মধ্য দিয়ে জীবনের অন্তগূঢ় স্থান থেকে। কিন্তু আলোচক বিনয়ের কবিতায় যে গাণিতিক বিশ^াস ও সূত্রে প্রেমের সমীকরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর উল্লেখ করলেও তার কবিতার যে তাত্ত্বিক গুরুত্ব ও দর্শনকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই সেটাই উপস্থাপন করেছেন। বিনয়ের কবিতার তাত্ত্বিক ও দর্শনগত ভাবধারাকে সমর্থনযোগ্য করে তুলতে প্রবন্ধটি সহায়ক হবে বলে মনে করা যায়। ধরে নিতে পারি আলোচকের মতো করে যে, কবিতা পাঠের জন্যে দর্শন নয় মূলত কবিতার সৌন্দর্য পাঠককে কবিতার কাছে বার বার নিয়ে যায় কবিতা পাঠের জন্যে। আর বিনয় মজুমদারের কবিতার যে সৌন্দর্যবোধ তা পাঠক ঠিকই খুঁজে নিতে সক্ষম হবেন এমন প্রত্যাশা প্রবন্ধজুড়েই দুল্যমান। ‘উৎপলকুমার বসু : কবিতায় ম্যাজিক্যাল ফর্মের নির্মাতা’ প্রবন্ধে উৎপল কুমার বসুর কবিতার শব্দ-ভাষা, আঙ্গিক, প্রকরণ ও বিষয়বস্তুর ভেতর দিয়ে নতুন এক কাব্যভাবনার সূত্র তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রবলয় ভেঙে তিরিশের কবিরা কবিতায় যে নতুন ধারা নির্মাণ করেছেন সেই পথকে অনুসরণ করে বাংলা কবিতায় উৎপলকুমার বসু যদি নতুন কোন দিক উন্মোচিত হয় সেটা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে কাব্য ঐতিহ্যে। তবে তার কবিতা নিয়ে আরও ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হলে পাঠক কবিতার পূর্ণচিত্র খুঁজে পাওয়ার স্বাদ পেতেন বলেই মনে হয়েছে। ‘সৈয়দ শামসুল হক : জলেশ^রীর শুদ্ধ মনীষী’ প্রবন্ধের আলোচ্যবিষয় ত্রিশোত্তোর বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের কবি সৈয়দ হকের পূর্ণ সাহিত্য জীবন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য, গান ও প্রবন্ধসাহিত্য এমন কোন জায়গা নেই যে জায়গায় সৈয়দ হকের স্পর্শে পূর্ণতা না পেয়েছে। মূলত সব্যসাচী এই লেখকের ধারাবাহিক সফলতাকে পাঠকের সামনে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধটিতে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার আঙ্গিক, প্রকরণ, বিষয়বস্তু ও কবিতার চিত্রকল্প বিনির্মাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। সৈয়দ হক কীভাবে সহজ সাবলীল শব্দ ও ভাষার দক্ষতায় চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তা বিশ্লেষণ ছাড়াও তার সুবিখ্যাত গল্প, উপন্যাসের মধ্যে খেলারাম খেলে যা, নিষিদ্ধ লোবান, নীল দংশন এবং কাব্যনাট্যের মধ্যে বিশেষ করে ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’- এর যে ঈর্ষণীয় সাফল্য সে দিকটিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রবন্ধটিতে। ‘মহাদেব সাহা : প্রেম ও সৌন্দর্যের অনন্য কারুতা’ প্রবন্ধে কবির ব্যক্তিকপ্রেম, মানবিক প্রেম ও দেশপ্রেম- এই তিন প্রেমের মেলবন্ধন, নির্মাণ দক্ষতা এবং তার কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা অন্তরগত দিক অšে¦ষণ করেছেন প্রাবন্ধিক। ‘নির্মলেন্দু গুণ : প্রকৃতি, প্রেম ও সংগ্রামের রসায়ন’ প্রবন্ধে প্রকৃতি, প্রেম ও সংগ্রাম যা ত্রিবেণীর মতো একই সূত্রে গ্রথিত- এই দিকটি বিশ্লেষণ করেছেন প্রাবন্ধিক। ‘রফিক আজাদ : শুদ্ধ শিল্পের পাহারাদার’ প্রবন্ধে প্রয়াত কবিকে আধুনিক বাংলা কবিতায় একজন সচেতন ও গুরুত্বপূর্ণ কবি উল্লেখ করে, তার কবিতায় মূল সুর প্রেম, রাজনীতি ও সমকালীন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক। বিচ্ছিন্নতাবোধ, নাগরিক যন্ত্রণা ও বিরহপ্রবণ নৈঃশব্দ্য তার কবিতার মূল উপজীব্য। এছাড়াও তার কবিতা রাজনৈতিক দর্শনজারিত। এই দর্শনের ভেতর দিয়ে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র, ঘাত-প্রতিঘাত ও অবক্ষয়কে জয় করার দৃঢ় সংকল্প দেখেন। প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী ষাটের দশকের কবিদের কবিতার যে বিভাজন করেছেন চারটি ভাগে। সেই ভাগের মধ্যে তিনি কবি রফিক আজাদকে সমন্বয় প্রয়াসী কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রফিক আজাদের কবিতার পাঠে নিবিড় পাঠে পাঠকও আলোচকের সঙ্গে একমত হবার সুযোগ পাবেন বলেই মনে হয়। ‘নূহ-উল-আলম লেনিনের কবিতার পাঠভাষ্য’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক তুলে ধরেছেন কবি নূহ-উল আলম লেনিনের রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার পাশাপাশি গণমানুষের কথা, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ ভাবনা। নূহ-উল-আলম লেনিনের কবিতা মানবতাবাদী চিন্তাধারা প্রভাবিত ও প্রসারিত। নূহ-উল-আলম লেনিন এর কাব্যভাষায় যে বিদ্রোহের সুর লক্ষ্য করা যায় তা পূর্বসূরি হিসেবে মানবতার ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবধারার সঙ্গে সাদৃশ্যময়। বিষয়টি গ্রন্থের আলোচক কবি নূহ-উল-আলম লেনিনের ‘পুরবাসীর কাছে খোলা চিঠি’ কবিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবলোকন করিয়ে দিয়েছেন। কবি নূহ-উল-আলম লেনিনের কবিতাকে শিল্প অপেক্ষা বক্তব্যের চাহিদাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলেও অভিহিত করেছেন, যা কবিতায় নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে বলেও প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন। কবির রাজনৈতিক দর্শনে কারণে কবিতা স্লোগানমুখর হয়ে উঠেছে, তবে সেখানে উঠে এসেছে মানবতাবাদ, দায়িত্বশীলতা, সংগ্রাম, সাম্যবাদ, দেশচিন্তা ও মূল্যবোধ। কবি নূহ-উল-আলম লেনিনের কবিতা কাব্যিক শৈল্পিক নির্দেশনার স্মারক বলেও প্রাবন্ধিক মনে করেন। ‘কামাল চৌধুরীর কবিতায় প্রকৃতি জিজ্ঞাসা’ প্রবন্ধটিতে কবির প্রকৃতিলগ্নতা ফুটে উঠেছে। রোমান্টিক কবিতায় প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেন কবিরা। কামাল চৌধুরীও প্রকৃতির নানা উপাদান উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক, রূপক কিংবা চিত্রকল্প সৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন। আলোচক কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার কবিতায় ব্যবহৃত প্রকৃতির বেশ কিছু উপাদান আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যেমন নদী, বাতাস, রাত, নক্ষত্র, জোছনা, পাতা ইত্যাদি। কবিতা যেহেতু জীবনের অংশ। তাই জীবনকে কবিতায় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যে প্রকৃতির এই উপাদানগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরতে হয়েছে কবিকে। প্রকৃতির অনুষঙ্গকে এভাবেই তিনি কখনো সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে রূপান্তরিত করেছেন কাব্যলঙ্কারে। এভাবেই কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় প্রকৃতি জিজ্ঞাসার আশ্রয় খুঁজে পায় আলোচক বীরেন মুখার্জীর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ও গভীর কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে। ‘বিষ্ণু বিশ^াস : জীবনের সমান্তরাল কবিতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে আশির দশকের তারুণ্যোজ¦ল এই কবির জীবন ও কবিতা আলোচিত হয়েছে। আশির দশকে সৈ¦রশাসকের অবস্থানের বিরুদ্ধে তিনি তার কবিতাচর্চাকে শাণিত করছেন। আলোচক বিষ্ণু বিশ^াসের ৭ টি কবিতা দিয়ে তার কবিতার বিষয়, প্রকরণ, আঙ্গিক, কাব্যভাষা এবং কবিতার ভেতর দিয়ে বিষ্ণু বিশ^াসের জীবনবোধকে চমৎকারভাবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উপস্থাপন করেছেন। ধর্মের দায়ে পারিপার্শি¦ক ও মানসিক কারণে স্বেচ্ছায় দেশত্যাগের প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে প্রবন্ধে। ধর্ম যখন পরিচয়ের মাপকাঠি হয়ে ওঠে তখন একজন কবির পক্ষে সেই জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে ওঠে। আলোচক এমন যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিষ্ণু বিশ^াসের দেশত্যাগের কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রাবন্ধিকের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়, কবি বিষ্ণু বিশ^াসের কবিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তা অভিন্ন হওয়ায় তার কবিতা ও জীবন সমান্তরালভাবে প্রবহমান। ‘সোহরাব পাশা : পরাবাস্তবতায় নৈরাশ্যের বয়ান’ প্রবন্ধটিতে সোহরাব পাশা’র কবিতায় পরাবাস্তবতার দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আলোচক কবি সোহরাব পাশা’র কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছকে কখনো সালঙ্কৃত কখনো নিরলঙ্কার বলে উল্লেখ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে কবি অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোন অলঙ্কার নির্মাণ করেননি। যে শব্দ বা ভাষা দিয়ে সরাসরি অভিব্যঞ্জিত করা সম্ভব সেখানে আর কোন অলঙ্করণের প্রয়োজন নেই। সোহরাব পাশার কবিতায় সমকালীন বাস্তবতা, প্রেম, প্রকৃতি, নারী এবং সমাজ সভ্যতা নিয়ে বেড়ে ওঠে বলে আলোচক মনে করেছেন। আধুনিকতা ও জীবন দর্শনই সোহরাব পাশার কাব্যশক্তি বলে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন। ‘আমিনুল ইসলামের কবিতা : শিল্পপ্রজ্ঞা ও বিশ^ায়নের মিথষ্ক্রিয়া’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক আমিনুল ইসলামের কবিতায় নিজস্ব শিল্পরুচির অভিঘাত খুঁজে পেয়েছেন। তিনি কবিতায় নিজস্ব সংস্কৃতির নতুন উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে বিশ^সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন, যা নিখুঁতভাবে একজন কবির শিল্পপ্রজ্ঞা হিসেবে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক। আমিনুল ইসলাম মূলত শেকড় সন্ধানী কবি। তার কবিতায় দেশজ ঐতিহ্য, ইতিহাস, মিথ ও বিশ^সাহিত্যের মিথ, বিশ^ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও ইতিহাসের যে মেলবন্ধন রয়েছে, আমিনুল ইসলামের কবিতায় সমকালীন ভাষাভঙ্গির কারণে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া তিনি নিজেকে ভাঙতে সচেষ্ট থেকেছেন বলেই তার কবিতায় কাব্যভাষার মধ্যে একটা বাঁকবদলের ধারা স্পষ্ট বলেও আলোচক মত দিয়েছেন। পরিশেষে ‘স. ম. শামসুল আলমের কবিতা : আপন সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল’ শিরোনামের প্রবন্ধে স.ম. শামসুল আলমকে একজন সনাতন ধারার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বীরেন মুখার্জী। সনাতন ধারার কবিতায় যেমন পেলবতা, গীতময়তা ও মন্ময় ধারাগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হয়- স. ম. শামসুল আলমের কবিতায়ও সেই সুর ব্যঞ্জিত। আলোচকের এই বিশ্লেষিত উপলব্ধি নেহাত নঞ্চর্থক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। স. ম. শামসুল আলমের কবিতায়ও উপমান-চিত্রকল্প এর সাহায্য ছাড়াই সরাসরি শব্দ ও ভাষার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে অভিব্যঞ্জিত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলে আলোচক আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এটাও একজন কবির নিজস্ব কাব্যগুণের সমন্বয়। স. ম. শামসুল আলমের কবিতায় প্রেম-বিরহ, দ্রোহ, ও মানবপ্রেম সরব। আলোচক তাকে একজন নিরেট প্রেমের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী। কবি স. ম. শামসুল আলমের কবিতা নির্মাণ ও কাব্যজগৎ বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতার হাত ধরে আপন সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠছে বলে আলোচকের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান করা যেতে পারে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী অত্যন্ত নিষ্ঠাচিত্তে কবিতার নির্মোহ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন প্রবন্ধগুলোতে। কবি বলেও হয়তো কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে তিনি এমন যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পেরেছেন। ‘কবিতার শক্তি’ গ্রন্থে সূচিভুক্ত প্রবন্ধগুলো পাঠে প্রাবন্ধিকের তীক্ষèতর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির সন্ধান মেলে। যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ নৈপূণ্যের কারণেই ‘কবিতার শক্তি’ গ্রন্থটি একটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধগ্রন্থ হিসেবে পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে বলে আশা করা দোষের নয়। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।
×