ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রণালয় বলছে যতটুকু বরাদ্দ প্রয়োজন ততটাই পাওয়া যাচ্ছে

বাজেটের আকার বাড়লেও কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে ৭৬ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ জুন ২০১৭

বাজেটের আকার বাড়লেও কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে ৭৬ কোটি টাকা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের সময়েই বাজেটে অবহেলিত কৃষি খাত। কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে কৃষি খাতে বরাদ্দ কমছে। কমেছে শতাংশিক হিসাবে বরাদ্দের পরিমাণও। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা। আর শতাংশিক হিসাবে বরাদ্দ কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষিতে ১৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা হ্রাস পেয়ে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটেও বরাদ্দ কমেছে ৭৬ কোটি টাকা। সময়কাল ব্যবধানে, ক্রমহ্রাসমান হারে কৃষিতে বরাদ্দ কমলেও বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তবে চাহিদার দিক থেকে, ১৫ হাজার কোটি টাকার বৃত্তই ভাঙতে পারেনি কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, ‘কৃষির জন্য যতটুকু বরাদ্দ প্রয়োজন ঠিক ততোটাই পাওয়া যাচ্ছে। কোন কারণে আকস্মিক অর্থের প্রয়োজন হলে তা ছাড় করা যাচ্ছে।’ এদিকে, প্রবৃদ্ধিমুখী অর্থনীতিতে ক্রমাগত কৃষির বরাদ্দ কমে যাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বড় হতে থাকা বাজেটে আনুপাতিক হারে কৃষিতেও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। কৃষিবিদরা মনে করেন, উদ্ভাবনীমূলক কর্মকা-ে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষিতে সরকারের কোন বিনিয়োগ নেই। সরকার কী করতে চায় তা তাদেরে নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের বেতনভাতা পরিশোধ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন ব্যয় নেই। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে ভর্তুকি যত কমাতে পারে ততই ভাল। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রয়েছে বলে মনে করেন কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাজেটে কৃষি বরাদ্দ নিয়ে কোন সমস্যা নেই। চাহিদা অনুযায়ীই বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আসলে বাজেটে বরাদ্দ কমেনি। ওই বছরটিতে হয়তো বিশেষ কোন প্রকল্পে বিশেষ বরাদ্দ ছিল। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হামিদুর রহমান বলেন, বাজেটে কৃষির জন্য বরাদ্দ কম হয়েছে বলে আমি তা মনে করি না। তবে কৃষির যে পরিবর্তনÑ বাণিজ্যিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারী খাতের গুরুত্বপূর্ণ যে সম্পর্ক দরকার, তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। তিনি বলেন, বাজেটে কৃষির উদ্ভাবনমূলক কর্মকা- সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। আমি মনে করি, উদ্ভাবনমূলক কর্মকা-ে আরও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার। গত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লষণে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল এ যাবত কালের সর্বোচ্চ। বছরটিতে কৃষি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। পরের অর্থবছরগুলোতে মোট বরাদ্দ কমার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে শতাংশিক হিসেবে বরাদ্দের পরিমাণও। প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। শতাংশিক হিসাবে এ বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫ বছরের ব্যবধানে কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা। আর শতাংশিক হিসেবে বরাদ্দ কমেছে ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। তবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে কৃষিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ও শতাংশিক বরাদ্দের পরিমাণ উভয়ই কম ছিল। তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট বাজেটের ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায়ও প্রস্তাবিত বাজেটে শতাংশিক হিসেবে বরাদ্দ কমেছে। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমেছে ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। এদিকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষির জন্য মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৭৬ কোটি টাকা কম। জানা গেছে, প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৮০৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ১ হাজার ৭৯৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ভর্তুকি কমে যাওয়ার অভিযোগ থাকলেওÑ বাজেটে বরাদ্দকৃত ভর্তুকির পুরোটা ব্যয় করতে পারছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি কমেছে ৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি বরাদ্দ থাকলেও তারা ব্যয় করেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্ বলেন, ভর্তুকি যা প্রয়োজন তখন তা ব্যয় হবে। বাকিটা থেকে যাবে। সারের দাম কম থাকায় গত গত অর্থবছরের ভর্তুকির ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া অর্থবছরটিতে বেসরকারীভাবে সার আনা হয়নি। ফলে ভর্তুকির ব্যবহার কমেছে। এদিকে বাজেটে বরাদ্দ কমলেও থেমে নেই কৃষি। এগিয়ে যাচ্ছে। ছিনিয়ে এনেছে চাল রফতানিকারক দেশের তকমাও। বুক উঁচু করে বলা যাচ্ছে, জীনতত্ত্বেও এগিয়ে দেশ। শুধু পাট নয়, উন্মোচিত হবে ধানের জীবন রহস্যও। উদ্ভাবনী শক্তিই এগিয়ে নিচ্ছে কৃষিকে। তবে বাজেটের কঠিন হিসাবে যেতে চায় না কৃষক। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়েই তাদের যত চিন্তা। সঙ্গে রয়েছে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত দাম প্রাপ্তি প্রত্যাশা। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মোঃ মোস্তফা বলেন, কৃষকের জন্য আবার বাজেট! বাজেটের তো কিছুই বুঝি না। শুনেছি অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। অথচ ধানে যেমন দাম কম পাই, তেমনি অন্য পণ্যেও। যান্ত্রিকীরণকে উৎসাহিত করছে সরকার। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে উন্নয়ন সহায়তার হাড় হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।’ অথচ একই সময়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ট্রাক্টরের ওপর ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাজেটের এমন প্রস্তাবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিরুৎসাহিত হবে বলে মনে করেন কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা। আর কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বাজেটে ঘোষিত আত্মঘাতী এ সিদ্ধান্ত যেন প্রত্যাহার করা হয়। সামগ্রিক প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনীতিতে এখনও কৃষি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কৃষিপণ্যই সাধারণ মানুষের ভোগ-ব্যয়ের বড় অংশ। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও কৃষি খাতের দখলে সিংহভাগ। এমন পরিস্থিতিতে বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। তবে বরাদ্দ কমে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে, সে কারণেও হয়তো তুলনামূলক বরাদ্দ কমতে পারে। করণীয় প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, যান্ত্রিকীকরণ ও বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে অঞ্চলভিত্তিতে আলাদাভাবে বরাদ্দ থাকা উচিত। কৃষি বিনিয়োগেও বহুমুখিতা আনা প্রয়োজন।
×