ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

প্রকাশিত: ০৩:২৪, ৯ জুন ২০১৭

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে একশ্রেণীর বিপথগামী বল প্রয়োগের মাধ্যমে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় এবং তাদের কট্টরনীতিকে জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে থাকে। এই জঙ্গীবাদÑ সন্ত্রাসবাদ আজকে বিশ্বব্যাপী প্লেগের চেয়েও মহামারী আকার ধারণ করেছে। একশ্রেণীর বিপথগামী উগ্রবাদী ধর্মকে আশ্রয় করে এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে এখন রাজনৈতিক বাস্তবতা। যা শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সভ্যতার জন্য বড় আকারের হুমকি। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়টাতে ইউরোপে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে। ঐ সময়টায় জার্মানির নাৎসী বাহিনী ইহুদী নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরপর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখতে সুকৌশলে মুসলমানদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে একশ্রেণীর সরকারবিরোধী জঙ্গীকে লালন শুরু করে, যা ক্রমান্বয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিস্তৃত হতে হতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের চোখের ঘুম। এরা এতই নৃশংস যে, আইএস নামক দানবীয় জঙ্গীগোষ্ঠী সারা বিশ্বের সুজলা-সুফলা-সবুজ ভূমিকে রক্তে রঞ্জিত করে তুলেছে। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেশ থেকে শুরু করে ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত দেশগুলোতেও এরা একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছে যে, বিশ্বের কোন দেশে যে এই দানবের ছোঁয়া লাগেনি তা কেউ গর্ব করে বলতে পারবে না। আবার আইএসের নাম ব্যবহার করে কোন কোন দেশের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত জঙ্গীগোষ্ঠী হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। তারা তা পারছে যে কোন সাম্প্রদায়িক হামলায় আইএসের দায় স্বীকারের প্রবণতার কারণে। আইএস মিডিয়ায় নিজেদের প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সামরিক ফ্রন্টের বাইরে তাদের অন্যতম কৌশলই হচ্ছে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা। তাই কোথাও কোন হামলা হলেই তারা দায় স্বীকার করে নেয়। কিন্তু তাদের এই দায় স্বীকারের সংস্কৃতির কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং তাদের তাঁবেদার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করছে বাংলাদেশে আইএস আছে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স এ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক রোহান গুনারতেœ দাবি করেন নব্য জেএমবি নামে বাংলাদেশে যেসব হামলা চালনা হচ্ছে তারা মূলত আইএস। এসব দাবির আসল উদ্দেশ্য যে, আইএস দমনের নাম করে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানো তা সহজেই বোধগম্য। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই দেশে কোন আইএস নেই, এরা হোম গ্রোন তথা দেশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গী। এদেশের ভৌগোলিক বিন্যাস, জনসংখ্যার ঘনত্ব, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর মনোভাব, রাজনৈতিক পরিবেশ আইএসের জন্য কোনভাবেই উপযুক্ত নয়। তবে মৌলবাদী গোষ্ঠী যে এদেশে আছে তা অস্বীকার করার জো নেই। এরা বিভিন্ন সময় জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলেও বাঙালীর মাঝে বিরাজমান জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে তারা সংগঠিত হয়ে যে আইএসের মতো খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে তা কোনকালেই সম্ভব নয়। আত্মপরিচয়ের ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে বাঙালী অসাম্প্রদায়িক এক জাতি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালী আবেগ-অনুভূতির মিথস্ক্রিয়ায় সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নির্বিঘেœ শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করে আসছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালীন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনকালীন ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালীন নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে, নানা অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসীয় তাত্ত্বিক ধারায় জাতীয়তাবাদকে কখনোই তেমন আমলে নেয়া হয়নি। বরং এই ধারায় বলা হয় জাতিকেন্দ্রিক আন্দোলনের চরিত্র নিতান্তই বুর্জোয়া। মার্কসীয় ধারায় কেবল শ্রেণীকেন্দ্রিক আন্দোলনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। মার্কসীয় ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত বদরউদ্দিন ওমরও তাই তাঁর বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রবন্ধে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে বাঙালীর চেতনাগত ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এর অভ্যন্তরে ধর্মীয় উপাদানের উপস্থিতিকে এবং এই কারণে তিনি বাংলাদেশকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মানতে নারাজ। এটা সত্যি যে, এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে ধর্মের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা আছে। কেবল নিজের ধর্ম নয়, অন্য ধর্মের প্রতিও যা আদতে ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যই বহন করে। এখানে প্রাসঙ্গিক হবে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে নাস্তিকতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের সমান অধিকার, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ সকল ধর্মের মানুষের মিলেমিশে থাকা। ব্যতিক্রম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র মজিদের মতো কিছু স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী, যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে থাকে নিজের কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য। ব্রিটিশ কর্তৃক সুকৌশলে বিভাজিত হিন্দু-মুসলিম এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষকে ভিত্তিমূল ধরলে আসলে এটা মনে হওয়াই যৌক্তিক হবে যে, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। কিন্তু যদি আরও পেছনের দিকে তাকানো যায় অর্থাৎ প্রাচীন, মধ্যযুগে কিংবা ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে তবে বাংলাকে ধর্মনিরপেক্ষতার অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করাই হবে সমীচীন; কেননা ঐ সময়গুলোতে ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সহাবস্থানের অপূর্ব এক দ্যোতনা। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র হলেও ধর্মনিরপেক্ষ যে ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং পরবর্তীতে সেই ধারার সৃষ্ট রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ভিত্তিমূল ধরলে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যই সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনন্য, অনবদ্য। সংবিধানেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশের চার ভিত্তির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অসাম্প্রদায়িক এই দেশে প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও রাষ্ট্র কর্তৃক সমান সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ সবাই। কিন্তু এই সম্প্রীতি ‘মজিদদে’র মতো মৌলবাদীদের পছন্দ নয়। তাই তারা সর্বদাই রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যর ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টায় থাকে, যা আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই। সাম্প্রতিক যে জঙ্গী হামলাগুলো বাংলার মাটিতে হয়েছে সেগুলো মৌলবাদীরাই করেছে এবং তা করেছে আন্তর্জাতিক দানব আইএসের নাম ভাঙ্গিয়ে। এরা আসলে পাকিস্তানপন্থী, যারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। এরা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকেও বিকলাঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করে পাকিস্তানীদের খুশি করতে চায়। এদের সৃষ্টি ও প্রতিপালন যে বিএনপি-জামায়াত নামের পাকিস্তানদরদী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে হয়েছে তা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণা গ্রন্থÑ ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জঙ্গীবাদ মর্মার্থ ও করণীয়’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে জঙ্গী ও মৌলবাদী গ্রুপের সংখ্যা একশ’ বত্রিশটি, যা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ রকমের হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এদের উত্থানপর্ব ছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমল। জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানে পলায়নরত জামায়াতী নেতাদের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছিল। কেননা এরা শুধু প্রত্যাবর্তনই নয়, রাজনৈতিক সকল ক্রিয়াকলাপ করার সুযোগ লাভ করেছিল। সেই সুযোগে এরা এদের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী কিছু মানুষকে গোপনে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিতে থাকে, যা বিভিন্ন সময় নানা পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। তারা এবং তাদের উত্তরসূরিরাই নানা নামে নানা ডালপালা, শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে আসছে বিগত ত্রিশ দশক ধরে। তবে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জঙ্গীবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলাম বা হুজি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই সংগঠনটিকে জঙ্গীবাদের উৎসমুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরাই হলো প্রাতিষ্ঠানিক জঙ্গীবাদের প্রথম প্রজš§। গত শতাব্দীর ঊনআশি থেকে ঊননব্বই সাল পর্যন্ত দশ বছর ব্যাপৃত আফগানিস্তান-সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী আফগান মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আফগান মুজাহিদরা কাবুল জয় করার পর উল্লসিত বাংলাদেশী মুজাহিদরা দেশে ফিরে নিজেরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি) যাত্রা শুরু করে। হুজি সদস্যরা ছিল হানাফি মাজহাবের এবং দেওবন্দ ধারার কওমী মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করা। ওই সময়টা ছিল বিএনপি আমল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া এমন একটি সংগঠনের জš§ তাও আবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছিল, এটা ভাবার কোন অবকাশই থাকে না। এ নিয়ে তাই প্রশ্ন জš§ নেয়াটাই স্বাভাবিক। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এরা নিজেদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে, যেখানে দশজন মানুষ নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় এরা গ্রেনেড হামলা চালায়, যাতে আইভী রহমানসহ চব্বিশজন নিহত হন আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ আহত হন তিন শতাধিক লোক। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়েছিল এগারোটি শক্তিশালী গ্রেনেড, যার ফলে ঘটনাস্থলেই বারোজন এবং পরে হাসপাতালে বারোজন নিহত হয়েছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকার ঘাতকদের বাঁচাতে ‘জজ মিয়া’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ মোট বাইশজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ইতোমধ্যে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। অন্যদের বিচারকার্য চলছে। যা হোক, নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটি এখনও সক্রিয় আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, হরকত-উল-জিহাদ নামের জঙ্গী সংগঠন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশ সক্রিয়। এরা আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা ও লস্কর-ই-তৈয়বাকে সহযোগিতা করে চলছে। ছিয়ানব্বই সালে কিতাল-ফি-সাবিলিল্লাহ নামের একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করে, যা এর বছর দুই পরে জামায়াত-উল-মুজাহিদীন বা জেএমবিতে রূপান্তরিত হয়। এটি জঙ্গীবাদের দ্বিতীয় প্রজš§। এর প্রতিষ্ঠাতা শায়ক আবদুর রহমান, যার সঙ্গে মিসরের ব্রাদারহুডের গভীর যোগাযোগ ছিল। সালাফি মতাদর্শে বিশ্বাসী জেএমবির নেতা-কর্মী সবাই এসেছে আহলে হাদিস তথা লা মাজহাবি (মাজহাববিরোধী) ধারার মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা থেকে। হুজি ও জেএমবি এই দুটি সংগঠনের মাজহাবগত পার্থক্য থাকলেও এরা একে অন্যের সঙ্গে ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দুটি সংগঠন যৌথভাবে কাজ করতে ও দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। ২০০৫ সালের সতেরোই আগস্ট সারা বাংলাদেশের তেষট্টি জেলায় সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে একযোগে পাঁচশতাধিক বোমা হামলা চালিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটি নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছিল। ওই হামলায় দু’জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। ঐ সময়ের বিএনপি সরকারের যোগসাজশ ছাড়া যে এত বড় হামলা চালানো সম্ভব নয় তা কারও অবোধ্য নয়। ঐ বছরের অক্টোবরে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলায় দু’জন নিহত ও বিশজন আহত হয়েছিল এবং নবেম্বরে ঝালকাঠি আদালতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল রহমান এবং গাজীপুর আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলায় এগারোজন নিহত ও পঁয়ত্রিশজন আহত হয়েছিল। জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার পর এর ৬৬০ সদস্যকে আসামি করে সারাদেশে ১৬১টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সংগঠনটির শীর্ষনেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বাংলাভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, থিঙ্কট্যাঙ্ক আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাহউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই সংগঠনটি। ঐ মামলায় পনেরোজন জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড, ১১৮ জনের যাবজ্জীবন, ১১৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ১১৮ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। শায়ক আবদুর রহমানের পর এই জঙ্গী সংগঠনের হাল ধরে মাওলানা সাইদুর রহমান। তাকে গ্রেফতার করা হলে আমির হয় জেএমবি নেতা ফাহিম। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এখনও এদের বীজ উপড়ে ফেলা যায়নি। তাই এরা এখনও অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে নানারকম জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের শরীয়াহ আদালতের বিচারপতি শায়খ তাকি উদ্দিন আন নাবহানি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইসলামী খিলাফাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৩ সালে হিযবুত তাহরির নামের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা মধ্যপ্রাচ্য হতে ধীরে ধীরে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদের কর্মপদ্ধতি হচ্ছে নুসরাহ (সামরিক সমর্থন) খুঁজে সরকার উৎখাত করা। গ্লোবাল সিকিউরিটি ডট অর্গ নামের একটি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক সংস্থার মতে হিযবুত তাহরির হলো একটি মৌলবাদী গুপ্ত সংস্থা, যারা সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক। এই সংগঠনটি বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ২০০১ সালে, যাকে এই দেশের জঙ্গীবাদের ইতিহাসে তৃতীয় প্রজš§ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এই জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত পেশাজীবী। এরা বাংলাদেশকে একটি খিলাফত রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং সেইসঙ্গে চায় নারী-পুরুষের মেলামেশা বন্ধ করে দিতে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, এরা বাংলার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা করতে চায় আরবীকে। ২০০৯ সালে এদের বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। এরা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্য থেকেও সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়েছিল তা প্রমাণিত হয় ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। চলবে... লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাবি
×