ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৯ জুন ২০১৭

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

পৃথিবীতে মানুষ যত প্রত্যেকের ফিঙ্গার প্রিন্ট তার তার মতো। অনেকটা সেভাবেই প্রতিটি মানুষের জীবনে রয়েছে কোন না কোন গল্প আর সে গল্প বিচিত্রতার কারণে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। সেই হিসেবে গল্পকাররা হবেন বিষয় অন্বেষণে বৈচিত্র্যমুখী এবং উপস্থাপনে বহুমুখী। কিন্তু মুখ থাকলেও বহুল চর্চিত কথোপকথনে বক্তার কথা সব সময় যেমন ভাল লাগে না, ঠিক তেমনি একই দেশ-কাল-পাত্রের মধ্যে আমি তুমি সে বিষয় আশ্রিত গল্প সব সময় মনে দাগ কাটে না। কাটে না কাটে না করেও একটা সময় এসে গল্পকার তপন দেবনাথের লেখা গল্পগুলো মনে দাগ ফেলে যায়। প্রথমত, বাংলাদেশী মানসিকতায় আমেরিকান প্রবাসী জীবন উপস্থাপনায়। দ্বিতীয়ত, সৃজন কর্মে মেধা শূন্যতার খরারকালে বুুদ্ধিদীপ্ত রচনায়। তৃতীয়ত, মূল্যবোধে জারিত ভবিতব্যকে জিইয়ে রাখার অনুপ্রেরণায়। অনুপ্রাণিত হবার মতো গল্পগুলো জানা গেল এবারের অমর একুশে বইমেলায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত, গল্পকার তপন দেবনাথ রচিত, গল্পগ্রন্থ চোখের আলোয় দেখেছিলেম বইটি পড়তে পড়তে। চোখের আলোয় দেখেছিলেম গল্পের নামেই গল্প গ্রন্থ। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডেভিড যে কিনা একটা দোকানের কর্মচারী। তার সহকর্মী বিশ্বকাপ ফুটবলের ধূমকেতু নৃত্যশিল্পী শাকিরার দেশ কলম্বিয়ার ললনা ওগলা রামোস। টানা টানা চোখের অধিকারনী, উঁচু নাক, উজ্জ্বল শ্যামলা, হালকা পাতলা শরীরী ওগলার বিশ্বাস, মানুষ একটা অবলম্বন আশ্রয়ের মধ্যে দিয়ে মূলত তার দুঃখকে ভুলে থাকে। যেমন ডেভিড বইয়ের মধ্যে ডুবে ভুলে থাকে ওগলার কার্বন কপি সাদৃশ্য বিগত প্রেমিকা বিন্দুকে। বিন্দুকে ভেবে ডেভিড আনমনে গেয়ে চলে রবীন্দ্র সঙ্গীত, কেটেছি একলা, বিরহের বেলা/আকাশ কুসুম চয়নে/সব পথ এসে, মিলে গেল শেষে/তোমারও দুখানি নয়নে, নয়নে, নয়নে। গানের বাংলা অর্থ ইংরেজীতে ওগলার বুঝতে চাওয়ার ব্যাকুলতা আর ডেভিডের বাংলা থেকে ইংরেজী করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে উভয়ের আরও কাছাকাছি এসে ভালবাসায় নিমগ্ন হবার গল্প চোখের আলোয় দেখেছিলেম। চোখের আলোয় দেখা দেখি না বরং মেয়েদের মাঝে পাপড়ি না মহুয়াকে বেশি রূপে-গুণে সুন্দরী সে হিসাবের বোঝাপড়ার গল্প ঈর্ষা। বইয়ের স্টলে বসা মিলন দা ক্রেতা শূন্যবস্থায় বসে থাকলেও পাপড়ি কিংবা মহুয়া কেউ একজন এসে বসলে ক্রেতাও বাড়ে, আয়োজক সংস্থার লোক বাড়ে আবার বই বিক্রিও বাড়ে। কিন্তু দুই ললনার বিতর্কে মিলনদার বিস্ময় এটি জেনে যে, মেয়েরা ছেলেদের নজর আকৃষ্ট করতে যতটা না সাজে তার চেয়ে বেশি সাজে মেয়েরা মেয়েদের দেখানোর জন্য। দেখান দারিত্বে মহুয়া না পাপড়ি কে যে কার চেয়ে বেশি সুন্দরী সে প্রশ্নের ঈর্ষণীয় ঈর্ষাকাতরতার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় গল্প ঈর্ষা। ঈর্ষা শুধুই না বরং ঘৃণা, হিংস্রতা বর্ষণকারী বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের কেউ কেউ বাংলাদেশী পাসপোর্ট করে আর আমেরিকান ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকায় প্রবাসী হয়ে বিগত বৈশিষ্ট্য যে আজও ধরে রেখেছে তার গল্প দেশী ভাই। লতিফুর রহমানদের মতো আটকে পড়া পাকিস্তানীদের কারণে আজও আমেরিকায় বসবাসকারী শরীফ কিংবা কালামদের মতো বাংলাদেশীরা কতটা অসহায় তা নিয়েই গল্প দেশী ভাই। দেশী ভাই না বরং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার টানাপোড়েনে মূল্যবোধের দোদুল্য মানতার অবসানে চেতনা জাগ্রত হবার তেজদীপ্ত গল্প কি লজ্জা! লজ্জ্বারই বিষয় আমেরিকার মতো প্রবাসে একাকী কোন মেয়ের একাকিত্বের সুযোগে উপকার করার পথ দিয়ে ঢুকে সর্বশান্ত করার আগ্রাসী মনোভাবের পুরুষের অস্তিত্ব থাকা। এ রকমই পুরুষ বিদ্বেষী গল্প আত্মজা। আত্ম প্রবঞ্চক দেশবিরোধী ইদ্রিসের মতো মানুষেরা প্রবাসে বসে কথার ফুলঝুড়িতে কিভাবে দেশের সুনাম আর প্রতিষ্ঠানের ক্রনিক ক্ষতি সাধন করে চলেছে তা নিয়েই গল্প মিথ্যাচারের বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের এই বিস্তৃতি ও গভীরতা অন্বেষণের কালে তপন দেবনাথের ভাবনা, বিষয় বিন্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রগতিশীল। গল্পের দ্বান্দ্বিক বুনন কৌশলী। আবিষ্কারের আকাক্সক্ষা ধরে রাখায় নাটকীয়। শব্দ চয়ন ধ্রুপদী ও চলতির ফিউশান। মূল্যবোধ অটুট। লেখার শেষে স্বগোতক্তি না করে পাঠকের সামনে প্রশ্ন করা খানিকটা অহেতুক। বর্তমান অস্থিরতার এই প্রযুক্তির বিশ্বে কেউ জেনে বুঝে কাউকে জ্ঞান দিচ্ছে এটাই বিরক্তির। প্রশ্ন নয় বরং সমাধানটাই কাম্য। তা সে হোক প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে। যেমনিভাবে আদিত্য অন্তরের প্রচ্ছদ সব বলেও কিছু বলা অব্যক্ত রাখে। ব্যক্ত এবং অব্যক্ততার নান্দনিক গল্পগ্রন্থ তপন দেবনাথের চোখের আলোয় দেখেছিলেম।
×